
‘ মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ ‘ যেন সবারই মনের কথা । এক কবি লেখেন , ‘ দীর্ঘ জীবন কত দুঃখতাপ ‘ , তো আরেক কবি আক্ষেপ করেন , ‘ জীবন এত ছোট কেনে ? ‘ ছোট অথবা বড় যা-ই হোক না কেন , এক জীবনে সব কাজ সেরে ফেলা বড়ই কঠিন। আশি বছর বয়সে পৌঁছেও গৃহস্থের , এমনকি সন্ন্যাসীরও মনে হয় , ‘ কত কাজ বাকি রয়ে গেল ! ‘ তাই ‘ মাইলস টু গো ‘ সর্বজনমান্য বাক্যবন্ধ হিসেবে শাশ্বত হয়ে থাকে।

‘ স্টপিং বাই উডস অন এ স্নোয়ি ইভনিং ‘ কবিতার স্রষ্টা রবার্ট ফ্রস্ট যদি আর একটি কবিতাও না লিখতেন , তবু এই একটি কবিতার জন্যই তিনি অমর হয়ে থাকতেন । ঘন তমসাচ্ছন্ন হিম সন্ধ্যা । এক অশ্বারোহী ( সম্ভবত কবি স্বয়ং ) সহসা ঘোড়া থামালেন গায়ে গায়ে লাগা গাছেদের গা ঘেঁষে । ‘ বন্য বন্য এ অরণ্য ‘ । অমোঘ এর টান । কে উপেক্ষা করতে পারে এমন মধুর হাতছানি ? হাড়হিম রাতে এ কিসের ইশারা ? এ কোন ইঙ্গিত ? ‘ এখনো সময় হয় নি কি ? বন্ধ দুয়ারে বারবার করাঘাত শোন না কি ? ‘ কিসের সঙ্কেত ? এ সব প্রশ্নের কিছুটা উত্তর পাওয়া যায় উত্তরকালের একটি বাংলা কবিতায় । যে কবিতার শিরোনাম ‘ যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো ‘ , কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ।

রবার্ট ফ্রস্ট ছিলেন সেই কবি , পৃথিবীর সঙ্গে যাঁর সম্পর্ক ছিল অন্তহীন প্রেম ও বিরামহীন কলহের । তিনি বলতেন , ‘ অনুবাদে যা হারিয়ে যায় তা কবিতা । ‘ বলতেন , ‘ অর্ধেক পৃথিবী এমন লোকেদের নিয়ে গঠিত যাদের কিছু বলার আছে অথচ বলতে পারে না এবং বাকি অর্ধেক যাদের বলার কিছু নেই অথচ বলতে থাকে । ‘ তাঁর অবিস্মরণীয় পর্যবেক্ষণ , ‘ কেউ বলে পৃথিবী আগুনে শেষ হবে , কেউ বলে বরফে । ‘

জমাট অন্ধকারে ঢাকা এক শীতসন্ধ্যায় যেতে যেতে একলা পথে ঘোড়সওয়ার হঠাৎ থেমে গেলেন অরণ্যের ধারে । কবি সম্ভবত জানেন কে এই বনের মালিক । কিন্তু ছুটতে ছুটতে হঠাৎ এইভাবে দাঁড়িয়ে পড়ায় খুব অবাক হয়েছে ঘোড়াটি । বন এবং বরফে ঢাকা হ্রদ ছাড়া আর তো কিছুই ঠাহর হয় না । ধারেকাছে নেই কোনো খামারবাড়ি । তবু বছরের এই অন্ধকারতম সন্ধ্যায় সহসা এখানে থেমে যাওয়া কেন ? ঘোড়া মাথা নাড়ায় , ঝাঁকুনিতে বেজে ওঠে গলায় বাঁধা ঘন্টা , এছাড়া শব্দ বলতে তো মৃদুমন্দ বাতাস আর অবিরাম তুষারপাত । তাহলে কি ভুল হচ্ছে কোথাও ? আহা , কি সুন্দর অরণ্য , কী অন্ধকার , কী গভীর ! কবির ঘুম পায় ।


‘ শ্রান্তি লাগে পায়ে পায়ে ‘ , কিন্তু এই আঁধার তরুছায়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ার উপায় কোথায় ? এখনও বহু কাজ বাকি । পূরণের অপেক্ষায় বহু প্রতিশ্রুতি । তাই ঘুমোবার আগে পাড়ি দিতে হবে আরও অনেক মাইল পথ ।

রবার্ট লি ফ্রস্ট । আমেরিকান কবি । জন্ম ২৬ মার্চ , ১৮৭৪ । মৃত্যু ২৯ জানুয়ারি , ১৯৬৩ । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত হওয়ার আগেই তাঁর লেখা প্রাথমিকভাবে প্রকাশিত হয় ইংল্যান্ডে । নাট্যকার হিসেবেও তাঁর পরিচয় সুবিদিত । ফ্রস্টই একমাত্র কবি যিনি কবিতার জন্য ৪ টি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন । তিনি শিক্ষকতা করেছেন , আবার খামারে দীর্ঘদিন কৃষিকাজ করে ব্যর্থও হয়েছেন । তাঁর প্রধান টান ছিল কবিতা । গ্রামীণ জীবন ও প্রকৃতি তাঁর কাব্যের অনিবার্য ছবি এবং তার সঙ্গে মানুষের জটিল সংসার । তাঁর লেখায় একাকার হয়ে আছে ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতা , অপরিসীম বেদনাবোধ , সম্পর্কের টানাপোড়েন ও পারিবারিক জীবনের হতাশা ।

অথচ এই কবির ‘ স্টপিং বাই উডস … ‘ কবিতাটি বিশ্বজুড়ে প্রজন্মের পর প্রজন্মের বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান প্রেরণারূপে বিবেচিত হয় । পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর শেষ জীবনের সান্ত্বনা ছিল এই কবিতাটি । রবার্ট ফ্রস্টের প্রথম দিকের কবিতাগুলিতে পাওয়া যায় শরতের পাতাঝরা রঙ ঝলমলে দিন , গ্রীষ্মের সূর্যস্নাত দীর্ঘ দুপুর ও বসন্তের সন্ধিক্ষণে পরিযায়ী পাখিদের ফিরে আসার গল্প । পরের দিকের কবিতাগুলিতে পাওয়া যায় জীবনের নানা রঙের দিনগুলির আনন্দ-বেদনা । তাঁর বৈদগ্ধ ও উপলব্ধি পরবর্তী সময়ে তাঁর কাব্যভাষায় এক অনন্য মাত্রা যোগ করে । ক্রমেই তিনি হয়ে ওঠেন অসামান্য ।

নিজের পরিবারের সদস্যদের ঘনঘন মৃত্যুর অভিঘাত কবির বৈদগ্ধে যোগ করেছে দার্শনিক মাত্রা । তীক্ষ্ণ , শানিত করেছে জীবনবোধ । মায়ের মৃত্যু , স্ত্রীর মৃত্যু , এবং সন্তানদের একের পর এক মৃত্যু সহ্য করতে হয়েছে কবিকে । তবু বধ্যভূমিতে দাঁড়িয়ে জীবনের জয়গান গাওয়ার মতোই রবার্ট ফ্রস্ট কিছুটা নিস্পৃহ , নিরাসক্ত ভঙ্গিতেই যেন ধ্বংসের মধ্যে মাথা তুলে দায়বদ্ধতার নিবিড় বার্তা দিয়ে গেছেন পৃথিবীকে । স্বজনদের মৃত্যু তো উপভোগ অথবা উদযাপন করা যায় না , সেটা সম্ভবও নয় , কিন্তু মৃত্যুও জীবনের একটা পর্বমাত্র , তার বেশি কিছু নয় , তাই মৃত্যু নয় , জীবন নিয়েই ভাবতে হয় , শব্দে শব্দে অক্ষরে অক্ষরে সারাজীবন ধরে রবার্ট ফ্রস্ট যেন দিতে চেয়েছেন এই গূঢ় সঙ্কেত ।

তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘ scripsi ‘ – তে ( যার অর্থ what I have written , I have written ) উনি লিখে গেছেন তাঁর অসামান্য পর্যবেক্ষণ , যার বাংলা অনুবাদ হতে পারে কিছুটা এইরকম , ‘ আত্মা সময়ের বিভেদমুক্ত , জানি মৃত্যু নিশ্চিত , তাই আমাকে যদি আমার নিজের শোকগাথা লিখতে হয় তাহলে আমি ছোট্ট একটি সংবাদ রেখে যাবো : আমার প্রস্তর ফলক বলবে , আমি প্রেম করেছি পৃথিবীর সঙ্গে , কলহ-ও ।

আরও পড়ুন- মুম্বই সফরে এবার বিগ-বি’র আমন্ত্রণে অমিতাভ-জয়ার বাড়িতে মমতা
