Thursday, December 25, 2025

‘মৌমাছির মধুগান’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

যারা মৌমাছির জীবন পর্যবেক্ষণ করে তারা কখনোই ব্যর্থতায় ভেঙে পড়ে না । মৌমাছি মানেই নতুন উদ্যমে শূন্য থেকে শুরু , মৌমাছি মানেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোনোর লড়াই । হতে পারে ক্ষুদ্র , কিন্তু প্রজ্ঞার মূর্ত প্রতীক । কঠোর জীবন সংগ্রাম ও গভীর কর্মসাধনায় সর্বদা লিপ্ত মৌমাছির অসীম প্রভাব আমাদের প্রকৃতিতে । পরিশ্রম , সততার অন্বেষণ , সহযোগিতা , সহমর্মিতা ও জীবনের মাধুর্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে মৌমাছির জীবনকাল সতত স্মরণীয় । উৎসর্গ , লক্ষ্যের প্রতি নিবিষ্টতা , একাগ্রতা , নিয়মানুবর্তিতা , দলবদ্ধতা , ঔদার্য , সমৃদ্ধি ও উর্বরতার উজ্জ্বল উদাহরণ মৌমাছি ।

মৌমাছি, মৌমাছি
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াও না একবার ভাই ।

ওই ফুল ফোটে বনে
যাই মধু আহরণে
দাঁড়াবার সময় তো নাই ।

দাঁড়াবার সময় কোথায় মৌমাছির ? সে তো সদাব্যস্ত ।
একটি মধু মৌমাছির নিজস্ব উপনিবেশে সাধারণত তিন ধরনের প্রাপ্তবয়স্ক মৌমাছি থাকে । শ্রমিক , ড্রোন এবং একটি রাণি । একটি রাণি মৌমাছি হলো মৌচাকের একমাত্র স্ত্রী মৌমাছি যা প্রজনন করতে পারে । শ্রমিক মৌমাছিরা সকলেই স্ত্রী এবং সকলেই রাণির সন্তান । ড্রোন মৌমাছি পুরুষ এবং তাদের হুল নেই । মৌমাছিরা নাচের ছন্দ ব্যবহার ক’রে খাদ্যের উৎস সম্পর্কে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করে । শ্রমিক বা কর্মী মৌমাছিদের শারীরবৃত্তীয় এবং জেনেটিক কারণে নারী হিসেবে বিবেচনা করা হয় । একটি পুরুষ ড্রোনের দ্বারা রাণি মৌমাছি নিষিক্ত হয় । মিলনের পর পুরুষ মধু মৌমাছি রাণির থেকে দূরে সরে গেলেও তার এন্ডোফ্যালাস তার শরীর থেকে ছিঁড়ে যায় , সদ্য নিষিক্ত রাণির দেহে সংযুক্ত থাকে ।

মৌমাছি বা মধুকর বা মধুমক্ষিকা বোলতা ও পিঁপড়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত মধু সংগ্রহকারী
পতঙ্গবিশেষ । মধু ও মোম উৎপাদন এবং ফুলের পরাগায়নের জন্য প্রসিদ্ধ । পৃথিবীতে ৯ টি স্বীকৃত গোত্রের অধীনে প্রায় ২০০০০ মৌমাছি প্রজাতি আছে । আন্টার্কটিকা ব্যতিত পৃথিবীর সকল মহাদেশে যেখানেই পতঙ্গ পরাগায়িত সপুষ্পক উদ্ভিদ আছে সেখানেই মৌমাছি আছে । ভারতে সচরাচর যে মৌমাছি দেখা যায় তার বৈজ্ঞানিক নাম এপিস ইন্ডিকা । পরিবারের বোলতারা হলো এদের পূর্বপুরুষ , যারা ছিল পতঙ্গ শিকারি । বোলতা বিবর্তিত হয়ে এসেছে মৌমাছি । এদের দেহ ত্রিখন্ডিত । এদের দু’জোড়া ডানা রয়েছে । দেহের মাপ এক থেকে দেড় সেন্টিমিটার । এরা সমাজবদ্ধ ও পারিবারিক । রাণি মৌমাছি উর্বর এবং কর্মী মৌমাছি বন্ধ্যা । রাণি মৌমাছি বাঁচে তিন থেকে পাঁচ বছর । শ্রমিক মৌমাছিরা বাঁচে দেড় বছর বা তার চেয়ে কয়েক মাস বেশি । মৌমাছির চাকের গঠন সাধারনত ষড়ভূজাকার হওয়ায় গবেষকেরা ভাবতেন এরা বুঝি জ্যামিতি জানে ! গবেষণায় মৌমাছিদের বুদ্ধিমত্তার যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে আশ্চর্য হতে হয় । এদের যোগ , বিয়োগ , গুণ ও ভাগের বোধ আছে ব’লে মনে করা হয় ।

প্রস্ফুটিত ফুলের মকরন্দ অথবা ক্ষরণ কিংবা ফুল ব্যতিত গাছের অপর কোনো জীবিত অংশ থেকে মৌমাছিদের সংগৃহীত , রূপান্তরিত অথবা নিজেদের ক্ষরিত পদার্থের মিশ্রিত , সঞ্চিত অথবা পরিণত হবার জন্য মৌচাকে মজুত রাখা তরল , সান্দ্র অথবা কেলাসিত পদার্থ হলো মধু । মৌচাক তৈরি হয় মোমজাতীয় পদার্থ দিয়ে । ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ষড়ভূজাকার প্রকোষ্ঠগুলিতে এরা সঞ্চিত মধু রাখে । ফাঁকা প্রকোষ্ঠে মৌমাছি ডিম পাড়ে , লার্ভা ও পিউপা সংরক্ষণ করে । মৌমাছি ‌নিজেই দেহাভ্যন্তরে মোম তৈরি করে ।

মৌমাছির হুল ফোটানো বিষ খুব যন্ত্রণাদায়ক হলেও হুল থেকে সংগৃহীত বিষ রোগ নিরাময়ের উপাদান হিসেবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ । মৌমাছির বিষে সাধারণত মিথানয়িক এসিড বা ফর্মিক এসিড থাকে যা বাতের ব্যথার নিরাময়ে প্রদাহ নিরোধক ওষুধে প্রয়োগ করা হয় । ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর সময় মৌমাছি তাদের পা এবং বুকের সাহায্যে ফুলের অসংখ্য পরাগরেণু বয়ে বেড়ায় । এক ফুলের পরাগরেণু অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ডে পড়লে পরাগায়ন ঘটে , যার ফলে উৎপন্ন হয় ফল । ফল ও ফসলের উৎপাদনে তাই মৌমাছির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এক একটা মৌচাকে ৩০-৪০ হাজার থেকে ৫০-৬০ হাজার মৌমাছি বসবাস করে । এদের দৈনন্দিন কাজে বুদ্ধিমত্তা ও শৃঙ্খলার সমন্বয় দেখলে অবাক হতে হয় । এরা খুব কমই ঝগড়াঝাঁটি করে । ব্যক্তিগত সুখসুবিধা উপেক্ষা ক’রে নিজেদের সমাজের সার্বিক মঙ্গলের স্বার্থে এরা দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে এবং প্রয়োজনে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতেও বিন্দুমাত্র ইতস্তত করে না । সারা শীতকাল এরা সঞ্চিত মধুর উপর নির্ভর ক’রে অনেকটা নিশ্চেষ্টভাবে কাটানোর পর বসন্তের আবির্ভাব থেকে যেভাবে মধু আহরণ , চাক নির্মাণ , বাচ্চা প্রতিপালন , বাসার আবর্জনা পরিষ্কার এবং শত্রু প্রতিরোধের কাজে এরা ব্যাপৃত থাকে তা সত্যিই বিস্ময়কর । এদের কাজের নির্দিষ্ট শ্রেণীবিভাগ করা থাকে । যার যা কাজ , সে যেন তা যন্ত্রের মতো ক’রে চলে কনামাত্র ক্লান্তি ও অবসাদ ছাড়া বিরামহীনভাবে । কোনো কারণে অক্ষম এবং দুর্বল না হয়ে পড়া পর্যন্ত এরা কর্মবিরতি দেয় না । রাণিকে ঘিরেই এদের সমাজ । মক্ষিরাণি শব্দের আমদানি সম্ভবত এখান থেকেই ।

এই মৌমাছিদের ঘরছাড়া
কে করেছে রে
তোরা আমায় ব’লে দে ভাই ,
ব’লে দে রে ।।

মৌমাছিদের ঘরছাড়া করলে কিন্তু মানুষের সমূহ বিপদের আশঙ্কা । মৌমাছিদের থাকতে দিতে হবে আপন মনে । বিশ্বে ১০০ রকমের ফল , আর ৯০ ভাগ খাদ্যশষ্যেরই পরাগায়ন ঘটে মৌমাছির সাহায্যে । ফলে মৌমাছি না থাকলে কমে যাবে ফসল ও ফলমূল । দেখা দেবে খাদ্যসঙ্কট । তাই মানুষকে যদি বাঁচতে হয় তাহলে বাঁচিয়ে রাখতে হবে মৌমাছিদের । এইমুহুর্তে ধারাবাহিকভাবে মৌমাছি সংরক্ষণ ভীষণ জরুরি । চাই স্থায়ীভাবে মৌমাছি প্রতিপালন । মানুষের অতিরিক্ত লোভের কারণেই বিপন্ন মৌমাছির দল । মানুষকে মনে রাখতে হবে , মৌমাছি বিলুপ্ত হ’লে বিপদে পড়বে মানবসভ্যতা ।

আরও পড়ুন- ‘ধমকে-চমকে আমাকে আটকানো যাবে না’, এজেন্সির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন অভিষেক

spot_img

Related articles

ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর জন্মবার্ষিকীতে মুখ্যমন্ত্রীর শ্রদ্ধাজ্ঞাপন

২৫শে ডিসেম্বর ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর (Atal Bihari Bajpeyee) জন্মবার্ষিকী আর সেই উপলক্ষে নিজের সোশ্যাল হ্যান্ডেলে...

১৭ বছর পর বাংলাদেশে ফিরলেন খালেদাপুত্র, তারেককে ঘিরে উচ্ছ্বাস-বিএনপি সমর্থকদের

বাংলাদেশের ফিরলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান (Tarique Rahman returns in Bangladesh)। বৃহস্পতি সকালেই তিনি সিলেট...

এক দশক পর শীতলতম বড়দিন পেল বাংলা!

যিশু জন্মদিনের সকালে (Christmas morning) কলকাতার তাপমাত্রা (Kolkata temperature) নামলো ১৩.৭ ডিগ্রিতে। শীতের আমেজে জমজমাট বড়দিনের আবহাওয়া। দক্ষিণবঙ্গে...

মধ্যরাতে কর্নাটকের ট্রাক-বাসের ভয়াবহ সংঘর্ষে ঝলসে মৃত্যু অন্তত ১০ জনের

বড়দিনে ভয়াবহ দুর্ঘটনা কর্নাটকে। বেসরকারি একটি বাসের সঙ্গে ট্রাকের সংঘর্ষের (bus truck accident) ফলে বাসে আগুন ধরে যাওয়ায়...