নির্মাতাদের পুরো বিবৃতি ‘ফেক’! রহমানকে ফের গান প্রত্যাহারের দাবি নজরুল ইসলামের নাতনি-সহ বিশিষ্টদের

কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি আরও জানিয়েছেন, এই চিঠি মূল্যহীন। পাশাপাশি চিঠিটি প্রত্যাখ্যান করে তিনি জানিয়েছেন, যে চিঠি সাদা একটি কাগজে লেখা, সত্যতা ছাড়া সেই চিঠি আমরা গ্রহণ করব না।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উপর নির্মিত ‘পিপ্পা’ (Pippa) সিনেমায় ব্যবহার করা কাজী নজরুল ইসলামের (Kazi Najrul Islam) ‘কারার ওই লৌহ কপাট’ (Karar Oi Louho Kapat) গানটির সুর পরিবর্তন করায় রীতিমতো সমালোচনার ঝড়। নজরুলগীতির যে সুর মানুষের কানে লেগে থাকত, সেই গানে এ আর রহমানের কাটাছেঁড়া নিয়ে আপত্তি জানিয়েছেন বিভিন্ন মহলের মানুষ। এমন বিতর্কের মাঝেই দিনকয়েক আগেই বিবৃতি দিয়ে ‘পিপ্পা’র টিম জানিয়েছিল স্বত্বাধিকার সংক্রান্ত যাবতীয় নিয়ম-বিধি মেনেই তারা কাজ করেছে। কিন্তু তাঁরা যতই সাফাই দিন না কেন নির্মাতাদের পুরো বিবৃতিকেই ‘ফেক’ বলে দাবি করলেন কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি অন্দিন্দিতা কাজী (Anindita Kazi)। তাঁর সাফ অভিযোগ, এই ধরনের ক্ষমা প্রার্থনা ও চিঠি গ্রহণযোগ্য নয়। আমি মিডিয়ার এক বন্ধুর কাছ থেকে এটি পেয়েছি। কিন্তু এর সত্যতা কী? এই চিঠিতে লেটার হেড নেই, কোনো স্বাক্ষর নেই। আমি মনে করি, এই চিঠি বিশ্বাস করার আগে সেই প্রশ্নের উত্তর জানা প্রয়োজন। তবে অনিন্দিতা একা নন, তিনি এই সময়ে পাশে পেয়েছেন বাংলার বহু বিশিষ্ট মানুষের সমর্থন। যারা তাঁর বক্তব্যকেই সমর্থন জানিয়েছেন।

অনিন্দিতা কাজী

কী জানিয়েছেন অনিন্দিতা? কাজী নজরুল ইসলামের নাতনি আরও জানিয়েছেন, এই চিঠি মূল্যহীন। পাশাপাশি চিঠিটি প্রত্যাখ্যান করে তিনি জানিয়েছেন, যে চিঠি সাদা একটি কাগজে লেখা, সত্যতা ছাড়া সেই চিঠি আমরা গ্রহণ করব না। এটি কোনওভাবেই অফিসিয়াল চিঠি বা বিবৃতি হতে পারে না। টিমের সদস্যদের স্বাক্ষরসমেত আমরা অথেন্টিক চিঠি এবং মূল চুক্তিপত্র চাই।

পণ্ডিত গিরিধর উপাধ্যায় (ঘটম শিল্পী)

তবে শুধু অনিন্দিতাই নন, গানটির তাল বেতাল করার অভিযোগ তুলেছেন ঘটম শিল্পী পণ্ডিত গিরিধর উপাধ্যায়। তিনি মনে করিয়ে দেন, মহাগুরু পণ্ডিতজি ভীমসেন যোশী তাঁর ছাত্রদের একটাকথা বলতেন, রাগ রাগিণী নিয়ে আমাদের জীবন। তাদের ভাঙাগড়া দিয়ে আমাদের চলন বলন। পরিবর্তন, মিশ্রণ চলে এসেছে, চলবেই। কিন্তু মূল বদলাতে যেও না বেটা প্রলয় হয়ে যাবে। তিনি মনে করিয়ে দেন, এর আগেও বন্দে মাতরম নিয়ে একটা বিতর্কের জায়গা এসেছিল। তবে রহমান সাহাব যেটা ব্যবহার করেছিলেন সেটার সঙ্গে কোনও মিল ছিল না। মূল সঙ্গীত অনেক শ্রুতি মধুর ও গভীরতায় ভরা ছিল। তাই মূল সৃষ্টিকে নষ্ট করার কথা কোনও সঙ্গীতের মানুষের উচিত নয়। কারণ সেই উচ্চতায় আমরা পৌঁছতে পারিনি।

পূরবী ভট্টাচার্য (লোক সঙ্গীত গবেষক)

লোক সঙ্গীত গবেষক পূরবী ভট্টাচার্য বলেন, কারার ওই লৌহ কপাট গানটির ঐতিহাসিক ভিত্তি নিয়ে কারুর দ্বিমত নেই। ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে স্বদেশীয়ানায় যে কয়েকটি গান সমগ্র ভারতবর্ষকে উদ্দীপ্ত করেছিল তার মধ্য এই গান খুবই উল্লেখযোগ্য। সেই গান নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলার অধিকার যে এদের দিল সেটাই বিস্মিত করে। তাঁর অভিযোগ, শুধু বাংলা গানে নয়, দেশের সব প্রান্তেই এই মারাত্মক ভাইরাস ঢুকে গেছে। এ আর রহমান সহ সব সুরকারদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, আপনারা নিজেদের সৃষ্টির ওপর যত খুশি কেরামতি করুন না, অসুবিধে কথায়?

লক্ষণ দাস বাউল (সঙ্গীতশিল্পী)

সঙ্গীতশিল্পী লক্ষণ দাস বাউল বলেন, এ আর রহমানের মত এমন একজন গুণী শিল্পী কি করে এমন একটা সুর বানালেন বুঝতেই পারছি না। আমি রহমানকে একজন শিল্পী হিসেবে খুবই শ্রদ্ধা করি। কিন্তু তাঁর এই কাজটি আমার পছন্দ তো হয়ই নি বরং আমাকে দুঃখিত করেছে বেশি।

গর্গ চট্টোপাধ্যায় (বাংলা পক্ষ)

বাংলা পক্ষের গর্গ চট্টোপাধ্যায়ের অভিযোগ, নজরুল ইসলামের কারার ঐ লৌহ কপাট গানটি বিকৃত করে বাঙালি জাতির ওপর চড় মারা হল। এই চড়টি আসলে বহুদিন ধরে বাঙালির গালে মারা হচ্ছে। প্রতিদিন কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে ‘জন গণ মনকে জানা গানা মানা করে দেওয়া হয়, তখন আমরা কারার ঐ লৌহ কপাট গানটি বিকৃত করার সাহসটাই জোগাই। যখন বন্দেমাতরম কে, এ আর রহমান ভান্দেমাতরম করেন, বঙ্কিমচন্দ্রের সেই মহামন্ত্র তখন হারিয়ে যায়, – তখন কারার ঐ লৌহ কপাট গানটিকে চপেটাঘাত করার পথ আমরাই প্রশস্ত করি।

ডঃ কল্লোল বসু (অধ্যাপক বায়ো টেকনোলজি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা)

রহমান অস্কার পেয়েছেন, গ্র্যামি পেয়েছেন, পূর্বসূরীরা কেউ পাননি, তাদের প্রয়োজনও পড়েনি। সুর নিয়ে তাকে বিকৃত করা, রহমানের অনেক কাজেই পেয়েছি। বিখ ্যাত মালায়লাম সুর বিকৃত করে ওর একাধিক গান আছে। তা নিয়েও বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু এখন ধৃষ্টতার সীমা ছড়িয়েছেন। বন্দে মাতরম থেকে ওর বাংলার সুরকারদের ওপর খবরদারি করার সূচনা। নজরুলের করার ওই লৌহ কপাটকে হত্যা করার জন্য ধিক্কার জানাই। প্রবাসে বসবাস করি মানেই রবীন্দ্র নজরুলে হাত পড়লে ছেড়ে দেব এমনটি নয় কিন্তু।

কবিতা বন্দ্যোপাধ্যায় (রবীন্দ্র সঙ্গীত শিক্ষিকা)

এর আগে এ আর রহমান বন্দেমাতারম নিয়ে ঠিক একই জিনিসটা করেছিলেন। এবার নজরুলে হাত দিলেন। তাও আবার এমন একটা গানে যে গানের পেছনে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তক্ষয়ী দিনগুলো জড়িয়ে রয়েছে। ইতিহাস উপেক্ষা করেই করলেন এবং কোনও কিছু না জেনে। বন্দে মাতরম শোনার পর থেকে আমি খুবই বিরক্ত হয়ে, তাই কারার ওই লৌহ কপাট গানটি বিকৃত হয়েছে জানার পর আমার রহমানের সুর শোনার কোনো প্রবৃত্তি হয়নি, আমি ওই গানটি শুনিনি এবং, এটাই আমার প্রতিবাদ।

অরিন্দম বিশ্বাস (জাতীয় বাংলা পরিষদ, সভাপতি)

বাংলা গানকে খুব খারাপ ভাবে দেখানো হয়েছে। এই গানটি স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের উৎসাহিত উজ্জীবিত করার জন্য যে গান সৃষ্টি করা হয়েছে, সেটি আরেকটি সিনেমায় ব্যবহার করা সেটা অনুচিত হয়েছে। তবে এ আর রহমান এটা প্রথম করেননি। বন্দে মাতরমকেও উনি নিজের মতো করে গুছিয়ে সাজিয়ে নিয়েছিলেন।

সুদীপ্ত ভট্টাচার্য (রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়)

কাজী নজরুল ইসলামের কারার ওই লৌহ কপাট গান স্বাধীনতার পূর্বে ও পরে মানুষকে প্রেরণা দিয়ে এসেছে। এটা শৃংখলা ভাঙার গান,এটা বিদ্রোহের গান, একটা মুক্তির গান। এই গানের আসল সুর খুব শক্তিশালী। আমি এ আর রহমানের গানটাও শুনেছি। আমি বলব, গানটাকে এক কথায় খুন করা হয়েছে।

 

 

 

 

Previous articleজয়নগর খুনে গ্রে.ফতার মূল অ.ভিযুক্ত আনিসুর লস্কর সহ ৪
Next article‘রোহিত শর্মা ষড়যন্ত্র করে টস জেতেন’, অভিযোগ প্রাক্তন এই পাক ক্রিকেটারের