অভিজিৎ ঘোষ, জয়সলমির (রাজস্থান)

বাংলায় একটা কথা আছে, পৃথিবীর যেখানেই যাও বাঙালি ঠিক খুঁজে পাবেই। দেশের পশ্চিম প্রান্তের গাঁ ঘেঁষে জয়সলমিরে দাঁড়িয়ে সেই কথাটাই আর একবার হাড়ে হাড়ে মালুম হলো। তবে যাদের কথা বলব তারা ঠিক বাঙালি নন। কিন্তু তিনি মনে প্রাণে বাঙালি। হেঁয়ালি লাগল?

বছর ৬৫-র সুনীল যোশী। জন্ম বাংলায়, মানে বালিতে। সেখানেই পড়াশোনা, চাকরি। মানে হাওড়া জেলা হাসপাতালে সরকারি কর্মী। বিয়ে। দুই সন্তানের জন্ম। টানা ৩৪ বছর চাকরি। বাবা আইনজীবী। সরকারি। থাকতেন সরকারি কোয়ার্টারে। অবসর নেওয়ার পর হঠাৎ সিদ্ধান্ত বদল। ছেলেরাও চাকরি করছেন। বড় ছেলে চাকরি নয়,ব্যবসা করতে চান। দেশে কিছু জমি জায়গাও আছে। তাই চাকরি ছেড়ে সোজা পিতৃপুরুষের ভিটে জয়সলমিরে। ৫৭ বছরের পাত্তারি গুটিয়ে সুনীল স্ত্রী আর দুই পুত্রকে নিয়ে পৈতৃক ভিটেতে। বড় ছেলে ব্যবসা শুরু করলেন। ছোট টিউশনের কোচিং। কিন্তু ৬০ পেরনো সুনীল কী করবেন? অনেক ভেবেচিন্তে জয়সলমিরের ইতিহাসের কথক হিসেবে তৈরি করলেন নিজেকে। হাওড়া হাসপাতালের কর্মী বনে গেলেন জয়সলমিরের ট্যুরিস্ট গাইড।

কী রকম যোগাযোগ দেখুন, আমাদের গাড়ির চালক বজরঙ সিং ঠাকুরও বরাকর, কুলটি, আসানসোল চষে বেড়াতেন একসময়। তিনিও বাংলার রোদ-জলে বেড়ে উঠে এখন পৈতৃক রাজ্য জয়পুরে গাড়ির চালক। রাজস্থানের আনাচ-কানাচ পাক্কা জুহুরির মতো তাঁর নখদর্পনে। প্রায় রাজ্যের সব কোনেই পরিচিত লোক। টানা ৫৫০ কিমি গাড়ি চালানোর পরেও কোনও ক্লান্তি নেই। তবে সঙ্গে চাই তানসেন গুটখা। ৫৪ পেরিয়েছেন। তিন মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। ছেলে বিশেষভাবে সক্ষম। সেই ব্যথা কুড়ে খায়। বুঝতে দেন না। কোথায় কোন খাবার খেতে হবে, কোন দোকানে চা খেলে মুখে লেগে থাকবে ঠিক সময়ে বলে দেন। বউকে লুকিয়ে জেনে নেন রাতে ‘খাবেন’ নাকি! বাংলা বোঝেন। দুটো একটা বলেন। কিন্তু রাজস্থানী ভাষা বললে কিচ্ছুটি বুঝবেন না।
আর সুনীল বাংলা ছেড়ে ৮ বছর জয়সলমিরবাসী। বাংলা বলতে গিয়ে এখন একটু হোঁচট খান। হিন্দি কথায় পুরোপুরি রাজস্থানী টান। বড্ড যত্ন করে বোঝান। অন্য গাইডের মতো চোখ বন্ধ করে মুখস্থ আওড়ান না। বাংলার লোক বলে বোধহয় কোথায় যেন ফেলে আসা জল হাওয়ার টান অনুভব করে বারবার বোঝালেন। যেখানে দরকার নেই, সেখানে যেতে নিষেধ। সত্যজিতের সোনারকেল্লা কতখানি বেঁচে বলতে গিয়ে বললেন, আমাদের সত্যজিৎ। বোঝালেন বাংলার ফল্গুধারা এখনও শিরায় রয়ে গিয়েছে।

বাংলা থেকে প্রতি বছর রাজস্থানে লক্ষাধিক পর্যটক আসা যাওয়া করেন। কিন্তু সুনীল আর বজরঙ ডায়রির পাতায় রয়ে গেলেন। ডায়রি হারিয়ে না গেলে সযত্নে থাকবে।
