‘আলো: তাপস সেন’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

মধ্যরাত্রি । কয়লাখনির শ্রমিকেরা নাইট শিফটে যে যার কাজে ব্যস্ত । এমন সময় আচমকা খনিগর্ভের একাংশে নামলো ধস । আর সঙ্গে সঙ্গেই খনি থেকে সামান্য দূরে অবস্থিত ‘ নুনি ‘ নামক প্রাকৃতিক খালের জল ঢুকতে শুরু করলো খনিগর্ভে । ভয়ঙ্কর তার গতি । দ্রুত বাড়ছে জলস্তর । বাড়তে বাড়তে একেবারে খনির মুখ পর্যন্ত উঠে এলো জল । ভেতরে রয়ে গেলেন শ্রমিকেরা । সকালে এলো শক্তিশালী জল নিকাশি পাম্প । কিন্তু পাম্পের সাহায্যে অন্ধকার খনির ভেতর থেকে জল বের করতে লেগে গেল ২১ দিন । সবাই ধরে নিলেন ভেতরে কর্মরত শ্রমিকদের কেউই বেঁচে নেই । কিন্তু আশ্চর্য মানুষের জীবনীশক্তি । খনিগর্ভের অন্ধকারে ২১ দিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে রইলেন ১১ জন শ্রমিক । তাঁদের শরীরগুলো হয়ে গিয়েছিল সাদা ফ্যাটফেটে । তাঁরা সূর্যের আলো পর্যন্ত সহ্য করতে পারছিলেন না । ধীরে ধীরে তাঁরা সুস্থ হয়ে ওঠেন । বাকিরা সবাই মারা যান । এ ঘটনা ঘটেছিল ১৯৫৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আসানসোলের বড়ধেমো কয়লাখনিতে ।

এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা নিয়েই তৈরি হয় উৎপল দত্তের নাটক ‘ অঙ্গার ‘ । নাটকে নিপুণ আলোকসম্পাতে দেখানো হয় কিভাবে অন্ধকার খনিগর্ভে জল প্রবেশ করছে এবং সেই জল বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সৃষ্টি হচ্ছে একটি জলের প্রাচীর ।

এই অবিস্মরণীয় আলোর কারুকাজ যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত , তিনিই এক ও অদ্বিতীয় তাপস সেন ।
অনেকেই হয়তো জানেন না প্যারিসের গর্ব , দুনিয়ার অন্যতম বিস্ময় আইফেল টাওয়ারকে আলোর মালায় মুড়ে দিয়েছিলেন এই কৃতি আলোকশিল্পী । আমাদের হাওড়া ব্রিজকেও আলোয় আচ্ছাদিত করেন এই আলোর জাদুকর । সারাজীবন আলোর ইন্দ্রজালে যিনি মুগ্ধ করে গেছেন সকলকে , তিনি নিজে কিন্তু কিছুটা অন্ধকারেই থেকে গেলেন । তাঁর প্রকৃত মূল্যায়ন হয় নি বলে আক্ষেপ করেছেন অমিতাভ বচ্চন । এমন অনন্য প্রতিভা যথাযথ সম্মান থেকে বঞ্চিত হবেন কেন ? কেন দেশ তাঁকে মনে রাখবে না ? এই উপেক্ষা কি তাঁর প্রাপ্য ? তাঁর প্রিয় কলকাতা শহর কতটা মনে রেখেছে তাঁকে ? তাঁর জীবনদীপ নিভে গেছে বলে তাঁকে ভুলে যেতে হবে ?

ইংল্যান্ডের প্রখ্যাত আলোশিল্পী রিচার্ড পিলব্রো তাপস সেন সম্পর্কে লিখেছেন , ‘ তাপস সেনের কল্পনাশক্তি যন্ত্রের শক্তিকে ছাপিয়ে গেছে । অবিশ্বাস্য রকমের সামান্য কিছু উপকরণ , কয়েকটি ল্যাম্প , আমাদের নিত্য ব্যবহার্য ছোটখাটো জিনিস — এই দিয়ে তিনি দেখাতেন আলোর জাদু । ‘ আলোর তপস্বী এই জাতশিল্পী কাঁচের গ্লোব , বাঁশপাতা , ছেঁড়া কাপড় , হ্যারিকেন , এমনকি শুকনো পাতার মতো তুচ্ছ উপকরণ দিয়ে মঞ্চে সৃষ্টি করতেন আলোর মায়া । তিনি মনে করতেন , ছায়া বা আঁধার না থাকলে আলোর মর্ম পরিস্ফুট হয় না । ১৯৭২ সালে তিনি এশিয়ার শ্রেষ্ঠ ‘ লাইট ডিজাইনার ‘ স্বীকৃতি পান । তবু থেকে যান নেপথ্যে , ‘ আড়ালের মানুষ ‘ হিসেবেই ।

তাপস সেনের জন্ম ১১ সেপ্টেম্বর , ১৯২৪ এবং মৃত্যু ২০০৬ সালের ২৮ জুন । এ বছর তাঁর জন্ম-শতবর্ষ । আড়ালের মানুষকে কে আর মনে রাখে ! তিনি মরনোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছিলেন । তাঁর নশ্বর শরীর চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যবহারের জন্য দান করা হয় । আলোকবিজ্ঞানকে যিনি নিয়ে গিয়েছিলেন শিল্পের স্তরে , বাংলা রঙ্গমঞ্চকে যিনি দেশের সীমানা পার করে পৌঁছে দিয়েছেন বিশ্ব-রঙ্গমঞ্চে , সেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মানুষটির প্রকৃত মূল্যায়ন কি কখনও হবে না ?

সঙ্গীত নাটক আকাদেমি , দীনবন্ধু পুরস্কার , কালিদাস সম্মান তিনি পেয়েছেন । তাঁর লেখা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বই : অন্তরঙ্গ আলো , দ্বিতীয় অঙ্ক , প্রথম দৃশ্যের আলো , আলোছায়ার পরে । বার্লির কৌটো আর বিস্কিটের ভাঙা টিন সম্বল করে তিনি রঙ্গমঞ্চের আলোয় নিয়ে এসেছিলেন নবযুগ । তাঁর আলোজীবনের শুরুতে দিল্লিতে পরিচিত হয়েছিলেন ‘ লাইটওয়ালা বাঙালিবাবু ‘ হিসেবে । আর মুম্বাইতে ?

১৯৪৬-এ বোম্বে গেলেন তাপস ক্যামেরা আর আলোর কাজ শিখতে । প্রায় কপর্দকহীন অবস্থায় । একদিন পৃথ্বীরাজ কপূরের নাটক দেখে তাঁর কাছে গিয়ে নিজের আলো নিয়ে কিছু পরিকল্পনার কথা জানান । কিন্তু আধময়লা পাজামা-কুর্তা পরা তাপসকে পাত্তাই দিলেন না পৃথ্বীরাজ । বললেন , ‘ ওটা ( আলো ) রাজ ( কপূর ) দেখছে ।’ বহুবছর পরে পৃথ্বীরাজ যখন আক্ষেপ করছেন , ‘ শম্ভু বা উৎপলের মতো আমার একটা তাপস সেন নেই ‘ , তখন এই পাত্তা না দেওয়ার গল্পটা তাপস তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন ।

‘ রূপকথা ‘ নামের একটি অখ্যাত নাটকে সাদা ঘষা কাঁচের গ্লোবের সামনে বাঁশপাতা ঝুলিয়ে তাপস তৈরি করেন পূর্ণ চাঁদের মায়া । বহুরূপীর প্রযোজনা ‘ চার অধ্যায় ‘ নাটকে তৈরি করলেন আলোশিল্পের নতুন ব্যাকরণ । শহরের ছাদে গোধূলি পার করে নেমে আসা আঁধারে অন্তু আর এলার সিলুয়েট এবং ঘটনা যখন চূড়ান্ত ট্র্যাজেডির দিকে এগোচ্ছে , দূরে-কাছে বাড়ির আলো নিভে এসে মঞ্চে গাঢ় শ্বাসরোধী ছায়া-আঁধার ! অসামান্য , বিরলের মধ্যে বিরলতর ।

শম্ভু মিত্র ও উৎপল দত্ত । থিয়েটারের দুই মহাপ্রতিভা । নাটক নিয়ে দুজনের মত ও পথ ভিন্ন । কিন্তু দুজনের মধ্যে আলোর সেতু তাপস সেন । তাপস ছাড়া দুজনেরই চলে না । ‘ সেতু ‘ নাটকে একটি আত্মহত্যার দৃশ্যে তাপস দেখালেন মঞ্চের পিছন থেকে একটি ট্রেন ঝড়ের গতিতে এসে দর্শকের সামনে বাঁক নিয়ে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে ! তাঁর দেওয়া কয়েকটি আলোর নাম : দুধের বালতি , ইকড়ি মিকড়ি , ইঁদুরকল । ‘ তিতাস একটি নদীর নাম ‘ – এ বাঁশের ডগায় ছোট্ট আলো ঝুলিয়ে দোল দিলেন আলোর যন্ত্রী তাপস । আর দর্শক দেখলো নদীর বুকে নৌকোয় দুলছে হ্যারিকেন ।

১৯৬৫ সালে বম্বেতে ‘ দ্য স্প্লেন্ডার্ড ওয়ান ‘ নাটকে মঞ্চে পাহাড় ভেঙে পড়লো , জরথ্রুষ্ট নদীর উপরে হেঁটে গেলেন । এই দৃশ্য দেখতে এত ভিড় হতে লাগলো যা বম্বের ইংরেজি নাটকে কখনো হয় নি । আসলে জাদু নয় , বরং আলোর এবং তার দোসর অন্ধকারের বহুমাত্রিক ব্যবহারে নাটককে গভীরতর দ্যোতনা দেওয়াই ছিল তাপস সেনের আসল ক্ষমতা । সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ নামজীবন ‘-এ শুরুতেই ভাঙা ঘরের ছাদে চরাচর ভাসানো জ্যোৎস্না ভোলা যায় না । ‘ ছেঁড়া তার ‘-এ চালাঘরে রৌদ্রছায়া কে ভুলবে ? শুধু প্যারিসে নয় , মস্কো , তাসখন্দ, লেনিনগ্রাদে তাঁর আলোয় অভিভূত হয়েছেন অসংখ্য দর্শনার্থী ।

ব্যক্তিগত জীবনে তাপস ছিলেন ঠোঁটকাটা , আপসহীন । সারাজীবন এ জন্য ভুগতে হয়েছে তাঁকে । কিন্তু নিজেকে বদলান নি । শুধু নাটক নয় , সিনেমা , যাত্রা , নৃত্য ও নৃত্যনাট্য , এমনকি কচিকাঁচা শিল্পীরাও তাপসের আলোকসান্নিধ্য পেয়েছে বারবার । দেশে ও বিদেশে বহু গুরুত্বপূর্ণ উৎসবে আলোকসজ্জার পরিকল্পনা ও রূপায়ণ করেছেন তিনি । তুচ্ছাতিতুচ্ছ উপকরণ দিয়ে আলোকে কথা বলাতেন তাপস সেন । ক্ষণজন্মা এই মহাশিল্পীর জন্যই যেন মানানসই রবীন্দ্র-উপমা , ‘ নাচে আলো ‘ , ‘ বাজে আলো ‘, ভুবন ভরা ‘ , ‘ নয়ন ধোয়া ‘ আলো । হৃদয়ের প্রতিটি কোষে আলোর ছন্দ না থাকলে কিছুতেই আলোর স্রোতে পাল তোলে না প্রজাপতি , আর আলোর ঢেউয়ে মেতে ওঠে না মল্লিকা মালতি , একথা তাপস সেনের চেয়ে ভালো আর কে-ই বা জানবেন !

আরও পড়ুন- আবার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসছে চিতা, তৈরি হচ্ছে নতুন ঠিকানাও

Previous articleআবার দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসছে চিতা, তৈরি হচ্ছে নতুন ঠিকানাও
Next articleBreakfast news : ব্রেকফাস্ট নিউজ