Monday, August 25, 2025

‘হাবিব তনবীর’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

ব্যাটা , নামটা কি রে তোর ?
আমি ? চরণ দাস চোর ।

সে বছর ভারি আকাল । সেটা কোন বছর ? আরে যেবার ইন্দ্র ভগবান খুব রাগ করেছিল , জষ্টি- আষাঢ় মাসেও আকাশ থেকে আগুন ঝরছিল , আর ছত্তিশগড়ের গাঁয়ে গাঁয়ে পোখর , মানে পুকুর আর কুয়ো শুকিয়ে যাচ্ছিল , লোকে খাবার জল পাচ্ছিল না তো চাষের জল ! তখন কুমারী , হসদেও , আহিরণ , মনিয়ারী — এইসব নদীতে বাঁধ তৈরি হয় নি , স্টপ ড্যাম তৈরি হয় নি , সেচের জন্য খাল কাটা হয় নি ।
সেই কথাই তো বলছি । তখন ছত্তিশগড়ে প্রতি তিন বছরে পালা করে ‘ দুকাল ‘ হতো , মানে আকাল পড়তো । গরিব মানুষ খেতখামারে কাজ পেতো না । সবাই খাপরার ছাদের ঘরে কাঠের দরজায় তালা ঝুলিয়ে বউ-বাচ্চা নিয়ে গাঁ ছেড়ে পালাতো ।

ওরা যেতো কোথায় ?
আড়কাঠি যেখানে কাজের লোভ দেখিয়ে নিয়ে যেতো । সে দিল্লি , হরিয়ানা , রাজস্থান হতে পারে , অথবা কলকাতা ।

কী কাজ পেতো তারা ?
ইটভাটার কাজ । বাড়ি তৈরির জোগাড়ের কাজ । কুলি-কামিনের কাজ । থাক ওসব কথা ।

তা আকালের মার সেবার একটু বেশি হওয়ায় ঘরে ঘরে হাহাকার । বেড়ে গেল চুরিচামারি । গরু- বাছুর থেকে শুরু করে ধুতি , গামছা , শাড়ি এমনকি শায়া- বেলাউজও বাদ যাচ্ছে না । গরিবদের তো সোনাদানা , টাকা পয়সা নেই । কিন্তু বড়লোকদের রাতের ঘুম কেড়ে নিলো এক ব্যাটা চোর । তার নাম চরণদাস । পুলিশের জালে ছিঁচকে চোরগুলো ধরা পড়লেও পাঁকাল মাছ চরণদাসের নাগাল আর কিছুতেই পায় না পুলিশ । একসময় এক ধনীর বাড়ি থেকে চুরি গেল সোনার থালা । ব্যাস , আর যায় কোথায় ! টনক নড়লো ভরা যৌবনে বিধবা রানির । তিনি ঘোষণা করলেন , কোতোয়াল , হাবিলদাররা চোর ধরে আনতে পারলে পাবে মোটা পুরস্কার ।

এদিকে চরণদাস , চুরি যার ‘ ধর্ম ‘ , সে তার গুরুর কাছে পাঁচটা প্রতিজ্ঞা ( পরণ ) করেছে ।
কোনদিন সোনার থালায় খাবে না ।
কোনো রানিকে বিয়ে করবে না ।
কোনদিন রাজা হবে না ।
কোনদিন হাতির পিঠে চাপবে না ।
কখনও মিথ্যা বলবে না ।
অবশ্যই তার মৃত্যুভয় আছে । কিন্তু তার এক কথা , ‘ পরণ তোড় নহি সকুঁ ‘ ।
আশ্চর্য ব্যাপার তো ! চুরি করবে , আবার সত্যিও বলবে ?

এই কাহিনী নিয়েই তো কিংবদন্তি নাট্যকার , নট ও নির্দেশক হাবিব তনবীর- এর সাড়া জাগানো নাটক
‘ চরণদাস চোর ‘ । প্রখ্যাত হিন্দি সাহিত্যিক বিজয়দান দেথা’ র রচনা অবলম্বনে নির্মিত এই নাটকটি । ছত্তিশগড়ের রায়পুরে নিজের শিকড়ের মাটিতে হাবিব তনবীর গাঁয়ের আদিবাসী ও লোকশিল্পীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘ নয়া থিয়েটার ‘ । তাঁরাই বিখ্যাত করে তুলেছিলেন ‘ চরণদাস চোর ‘ নাটকটিকে । এরপর ছত্তিশগড়ি লোকনাট্য অভিনীত হতে লাগলো গ্রামে গ্রামে । পরে দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে গেলো সারা বিশ্বে ।

হাবিব অবশ্য এর অনেক আগেই লন্ডন এবং ব্রিস্টল-এ ব্রিটিশ রয়্যাল আকাদেমি অফ ড্রামাটিক আর্টস-এ আধুনিক নাট্যকলার শিক্ষা গ্রহণ করেন । জার্মানিতে বের্টোল্ট ব্রেখটের থিয়েটার ‘ বার্লিনার এনসেম্বল ‘ ভীষণ প্রভাবিত করেছিল হাবিবকে । সমকালীন ভারতীয় নাট্যকলার এই প্রবাদপুরুষ মঞ্চমায়া ত্যাগ করে চিরদিনের মতো চলে যান ৮ জুন , ২০০৯ সালে ।‌

জন্মেছিলেন ১ সেপ্টেম্বর ,ছত্তিশগড়ের রায়পুরে , ১৯২৩ সালে । তাঁর অনেক পরিচয় । উর্দু ও হিন্দি নাট্যকার , নির্দেশক , চলচ্চিত্রাভিনেতা , রেডিও প্রযোজক , কবি ও সাংস্কৃতিক সংগঠক । তিনি নির্মাণ করে গেছেন এক স্বতন্ত্র নাট্যভাষা , লোকগান ও লোকনৃত্যকে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত করেছেন থিয়েটারের সঙ্গে । তিনি বলতেন , নাটক দেখে যদি দর্শক নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে যান তাহলে সেই নাটক ব্যর্থ । লোক আঙ্গিক ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সহজাত নৈপুণ্যকে নিপুণভাবে কাজে লাগিয়ে ভারতীয় নাটকের ইতিহাসে এক নতুন শৈলীর পত্তন করেন হাবিব ।

তিনি বলতেন , প্রশ্ন তুলবে নাটক । দর্শকদের ভাবাতেই হবে ।
গাঁও কা নাম শসুরাল মোর নাম দামাদ , কামদেওকা আপনা বসন্ত রিতু কা সপনা ইত্যাদি তাঁর জনপ্রিয় নাটক । তাঁর জীবদ্দশায় তিনি সঙ্গীত নাটক আকাদেমি পুরস্কার , জওহরলাল নেহরু ফেলোশিপ , কালিদাস সম্মান , পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ সহ বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন । ‘ চরণদাস চোর ‘ নাটকের জন্য ১৯৮২ সালে এডিনবার্গ আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসবে তাঁকে ফ্রিংজ ফার্স্টস অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত করা হয় । আগ্রা বাজার , শতরঞ্জ কে মোহরে , লালা সেহরত রায় , মিট্টি কি গাড়ি , উত্তর রাম চরিত , বাহাদুর কালারিন , ব্রোকেন ব্রিজ , পোঙ্গা পণ্ডিত , দেখ রহে হ্যায় ন্যায় , হিরমা কি অমর কহানি ইত্যাদি তাঁর সৃষ্ট নাটক ।  আগ্রা বাজার নাটকটি মঞ্চস্থ করার পরেই তাঁর পরিচিতি বাড়ে । খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে । এই নাটকে হাবিব কবিতা ও সঙ্গীতকে ব্যবহার করেন নাটকের অন্তর্নিহিত শক্তি হিসেবে , বাইরের অলঙ্কার হিসেবে নয় । ঔপনিবেশিক ভাবনা থেকে সরে এসে নিজস্ব লোকসংস্কৃতির পরিমণ্ডলে নাটক নির্মাণের ভাবনা তাঁর ছিলই । জার্মানি গিয়ে ব্রেখটের নাটকগুলি দেখে তাঁর এই ভাবনা আরও জোর পায় এবং তখনই আদিবাসী ও লোকশিল্পীদের নাটকের আঙিনায় নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন । অভিজ্ঞতাহীন ও অপ্রশিক্ষিত মেহনতি মানুষদের নিয়ে গঠিত তাঁর ‘ নয়া থিয়েটার ‘ ভারতীয় নাট্যকলার ইতিহাসে এক সুদূরপ্রসারী বাঁকবদল । মঞ্চে কখনো ৫২ জন , কখনও বা ৭২ জন কুশীলবদের সক্রিয় বিচরণ বড়ো সহজ ব্যাপার নয় । হাবিবের হাতে গড়া নাট্যকর্মীরা যা বারবার করে দেখিয়েছেন । তাঁর নাটকে যুগের চাহিদা ক্ষণে ক্ষণে মূর্ত হয়ে ওঠে । তাঁর অসামান্য পরিমিতিবোধ দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে ।

আরও পড়ুন- রাজনীতির পাড়ে হাঁক-ডাক মদনের! সাগর দত্ত হাসপাতাল নিয়ে বিস্ফো.রক অভিযোগ

spot_img

Related articles

কলকাতার সর্বজনীন পুজো ডিরেক্টারি: দু-মলাটে বাংলার দুর্গোৎসবের ৪৩৪ বছরের ইতিহাস

রবিবাসরীয় সন্ধেয় গড়িয়াহাটের একটি ব্যাঙ্কয়েটে আড্ডার আবহে প্রকাশিত হল সাংবাদিক-লেখক সম্রাট চট্টোপাধ্যায়ের বই 'কলকাতার সর্বজনীন পুজো ডিরেক্টারি'। উপস্থিত...

তৃণমূল–সমাজবাদী পার্টির পথে এবার আম আদমি পার্টি! জেপিসিতে থাকছে না আপও 

সংবিধান সংশোধনী বিল খতিয়ে দেখতে গঠিত যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিল আম আদমি পার্টি।...

মোদির বিরুদ্ধে সরব! হিটলারি কোপে লাদাখের সোনম ওয়াংচু

দফা এক দাবি এক। লাদাখের জন্য একই দাবিতে আজও অনড় সমাজকর্মী সোনম ওয়াংচু (Sonam Wangchuk)। লাদাখের জমি, যা...

শান্তিপুরে মহিলা স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর ভোটে গোহারা বিজেপি! ২৬-৪-এ জয়ী তৃণমূল 

এসআইআর ইস্যু নিয়ে রাজ্যে বিজেপির মাতামাতির মধ্যে নদিয়ার শান্তিপুরে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ক্লাস্টার কমিটির নির্বাচনে বড় সাফল্য পেল...