Monday, November 24, 2025

‘পুজোর অর্থনীতি’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

প্রতিদিন আমাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয় । কিন্তু বিশ্বাস করুন , আমরা বছরভর অপেক্ষা করে থাকি দুর্গাপূজার জন্য । আমরা ঢাক বাজাই । ঢাকে কাঠি না পড়লে তো মায়ের পূজা শুরু হয় না । শহরের বাবুরা আসেন পুজোর মাস কয়েক আগে বায়নার টাকা নিয়ে । বহুকাল আগে চারজনে সাকুল্যে পেতাম ৮০০ টাকা । এখন সব জিনিসের দাম বেড়েছে । এখন চারজনে পাই হাজার বিশেক । আর পূজার শেষে এলাকায় বাড়ি বাড়ি ঘুরে আরও হাজার বিশেক । আমরা বংশপরম্পরায় ঢাকী ।

আমি নারায়ণ , আমার বাবা মহাদেব , ছেলে হরনাথ আর ভাগ্নে দিবাকর , এই আমাদের দল । আজ্ঞে , আমাদের নিবাস মুথুকবনি গাঁ , বাঁকুড়া জেলায় ।

হারুচাঁদ ও ফটিকচাঁদ থাকেন দক্ষিণ ২৪ পরগনার কুলতলি লাগোয়া এক গ্রামে । এঁরা পূজায় পদ্মফুল সরবরাহ করেন । সাপের ছোবল খাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও এঁরা পদ্ম তোলেন বরাবর । বেশ ভালো রোজগার হয় এই সময়টায় । নারায়ণ , মহাদেব ও ফটিকের মতো আরও অনেক মানুষ সারাবছর চাতকের মতো অপেক্ষা করে থাকেন মায়ের আগমনের জন্য । দেবীপক্ষের সূচনায় এঁদের পকেটে কিছু নগদ অর্থ আসে । পেট শান্ত হয় । টানাটানির সংসারে অশান্তি বিদায় নেয় অন্তত কয়েক দিনের জন্য ।

সর্বজনীন শারদোৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মানুষের কর্মসংস্থান ও রুটিরুজি । বিগত দু’আড়াই বছরের কোভিডকাল কিছুটা থমকে দিয়েছিল পুজোর অর্থনীতিকে । এখন আবার সবকিছু স্বাভাবিক হতেই পুজোকে ঘিরে লেনদেন জমজমাট । পশ্চিম বর্ধমান শিল্পাঞ্চলে জি টি রোড লাগোয়া এক ধাবায় পুজোর পাঁচ দিনে প্রায় এক কোটি টাকার ব্যবসা হয় !
অন্যান্য উৎসবে এমন বিপুল পরিমাণ লেনদেন ভাবাই যায় না ।

প্রতিমা , ফলমূল ও মিষ্টি-সহ পুজোর সমস্ত সামগ্রী , মৃৎশিল্পী , কুমার , ডেকোরেশন , আলো , মাইক্রোফোন , পর্যটন ব্যবসা , স্পন্সরশিপ , খাওয়া দাওয়া , পাবলিকেশন , পুজোকেন্দ্রিক মেলা , খুচরো বিক্রেতা , হোটেল-রেস্তোঁরা ব্যবসা ইত্যাদি ঘিরে যে বিপুল পরিমাণ অর্থের লেনদেন হয় শারদোৎসবে , তা আর কোনো উৎসবের ক্ষেত্রে হওয়া অসম্ভব । দেবীপক্ষের সমাপ্তিতে অর্থাৎ পঞ্চদশ দিনের পূর্ণিমা তিথিতে মা লক্ষ্মীর পূজা আরম্ভের আগেই লক্ষ্মীলাভ হয়ে যায় সকলের । শারদোৎসবের এমনই অর্থনৈতিক মহিমা ।

এই মহোৎসব ঘিরে অসংখ্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেও কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয় । একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে , পশ্চিমবঙ্গে দুর্গাপূজা ঘিরে সৃজনশীল শিল্প সংক্রান্ত যে অর্থনৈতিক মূল্য অনুমান করা হয়েছে তা ৩২,৩৭৭ কোটি টাকা , যা বিশ্বের অনেক ছোট দেশের অর্থনীতির আকার । মাত্র পাঁচ দিনের এই উৎসবে এই বিপুল পরিমাণ অর্থের আবর্তন সত্যিই বিস্ময়কর ।

অতিমারির চোখরাঙানি স্তিমিত হওয়ার পরেই অন্য একটি সূত্রের সমীক্ষায় দেখা গেছে গতবছর বাংলায় পুজোর অর্থনীতির বহর ৪৫ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে , যা অর্থনীতির দিক থেকে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করে বানিজ্য মহল ।

শারদোৎসবকে কেন্দ্র করেই বাঙালির যাবতীয় স্বপ্ন-সাধ । জীবনযাত্রার প্রতিটি স্তরে এই উৎসব এমনভাবে প্রভাব বিস্তার করে রয়েছে যে তার বহর বা বৃদ্ধির সঠিক হিসেব নিকেষ করে ওঠা বড়োই দুরুহ ব্যাপার । এখন জনগণের চাঁদায় পুজোর দিন ফুরিয়েছে । মুখ ঢেকে যাওয়া বিজ্ঞাপনের এই যুগে সর্বার্থেই বিজ্ঞাপনদাতাদের হাত থেকেই আসে খরচের অধিকাংশ । জামাকাপড়ের দোকান , জুতোর দোকান , প্রসাধন সামগ্রীর দোকান এবং দশকর্মার দোকানগুলোতে পুজোর কয়েক মাস আগে থেকে শুরু করে পুজোর দিনগুলোতে বিক্রিবাটা হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার ।

গতবছর,অর্থাৎ ২০২২ সালে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ৪৩ হাজার পূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে । গত দশ বছরে রাজ্যে দুর্গাপূজার সংখ্যা ৯১ শতাংশ বেড়েছে । শুধু কলকাতায় দুর্গাপূজা হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার মণ্ডপে । এর মধ্যে বাড়ির পূজাও রয়েছে । শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয় , ঝাড়খণ্ড , বিহার , উড়িষ্যা , আসাম , ত্রিপুরা , দিল্লি ও মুম্বাই- সহ বিভিন্ন রাজ্যে অসংখ্য দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে প্রতিবছর ।

আনন্দের কথা , অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক ও কর্মীরা বিকশিত হন শারদোৎসবের সমসাময়িক অর্থনীতিতে । যাঁরা প্রতিমা গড়েন , যাঁরা মাটির প্রদীপ বানান , যাঁরা ফুল বিক্রি করেন , যাঁরা মণ্ডপ তৈরি করেন , যাঁরা পূজার সামগ্রী সরবরাহ করেন , তাঁরা সকলেই সারা বছরের উপার্জনের একটা বড়ো অংশ হাতে পান এই সময়েই । পূজা-এলাকায় দোকান দেন যে সমস্ত ছোট ব্যবসায়ী , তাঁরাও এই সময়ে কিছু অতিরিক্ত মুনাফা করার সুযোগ পান ।

আমাদের দেশের অর্থনীতি মূলত আবর্তিত হয় অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য । এইভাবে দেখতে গেলে পুজোয় সেই অংশের উন্নতির অর্থ এক অর্থে অর্থনীতির সার্বিক উন্নয়ন , যার গুরুত্ব অপরিসীম । অতিমারির সময়ে পুজোকেন্দ্রিক অর্থনীতির সামগ্রিক অবনমন নিয়ে বিশ্লেষণ হয়েছে বারবার । কারণ , একথা সত্য যে , বাঙালির প্রাণের এই উৎসবে , বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ এই উৎসব ঘিরে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হয় । দুর্গাপূজা ঘিরে আর্থিক সচ্ছলতার খানিকটা সুযোগ যদি পান প্রান্তিক , দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের মানুষজন , তার চেয়ে ভালো আর কি-ই বা হতে পারে !

জনতার ভিড় আর বিভিন্ন পূজা কর্তৃপক্ষের অভিনব সৃজনশীলতা যদি সার্বিকভাবে একটি রাজ্যের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করে তুলতে পারে তাহলে তাকে বাহবা তো দিতেই হয় । উৎসবের ভিড় যদি বহুজাতিক কোম্পানি , বিজ্ঞাপন সংস্থা থেকে শুরু করে বড়ো-ছোটো ব্যবসায়ী , এমনকি চা , পান , চপ , সিঙাড়া , ঝালমুড়ি ও ঘুগনি বিক্রেতাকে পর্যন্ত আর্থিক সহায়তা দিতে পারে তাহলে তাকে স্বাগত জানাতেই হয় ।

আরও পড়ুন- রাজ্যবাসীকে মহাষ্টমীর শুভেচ্ছা জানালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

spot_img

Related articles

আজ মন্ত্রিসভার বৈঠকে মমতা, দলীয় কর্মীদের নিয়ে বৈঠক করবেন অভিষেকও

সোমবার বিকেলে মন্ত্রিসভার বৈঠক ডেকেছেন  বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)।রাজ্য জুড়ে চলা ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন...

১৭ দিনে কাজ শেষ করলেন রাজ্যের দুই BLO: জানালেন হাজারো সমস্যার কথা

নির্বাচন কমিশন কতটা কাঁটায় ভরা পথে রাজ্যের বুথ লেভেল আধিকারিকদের এসআইআর প্রক্রিয়া করতে বাধ্য করছে, তার প্রমাণ রাখলেন...

পিসেমশাই-বৌমা সম্পর্কে স্বামীকে মারতে সুপারি কিলার! বরাহনগর গুলিকাণ্ডে চাঞ্চল্যকর তথ্য

অবৈধ সম্পর্কের জেরেই বরাহনগরে গুলি চলেছিল, তদন্তে উঠে এলো এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য। স্বামীকে খুন করার জন্য সুপারি কিলার...

দূষণে দমবন্ধ রাজধানীর! বিদেশ সফর নিয়ে মোদিকে কটাক্ষ তৃণমূলের

রাজধানী দিল্লিতে ভয়াবহ দূষণ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করলেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ সাকেত গোখেল। সমাজমাধ্যমে তাঁর কটাক্ষ,...