‘মৌমাছির মধুগান’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

যারা মৌমাছির জীবন পর্যবেক্ষণ করে তারা কখনোই ব্যর্থতায় ভেঙে পড়ে না । মৌমাছি মানেই নতুন উদ্যমে শূন্য থেকে শুরু , মৌমাছি মানেই নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোনোর লড়াই । হতে পারে ক্ষুদ্র , কিন্তু প্রজ্ঞার মূর্ত প্রতীক । কঠোর জীবন সংগ্রাম ও গভীর কর্মসাধনায় সর্বদা লিপ্ত মৌমাছির অসীম প্রভাব আমাদের প্রকৃতিতে । পরিশ্রম , সততার অন্বেষণ , সহযোগিতা , সহমর্মিতা ও জীবনের মাধুর্য উপলব্ধির ক্ষেত্রে মৌমাছির জীবনকাল সতত স্মরণীয় । উৎসর্গ , লক্ষ্যের প্রতি নিবিষ্টতা , একাগ্রতা , নিয়মানুবর্তিতা , দলবদ্ধতা , ঔদার্য , সমৃদ্ধি ও উর্বরতার উজ্জ্বল উদাহরণ মৌমাছি ।

মৌমাছি, মৌমাছি
কোথা যাও নাচি নাচি
দাঁড়াও না একবার ভাই ।

ওই ফুল ফোটে বনে
যাই মধু আহরণে
দাঁড়াবার সময় তো নাই ।

দাঁড়াবার সময় কোথায় মৌমাছির ? সে তো সদাব্যস্ত ।
একটি মধু মৌমাছির নিজস্ব উপনিবেশে সাধারণত তিন ধরনের প্রাপ্তবয়স্ক মৌমাছি থাকে । শ্রমিক , ড্রোন এবং একটি রাণি । একটি রাণি মৌমাছি হলো মৌচাকের একমাত্র স্ত্রী মৌমাছি যা প্রজনন করতে পারে । শ্রমিক মৌমাছিরা সকলেই স্ত্রী এবং সকলেই রাণির সন্তান । ড্রোন মৌমাছি পুরুষ এবং তাদের হুল নেই । মৌমাছিরা নাচের ছন্দ ব্যবহার ক’রে খাদ্যের উৎস সম্পর্কে পারস্পরিক যোগাযোগ রক্ষা করে । শ্রমিক বা কর্মী মৌমাছিদের শারীরবৃত্তীয় এবং জেনেটিক কারণে নারী হিসেবে বিবেচনা করা হয় । একটি পুরুষ ড্রোনের দ্বারা রাণি মৌমাছি নিষিক্ত হয় । মিলনের পর পুরুষ মধু মৌমাছি রাণির থেকে দূরে সরে গেলেও তার এন্ডোফ্যালাস তার শরীর থেকে ছিঁড়ে যায় , সদ্য নিষিক্ত রাণির দেহে সংযুক্ত থাকে ।

মৌমাছি বা মধুকর বা মধুমক্ষিকা বোলতা ও পিঁপড়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত মধু সংগ্রহকারী
পতঙ্গবিশেষ । মধু ও মোম উৎপাদন এবং ফুলের পরাগায়নের জন্য প্রসিদ্ধ । পৃথিবীতে ৯ টি স্বীকৃত গোত্রের অধীনে প্রায় ২০০০০ মৌমাছি প্রজাতি আছে । আন্টার্কটিকা ব্যতিত পৃথিবীর সকল মহাদেশে যেখানেই পতঙ্গ পরাগায়িত সপুষ্পক উদ্ভিদ আছে সেখানেই মৌমাছি আছে । ভারতে সচরাচর যে মৌমাছি দেখা যায় তার বৈজ্ঞানিক নাম এপিস ইন্ডিকা । পরিবারের বোলতারা হলো এদের পূর্বপুরুষ , যারা ছিল পতঙ্গ শিকারি । বোলতা বিবর্তিত হয়ে এসেছে মৌমাছি । এদের দেহ ত্রিখন্ডিত । এদের দু’জোড়া ডানা রয়েছে । দেহের মাপ এক থেকে দেড় সেন্টিমিটার । এরা সমাজবদ্ধ ও পারিবারিক । রাণি মৌমাছি উর্বর এবং কর্মী মৌমাছি বন্ধ্যা । রাণি মৌমাছি বাঁচে তিন থেকে পাঁচ বছর । শ্রমিক মৌমাছিরা বাঁচে দেড় বছর বা তার চেয়ে কয়েক মাস বেশি । মৌমাছির চাকের গঠন সাধারনত ষড়ভূজাকার হওয়ায় গবেষকেরা ভাবতেন এরা বুঝি জ্যামিতি জানে ! গবেষণায় মৌমাছিদের বুদ্ধিমত্তার যে পরিচয় পাওয়া যায় তাতে আশ্চর্য হতে হয় । এদের যোগ , বিয়োগ , গুণ ও ভাগের বোধ আছে ব’লে মনে করা হয় ।

প্রস্ফুটিত ফুলের মকরন্দ অথবা ক্ষরণ কিংবা ফুল ব্যতিত গাছের অপর কোনো জীবিত অংশ থেকে মৌমাছিদের সংগৃহীত , রূপান্তরিত অথবা নিজেদের ক্ষরিত পদার্থের মিশ্রিত , সঞ্চিত অথবা পরিণত হবার জন্য মৌচাকে মজুত রাখা তরল , সান্দ্র অথবা কেলাসিত পদার্থ হলো মধু । মৌচাক তৈরি হয় মোমজাতীয় পদার্থ দিয়ে । ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ষড়ভূজাকার প্রকোষ্ঠগুলিতে এরা সঞ্চিত মধু রাখে । ফাঁকা প্রকোষ্ঠে মৌমাছি ডিম পাড়ে , লার্ভা ও পিউপা সংরক্ষণ করে । মৌমাছি ‌নিজেই দেহাভ্যন্তরে মোম তৈরি করে ।

মৌমাছির হুল ফোটানো বিষ খুব যন্ত্রণাদায়ক হলেও হুল থেকে সংগৃহীত বিষ রোগ নিরাময়ের উপাদান হিসেবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ । মৌমাছির বিষে সাধারণত মিথানয়িক এসিড বা ফর্মিক এসিড থাকে যা বাতের ব্যথার নিরাময়ে প্রদাহ নিরোধক ওষুধে প্রয়োগ করা হয় । ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর সময় মৌমাছি তাদের পা এবং বুকের সাহায্যে ফুলের অসংখ্য পরাগরেণু বয়ে বেড়ায় । এক ফুলের পরাগরেণু অন্য ফুলের গর্ভমুণ্ডে পড়লে পরাগায়ন ঘটে , যার ফলে উৎপন্ন হয় ফল । ফল ও ফসলের উৎপাদনে তাই মৌমাছির ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ । এক একটা মৌচাকে ৩০-৪০ হাজার থেকে ৫০-৬০ হাজার মৌমাছি বসবাস করে । এদের দৈনন্দিন কাজে বুদ্ধিমত্তা ও শৃঙ্খলার সমন্বয় দেখলে অবাক হতে হয় । এরা খুব কমই ঝগড়াঝাঁটি করে । ব্যক্তিগত সুখসুবিধা উপেক্ষা ক’রে নিজেদের সমাজের সার্বিক মঙ্গলের স্বার্থে এরা দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করে এবং প্রয়োজনে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিতেও বিন্দুমাত্র ইতস্তত করে না । সারা শীতকাল এরা সঞ্চিত মধুর উপর নির্ভর ক’রে অনেকটা নিশ্চেষ্টভাবে কাটানোর পর বসন্তের আবির্ভাব থেকে যেভাবে মধু আহরণ , চাক নির্মাণ , বাচ্চা প্রতিপালন , বাসার আবর্জনা পরিষ্কার এবং শত্রু প্রতিরোধের কাজে এরা ব্যাপৃত থাকে তা সত্যিই বিস্ময়কর । এদের কাজের নির্দিষ্ট শ্রেণীবিভাগ করা থাকে । যার যা কাজ , সে যেন তা যন্ত্রের মতো ক’রে চলে কনামাত্র ক্লান্তি ও অবসাদ ছাড়া বিরামহীনভাবে । কোনো কারণে অক্ষম এবং দুর্বল না হয়ে পড়া পর্যন্ত এরা কর্মবিরতি দেয় না । রাণিকে ঘিরেই এদের সমাজ । মক্ষিরাণি শব্দের আমদানি সম্ভবত এখান থেকেই ।

এই মৌমাছিদের ঘরছাড়া
কে করেছে রে
তোরা আমায় ব’লে দে ভাই ,
ব’লে দে রে ।।

মৌমাছিদের ঘরছাড়া করলে কিন্তু মানুষের সমূহ বিপদের আশঙ্কা । মৌমাছিদের থাকতে দিতে হবে আপন মনে । বিশ্বে ১০০ রকমের ফল , আর ৯০ ভাগ খাদ্যশষ্যেরই পরাগায়ন ঘটে মৌমাছির সাহায্যে । ফলে মৌমাছি না থাকলে কমে যাবে ফসল ও ফলমূল । দেখা দেবে খাদ্যসঙ্কট । তাই মানুষকে যদি বাঁচতে হয় তাহলে বাঁচিয়ে রাখতে হবে মৌমাছিদের । এইমুহুর্তে ধারাবাহিকভাবে মৌমাছি সংরক্ষণ ভীষণ জরুরি । চাই স্থায়ীভাবে মৌমাছি প্রতিপালন । মানুষের অতিরিক্ত লোভের কারণেই বিপন্ন মৌমাছির দল । মানুষকে মনে রাখতে হবে , মৌমাছি বিলুপ্ত হ’লে বিপদে পড়বে মানবসভ্যতা ।

আরও পড়ুন- ‘ধমকে-চমকে আমাকে আটকানো যাবে না’, এজেন্সির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন অভিষেক

Previous articleআশা শেষ কলকাতার, লখনৌর কাছে হারল ১ রানে
Next articleকাপলিং খুলে বিপত্তি!বড় দু*র্ঘটনা এড়াল হাওড়া-পুরী এক্সপ্রেস