Wednesday, November 5, 2025

‘মৃত্যুতেই অমর মোলয়েজ’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

‘ আগুনের হাত ধরে

শহীদ মোলয়েজ

বিশ্বময় স্বাধীন পাখি
করছে পারাপার । ‘

কি লিখেছিলেন কবি বেঞ্জামিন ? দেশের নৃশংস অপশাসকদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া এই অবিস্মরণীয় কবি ফাঁসির আগের কয়েকদিন কীভাবে কাটিয়েছিলেন ? ১৯৫৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার আলেকজান্দ্রায় জন্ম বেঞ্জামিন মোলয়েজের । মৃত্যু প্রিটোরিয়ায় ১৮ অক্টোবর ১৯৮৫-তে । মাত্র ৩০ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে প্রায় ৩০০ বছরের কাজ কীভাবে করে গেলেন ক্ষণজন্মা মোলয়েজ ?

‘ যে বয়সে পুরুষ ভালোবাসে নারীকে , সে বয়সে তুমি ভালোবেসেছিলে তোমার মাতৃভূমি , দক্ষিণ আফ্রিকাকে ; যে বয়সে পুরুষ প্রার্থনা করে প্রেয়সীর বরমাল্য , সে বয়সে তোমার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়েছে ফাঁসির রজ্জুতে । যে বয়সে পুরুষের গ্রীবা আকাঙ্ক্ষা করে রমণীয় কোমল বাহুর ব্যগ্র-মুগ্ধ আলিঙ্গন ; সে বয়সে তোমাকে আলিঙ্গন করেছে মৃত্যুর হিমশীতল বাহু । ‘

কালো আফ্রিকার শ্বেত-শত্রুদের বিরুদ্ধে ঘৃণাগ্নি নিক্ষেপ করে হাসতে হাসতে মোলয়েজ এগিয়ে যান মৃত্যুর দিকে । মনে পড়ে , ‘ একটাই জীবন , জন্মভূমি , তোমাকে দিলাম । ‘ শৃঙ্খলিত মাতৃভূমির জয়গান গেয়ে অকালে কালের হাত ধরলেন দুরন্ত বিদ্রোহী ।

মোলয়েজ একাধারে কবি , কারখানার শ্রমিক , রাজনৈতিক কর্মী এবং তৎকালীন নিষিদ্ধ আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের অনুসারী । ১৯৮২ সালে একজন পুলিশ সদস্যকে হত্যার অভিযোগে পি ডব্লিউ বোথার বর্ণবাদী শাসকদল তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং মৃত্যুদণ্ডের সাজা ঘোষণা করে । আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের বিবৃতি অনুযায়ী জানা যায় এই হত্যাকাণ্ডে মোলয়েজ জড়িত ছিলেন না । তবু , সারা বিশ্বের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে ১৮ অক্টোবর ( ১৯৮৫ ) প্রিটোরিয়া কেন্দ্রীয় কারাগারে কবিকে ফাঁসিতে ঝোলায় বর্ণবাদী ঘৃণ্য বোথা সরকার । এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের আগুন ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে । পথে নেমে পড়ে উত্তেজিত মানুষজন । সারা বিশ্বে ধ্বনিত হতে থাকে অমর শহীদ মোলয়েজ স্লোগান । আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে নিন্দার ঝড় ওঠে বোথা সরকারের বিরুদ্ধে । ফাঁসি বরণ করার আগে মোলয়েজ লিখলেন ,
‘ আমি যা তাই হতে পেরে আমি গর্বিত …
অত্যাচারের ঝড় আসবে
আমার রক্তের বর্ষণে
জীবন দিতে পেরে আমি গর্বিত ।
আমার একাকী জীবন । ‘

এই কবিতাটি সারা বিশ্বের বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান বার্তা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে । ফাঁসির দিনকয়েক আগে তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা হয়েছিল বেঞ্জামিন মোলয়েজের । তাঁর চোখে হাত রেখে মা বলেছিলেন , ‘ কেঁদো না প্রিয় সন্তান , তোমার জন্য তো কাঁদছে সারা পৃথিবী , তুমি কেঁদো না । ‘
‘ শান্তি ‘ কবিতায় বেঞ্জামিন লিখেছেন ,
‘ শান্তি তুমি কোথায় ,
তোমাকে খুঁজি ল্যাটিন আফ্রিকা- আমেরিকায় ।
তুমি কত দূর ? ভীষণ প্রয়োজন তোমাকে আফ্রিকায় এ সময়ে ! ‘

দক্ষিণ আফ্রিকার কালো জনপদে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সহিংস প্রতিরোধ এবং বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত বিদ্রোহীদের অন্যতম নির্ভীক কাণ্ডারী ছিলেন কবি মোলয়েজ । কৃষ্ণাঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠ , যাঁরা দীর্ঘকাল ধরে শ্বেতাঙ্গ শক্তির চাপে চরম অবহেলিত ও বঞ্চিত অবস্থায় দিনাতিপাত করতেন এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে পরিগণিত হতেন , তাঁরা তো দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া কোনঠাসা অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর মরিয়া চেষ্টা করবেনই । আত্মনিয়ন্ত্রণ তথা আত্মরক্ষার অধিকার রক্ষার প্রয়াস তো মানবজাতির পবিত্রতম কর্তব্য । সেই মহান কর্তব্য পালন করতে গিয়েই ফাঁসির মুখোমুখি হতে দ্বিধা করেন নি কবি । আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস পুলিশ হত্যার দায় স্বীকার করলেও এই হত্যায় মোলয়েজের জড়িত থাকার অভিযোগ কখনোই স্বীকার করে নি । তবু ফাঁসি কার্যকর করেছিল কট্টরপন্থী বোথা সরকার । গোটা দেশের বিভিন্ন স্থানে ফাঁসির বিরুদ্ধে এবং কালো মানুষদের সমর্থনে গণ আন্দোলনগুলো হিংসাত্মক চেহারা নিয়েছিল কবির মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার সঙ্গেসঙ্গেই । চূড়ান্ত বলপ্রয়োগ করেও এই বিক্ষোভের আগুন নেভাতে পারছিল না নির্মম বোথা সরকার । উগ্র কৃষ্ণাঙ্গ বিক্ষোভকারীরা খোদ জোহানেসবার্গের ডাউনটাউনে ভয়াবহ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছিল প্রশাসনের সঙ্গে । রক্তের বন্যা বয়ে যায় সেখানে ।
‘ A Strom of oppression will be followed by the rain of my blood , I am proud to give my life , my solitary life . ‘

মায়ের সঙ্গে মাত্র কুড়ি মিনিটের শেষ সাক্ষাতে বেঞ্জামিন বলেন , মা আমাকে তুমি বিশ্বাস করো মা , আমি খুন করি নি । আমি আন্দোলনে ছিলাম , কে খুন করেছে আমি জানি । কিন্তু আমার মৃত্যুদণ্ডের জন্য আমার কোনো দুঃখ নেই । সবাইকে বোলো আমাদের আন্দোলন সংগ্রাম যেন চলতে থাকে ।‌

আরও পড়ুন- আবার চোখ রাঙাচ্ছে ঘূর্ণাবর্ত! কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে আবহাওয়া পরিবর্তনের সম্ভাবনা

আর তাঁর মা বলেন , আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমার সন্তানের মানসিক দৃঢ়তা । মাতৃভূমির জন্য এবং কালো মানুষদের মুক্তির লড়াইয়ে মৃত্যুবরণের জন্য সে রীতিমতো তৈরি ।

 

 

 

spot_img

Related articles

SIR বিরোধিতায় ঠাকুরনগরে অনশন মতুয়া সম্প্রদায়ের একাংশের

এসআইআরের (SIR) কারণে এক কোটির বেশি মতুয়া সম্প্রদায় মুক্ত মানুষ ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়বেন। বিজেপি ইচ্ছাকৃতভাবে চক্রান্ত...

হরমনপ্রীতের নয়া কীর্তি: ‘বাহুবলী কন্যার’ বাহুতে বিশ্বকাপ

দীর্ঘ অপেক্ষার অবসন ঘটিয়ে হরমনপ্রীত কৌরের(Harmanpreet Kaur )হাতে উঠেছে বিশ্বকাপ ট্রফি(ICC World Cup)। ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সোনালী ফ্রেমে...

SIR ‘ষড়যন্ত্র’ আটকাতে জনসাধারণের পাশে তৃণমূলের লিগাল সেল: ১১ তারিখ কলকাতা থেকে শুরু, বিশেষ নজর উত্তরবঙ্গ-পূর্ব মেদিনীপুর

এসআইআর (SIR) আতঙ্কে রাজ্যে একের পরে এক আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে। ফলে জনমানসে উদ্বেগ দেখা দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি আইনি...

টাইফুন কালমেগির তাণ্ডব ফিলিপিন্সে: বিপর্যস্ত সেবু, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা

টাইফুন কালমেগির(Typhoon Kalmaegi )দাপটে ফিলিপিন্সে ( Philippine )ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পর নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী,...