Wednesday, May 7, 2025

‘যদি কণ্ঠ দাও’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

শব্দ অমৃতকুম্ভ শব্দই বিষ

কখনো কথামৃত
কখনো খরিস ।

কথায় আছে , ‘ শব্দব্রক্ষ্ম ‘ । শব্দ সর্বত্রগামী । মানুষকে আলোড়িত ও প্রভাবিত করার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম । কখনো হাতিয়ার , কখনও বা শুশ্রূষা । কিন্তু মানবদেহের যে বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে শব্দ ‘ ব্রক্ষ্ম ‘ হয়ে ওঠে , তা হলো কণ্ঠ । কণ্ঠ ছাড়া শব্দের প্রকাশ কোথায় ?

পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ লিখেছেন : যদি কণ্ঠ দাও আমি তোমার গাহি গান …

গান তো বটেই , কথা বলতে গেলেও কণ্ঠ চাই । কিন্তু কণ্ঠ ধরে রাখা , অর্থাৎ বাঁচিয়ে রাখা কি খুব সহজ কাজ ? মোটেও নয় । যত্নের অভাবে , পরিচর্যার অভাবে প্রকৃতিদত্ত কণ্ঠ যখন তখন রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে , এমনকি স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে । তাই , কণ্ঠের যত্ন নিতে হয় প্রতিমুহূর্তে , কণ্ঠের লালন-পালন অবশ্য পালনীয় কর্তব্য । সারা বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে কণ্ঠের গুরুত্ব অপরিসীম । আর এখানেই অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বিশ্ব কণ্ঠ দিবস ।

আজ ১৬ এপ্রিল , বিশ্ব কণ্ঠ দিবস । এই দিবসটির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো মানবজাতির দৈনন্দিন জীবনে কণ্ঠস্বরের বিশাল গুরুত্ব অনুধাবন করা । ১৯৯৯ সালে ডাঃ নেডিও স্টেফেনের সভাপতিত্বে ব্রাজিলিয়ান সোসাইটি অফ ল্যারিঙ্গোলজি এন্ড ভয়েস প্রথম ১৬ এপ্রিল দিনটিকে ব্রাজিলিয়ান ভয়েস ডে হিসেবে উদযাপন করে । পরবর্তীকালে , ২০০২ সালে আমেরিকান একাডেমি অফ ওটোলারিঙ্গোলজিস্ট-হেড এবং নেক সার্জারি এই দিনটি উদযাপন করা শুরু করলে এটি ‘ বিশ্ব ভয়েস দিবস ‘ হিসেবে স্বীকৃত হয় ।

কণ্ঠ ও কণ্ঠনালির সমস্যা এবং কণ্ঠকে সুস্থ রাখার উপায় সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিই এই দিবসটির মূল উদ্দেশ্য । মূল বিষয়টিকে অবিকৃত রেখেই প্রতিবছর থিমস্লোগান বা প্রতিপাদ্য পাল্টায় । যেমন , মেক দ্য ভয়েস টু চেরিস ইওর ভয়েস । এক বিশ্ব অনেক ভয়েস ।

বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি মানুষ কণ্ঠের নানা সমস্যায় ভোগেন । এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হন স্বরভঙ্গের সমস্যায় । এছাড়া গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও কম নয় । গলাবসা বা কণ্ঠস্বর ভাঙার অন্যতম প্রধান কারণ হলো শ্বাসনালির সংক্রমণ । সাধারণ ঠাণ্ডায় বা দীর্ঘক্ষণ জোরে কথা বললেও গলা ভাঙতে পারে । এতে গলার স্বর বসে যায় , গলা ফ্যাঁসফ্যাঁস করে , ফাটা আওয়াজ বেরোতে থাকে । ধূমপান থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় । যে কোনো নেশাই গলার ক্ষতি করে । থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যাতেও অনেক সময় স্বরভঙ্গ হয় । ভোকাল কর্ড বা স্নায়ু কোনোভাবে জখম হলেও গলা বসে যেতে পারে । কণ্ঠ যাঁদের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে যুক্ত , যেমন , গায়ক , অভিনেতা , শিক্ষক , বাগ্মী , এঁদের প্রয়োজন কণ্ঠের পর্যাপ্ত বিশ্রাম ।

ডেসিবলের যে নির্দিষ্ট সূচক মেনে কথা বললে গলার কোনো ক্ষতি হয় না , সেটি অধিকাংশ মানুষেরই মনে থাকে না । যে নির্দিষ্ট উচ্চগ্রামে বা স্কেল-এ কথা বললে বা গান গাইলে কণ্ঠ আরাম ও স্বাচ্ছন্দ পায় , তা বেশিরভাগ সময়েই মানা হয় না । ফলে কণ্ঠের ক্ষমতার অপব্যবহার তো হয়ই , একইসঙ্গে অপচয়ও হয় । আজকের এই অত্যাধুনিক যুগের চাপা উদ্বেগ ও অতিরিক্ত পরিশ্রমেও কণ্ঠ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।

মানুষ একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রধানত কণ্ঠের মাধ্যমে । হাসিকান্না , গান গাওয়া , প্রতিবাদ , চিৎকার করে আবেগ প্রকাশ ইত্যাদি সবরকমের মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রেই আমাদের কণ্ঠস্বরের বিশাল ভূমিকা রয়েছে । যাঁরা কথা বলতে পারেন না তাঁরা ভীষণ কষ্টে থাকেন । কণ্ঠের গুরুত্ব উপলব্ধির ক্ষেত্রে উদাসীন থাকলে তার ফল কিন্তু মারাত্মক ।

এখানে উল্লেখ্য , ২০০২ সালেই ইউরোপিয়ান সোসাইটি অফ ল্যারিঙ্গোলজি বিশ্ব কণ্ঠ দিবস উদযাপনের উদ্যোগকে সমর্থন জানায় । এরা সারা বিশ্বে কণ্ঠস্বরের যত্ন এবং কণ্ঠস্বর ভঙ্গের প্রতিরোধ ও প্রতিকারে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে । যাঁরা প্রফেশনাল ভয়েস ইউজার , তাঁদের সতর্ক করা ছাড়াও কণ্ঠস্বর ধ্বস্ত বা নষ্ট হয়ে গেলে তার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করাও এই সংগঠনটির একটি জরুরি কাজ ।

একটি শিশুর পৃথিবীতে আসামাত্রই তার প্রথম শব্দ কান্না । কান্না দিয়ে তার আগমন । তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই কান্নাকে সুস্থ শিশুর লক্ষণ বলে ধরা হয় । তারপর মা-বাবা ও বাড়ির আর সকলের কথা অনুসরণ করে শিশুটি কথা বলতে শেখে । বাল্যকাল থেকেই যদি শিশুটির সার্বিক বিকাশে যত্ন নেওয়া হয় , তাহলে সে একটি সুস্থ ও সুন্দর স্বরযন্ত্র পায় । সুকণ্ঠের অধিকারী হয় । তাই কণ্ঠস্বরের লালন পালন অতীব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ ।

Lift your voice বা শানিত ও উচ্চকিত হোক আপনার কণ্ঠস্বর , এই প্রতিপাদ্যটিও কণ্ঠ তৈরি তথা কণ্ঠের ব্যবহার ও দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ । কণ্ঠস্বরের গুণগত মান বৃদ্ধিও জরুরি ।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিপাদ্য , be kind with your voice , কণ্ঠ তো শুধু যোগাযোগের উপায়মাত্র নয় , তার চেয়েও অনেক বেশি । বাক্যের ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে কণ্ঠের ওঠানামা , ইংরেজিতে যা মড্যুলেশন , খুবই গুরুত্বপূর্ণ এইজন্যই যে , এর ওপরেই নির্ভর করে আপনার কথার প্রভাব কার ওপরে কতটা পড়বে । স্বরক্ষেপণের কৌশল আয়ত্ব করা সহজ নয় । এটি রীতিমতো শিক্ষনীয় । উকিল , ধারাভাষ্যকার , সেলসম্যান এবং কলসেন্টারের কর্মীদেরও ভালো কথা বলতে পারার দক্ষতা প্রয়োজন ।

আরও পড়ুন- রেলে বিশেষ ভাবে সক্ষমদের জন্য সংরক্ষিত আসনের কোটায় পরিবর্তন

কণ্ঠনালির প্রদাহ দু’ধরনের । যেমন , তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস । ভাইরাসজনিত , আবহাওয়া পরিবর্তন , পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি নানা কারণে এই প্রদাহ হতে পারে । ব্যাকটিরিয়ার কারণেও কণ্ঠনালির ইনফেকশন হতে পারে । পাকস্থলীর অ্যাসিড রিফ্লাক্সের জন্যও এই প্রদাহ হয় ‌। অতিরিক্ত চা ও ধূমপান , হাঁপানির জন্য ইনহেলার ব্যবহার ইত্যাদির জন্যেও দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস হতে পারে । এছাড়া যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারাও এই প্রদাহের কবলে পড়তে পারে । চিৎকার করে কথা বলা , অতিরিক্ত কথা বলা এবং পরিবর্তিত স্বরে কথা বললে কন্ঠস্বরের প্রদাহ হতে পারে।

সবার আগে দরকার সচেতনতা । কণ্ঠের অতি ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে । চাই কণ্ঠের পর্যাপ্ত বিশ্রাম । পরিচ্ছন্ন কণ্ঠের অধিকারী হতে হলে নেশামুক্ত হওয়া জরুরি । শুষ্ক আবহাওয়াও কণ্ঠের ক্ষতি করে । পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খেতে হবে । ‘ সুস্থ কণ্ঠের গুরুত্ব অপরিসীম ‘ , এই আপ্তবাক্যটি মাথায় রেখে কণ্ঠস্বরের যথাযথ পরিচর্যা ক’রে চললে শব্দ ও সুরের জোগানে কোনো কার্পণ্য রাখবে না প্রকৃতি , একথা অবশ্যই বলা যায় ।

 

 

 

spot_img

Related articles

ধরমশালা থেকে সরতে পারে পঞ্জাব কিংস বনাম মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ম্যাচ

ভারত – পাকিস্তান(INDvPAK) অশান্তির জেরে এবার বদল হতে পারে আইপিএলের(IPL) ভেন্যুও। আগামী ১১ মে পঞ্জাব কিংস বনাম মুম্বই...

রাষ্ট্রসঙ্ঘের দফতরের বাইরে পাক মিসাইল! প্রত্যাঘাতে ১১ ভারতীয় হত্য়া

অপারেশন সিন্দুর সফল করার পরই পাকিস্তানের প্রত্যাঘাতের আশঙ্কায় একাধিক বৈঠক চলছে ভারতে। অন্যদিকে পাকিস্তানও সীমান্তে আঘাতের পরিমাণ বাড়িয়ে...

২৮ সদস্যের সম্ভাব্য দল ঘোষণা ভারতের, প্রস্তুতি হবে কলকাতায়

ভারতীয় দলে(Indian Football Team) এবার মোহনবাগানের(MBSG) আরও এক ফুটবলর। এএফসি এশিয়ান কাপের(AFC Asian Cuo) যোগ্যতা অর্জন পর্বের জন্য...

বিকেলের পর থেকে দক্ষিণবঙ্গের জেলায় জেলায় বৃষ্টির পূর্বাভাস!

সকালে গরমের দাবদাহ কাটিয়ে বুধের বিকেলেই বৃষ্টি ভেজার সম্ভাবনা রয়েছে দক্ষিণবঙ্গবাসীর। আলিপুর হাওয়া অফিস (Alipore Weather Department) জানিয়েছে...