‘যদি কণ্ঠ দাও’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

শব্দ অমৃতকুম্ভ শব্দই বিষ

কখনো কথামৃত
কখনো খরিস ।

কথায় আছে , ‘ শব্দব্রক্ষ্ম ‘ । শব্দ সর্বত্রগামী । মানুষকে আলোড়িত ও প্রভাবিত করার সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম । কখনো হাতিয়ার , কখনও বা শুশ্রূষা । কিন্তু মানবদেহের যে বিশেষ অঙ্গের মাধ্যমে শব্দ ‘ ব্রক্ষ্ম ‘ হয়ে ওঠে , তা হলো কণ্ঠ । কণ্ঠ ছাড়া শব্দের প্রকাশ কোথায় ?

পণ্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ লিখেছেন : যদি কণ্ঠ দাও আমি তোমার গাহি গান …

গান তো বটেই , কথা বলতে গেলেও কণ্ঠ চাই । কিন্তু কণ্ঠ ধরে রাখা , অর্থাৎ বাঁচিয়ে রাখা কি খুব সহজ কাজ ? মোটেও নয় । যত্নের অভাবে , পরিচর্যার অভাবে প্রকৃতিদত্ত কণ্ঠ যখন তখন রুদ্ধ হয়ে যেতে পারে , এমনকি স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে । তাই , কণ্ঠের যত্ন নিতে হয় প্রতিমুহূর্তে , কণ্ঠের লালন-পালন অবশ্য পালনীয় কর্তব্য । সারা বিশ্বের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে কণ্ঠের গুরুত্ব অপরিসীম । আর এখানেই অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে বিশ্ব কণ্ঠ দিবস ।

আজ ১৬ এপ্রিল , বিশ্ব কণ্ঠ দিবস । এই দিবসটির মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হলো মানবজাতির দৈনন্দিন জীবনে কণ্ঠস্বরের বিশাল গুরুত্ব অনুধাবন করা । ১৯৯৯ সালে ডাঃ নেডিও স্টেফেনের সভাপতিত্বে ব্রাজিলিয়ান সোসাইটি অফ ল্যারিঙ্গোলজি এন্ড ভয়েস প্রথম ১৬ এপ্রিল দিনটিকে ব্রাজিলিয়ান ভয়েস ডে হিসেবে উদযাপন করে । পরবর্তীকালে , ২০০২ সালে আমেরিকান একাডেমি অফ ওটোলারিঙ্গোলজিস্ট-হেড এবং নেক সার্জারি এই দিনটি উদযাপন করা শুরু করলে এটি ‘ বিশ্ব ভয়েস দিবস ‘ হিসেবে স্বীকৃত হয় ।

কণ্ঠ ও কণ্ঠনালির সমস্যা এবং কণ্ঠকে সুস্থ রাখার উপায় সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিই এই দিবসটির মূল উদ্দেশ্য । মূল বিষয়টিকে অবিকৃত রেখেই প্রতিবছর থিমস্লোগান বা প্রতিপাদ্য পাল্টায় । যেমন , মেক দ্য ভয়েস টু চেরিস ইওর ভয়েস । এক বিশ্ব অনেক ভয়েস ।

বিভিন্ন দেশে কোটি কোটি মানুষ কণ্ঠের নানা সমস্যায় ভোগেন । এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হন স্বরভঙ্গের সমস্যায় । এছাড়া গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও কম নয় । গলাবসা বা কণ্ঠস্বর ভাঙার অন্যতম প্রধান কারণ হলো শ্বাসনালির সংক্রমণ । সাধারণ ঠাণ্ডায় বা দীর্ঘক্ষণ জোরে কথা বললেও গলা ভাঙতে পারে । এতে গলার স্বর বসে যায় , গলা ফ্যাঁসফ্যাঁস করে , ফাটা আওয়াজ বেরোতে থাকে । ধূমপান থেকে দূরে থাকাই শ্রেয় । যে কোনো নেশাই গলার ক্ষতি করে । থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যাতেও অনেক সময় স্বরভঙ্গ হয় । ভোকাল কর্ড বা স্নায়ু কোনোভাবে জখম হলেও গলা বসে যেতে পারে । কণ্ঠ যাঁদের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে যুক্ত , যেমন , গায়ক , অভিনেতা , শিক্ষক , বাগ্মী , এঁদের প্রয়োজন কণ্ঠের পর্যাপ্ত বিশ্রাম ।

ডেসিবলের যে নির্দিষ্ট সূচক মেনে কথা বললে গলার কোনো ক্ষতি হয় না , সেটি অধিকাংশ মানুষেরই মনে থাকে না । যে নির্দিষ্ট উচ্চগ্রামে বা স্কেল-এ কথা বললে বা গান গাইলে কণ্ঠ আরাম ও স্বাচ্ছন্দ পায় , তা বেশিরভাগ সময়েই মানা হয় না । ফলে কণ্ঠের ক্ষমতার অপব্যবহার তো হয়ই , একইসঙ্গে অপচয়ও হয় । আজকের এই অত্যাধুনিক যুগের চাপা উদ্বেগ ও অতিরিক্ত পরিশ্রমেও কণ্ঠ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।

মানুষ একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রধানত কণ্ঠের মাধ্যমে । হাসিকান্না , গান গাওয়া , প্রতিবাদ , চিৎকার করে আবেগ প্রকাশ ইত্যাদি সবরকমের মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রেই আমাদের কণ্ঠস্বরের বিশাল ভূমিকা রয়েছে । যাঁরা কথা বলতে পারেন না তাঁরা ভীষণ কষ্টে থাকেন । কণ্ঠের গুরুত্ব উপলব্ধির ক্ষেত্রে উদাসীন থাকলে তার ফল কিন্তু মারাত্মক ।

এখানে উল্লেখ্য , ২০০২ সালেই ইউরোপিয়ান সোসাইটি অফ ল্যারিঙ্গোলজি বিশ্ব কণ্ঠ দিবস উদযাপনের উদ্যোগকে সমর্থন জানায় । এরা সারা বিশ্বে কণ্ঠস্বরের যত্ন এবং কণ্ঠস্বর ভঙ্গের প্রতিরোধ ও প্রতিকারে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে । যাঁরা প্রফেশনাল ভয়েস ইউজার , তাঁদের সতর্ক করা ছাড়াও কণ্ঠস্বর ধ্বস্ত বা নষ্ট হয়ে গেলে তার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করাও এই সংগঠনটির একটি জরুরি কাজ ।

একটি শিশুর পৃথিবীতে আসামাত্রই তার প্রথম শব্দ কান্না । কান্না দিয়ে তার আগমন । তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে এই কান্নাকে সুস্থ শিশুর লক্ষণ বলে ধরা হয় । তারপর মা-বাবা ও বাড়ির আর সকলের কথা অনুসরণ করে শিশুটি কথা বলতে শেখে । বাল্যকাল থেকেই যদি শিশুটির সার্বিক বিকাশে যত্ন নেওয়া হয় , তাহলে সে একটি সুস্থ ও সুন্দর স্বরযন্ত্র পায় । সুকণ্ঠের অধিকারী হয় । তাই কণ্ঠস্বরের লালন পালন অতীব জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ ।

Lift your voice বা শানিত ও উচ্চকিত হোক আপনার কণ্ঠস্বর , এই প্রতিপাদ্যটিও কণ্ঠ তৈরি তথা কণ্ঠের ব্যবহার ও দক্ষতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ । কণ্ঠস্বরের গুণগত মান বৃদ্ধিও জরুরি ।

আরেকটি উল্লেখযোগ্য প্রতিপাদ্য , be kind with your voice , কণ্ঠ তো শুধু যোগাযোগের উপায়মাত্র নয় , তার চেয়েও অনেক বেশি । বাক্যের ভাবপ্রকাশের ক্ষেত্রে কণ্ঠের ওঠানামা , ইংরেজিতে যা মড্যুলেশন , খুবই গুরুত্বপূর্ণ এইজন্যই যে , এর ওপরেই নির্ভর করে আপনার কথার প্রভাব কার ওপরে কতটা পড়বে । স্বরক্ষেপণের কৌশল আয়ত্ব করা সহজ নয় । এটি রীতিমতো শিক্ষনীয় । উকিল , ধারাভাষ্যকার , সেলসম্যান এবং কলসেন্টারের কর্মীদেরও ভালো কথা বলতে পারার দক্ষতা প্রয়োজন ।

আরও পড়ুন- রেলে বিশেষ ভাবে সক্ষমদের জন্য সংরক্ষিত আসনের কোটায় পরিবর্তন

কণ্ঠনালির প্রদাহ দু’ধরনের । যেমন , তীব্র ও দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস । ভাইরাসজনিত , আবহাওয়া পরিবর্তন , পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি নানা কারণে এই প্রদাহ হতে পারে । ব্যাকটিরিয়ার কারণেও কণ্ঠনালির ইনফেকশন হতে পারে । পাকস্থলীর অ্যাসিড রিফ্লাক্সের জন্যও এই প্রদাহ হয় ‌। অতিরিক্ত চা ও ধূমপান , হাঁপানির জন্য ইনহেলার ব্যবহার ইত্যাদির জন্যেও দীর্ঘমেয়াদি ল্যারিনজাইটিস হতে পারে । এছাড়া যাদের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তারাও এই প্রদাহের কবলে পড়তে পারে । চিৎকার করে কথা বলা , অতিরিক্ত কথা বলা এবং পরিবর্তিত স্বরে কথা বললে কন্ঠস্বরের প্রদাহ হতে পারে।

সবার আগে দরকার সচেতনতা । কণ্ঠের অতি ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে । চাই কণ্ঠের পর্যাপ্ত বিশ্রাম । পরিচ্ছন্ন কণ্ঠের অধিকারী হতে হলে নেশামুক্ত হওয়া জরুরি । শুষ্ক আবহাওয়াও কণ্ঠের ক্ষতি করে । পর্যাপ্ত পরিমাণে জল খেতে হবে । ‘ সুস্থ কণ্ঠের গুরুত্ব অপরিসীম ‘ , এই আপ্তবাক্যটি মাথায় রেখে কণ্ঠস্বরের যথাযথ পরিচর্যা ক’রে চললে শব্দ ও সুরের জোগানে কোনো কার্পণ্য রাখবে না প্রকৃতি , একথা অবশ্যই বলা যায় ।

 

 

 

Previous articleআজ ওয়াংখেড়েতে নামছে কেকেআর, মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে জয় লক্ষ‍্য নীতীশদের
Next articleযোগীরাজে আইনশৃঙ্খলার মৃত্যু উত্তর প্রদেশে: আতিক খুনে সুর চড়ালো বিরোধীরা