‘গাধা কিন্তু গাধা নয়’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

‘ তোমাদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড় গাধা , সে উঠে দাঁড়াও ‘ , অধ্যাপক বললেন ।
আসন্ন দোল উৎসবের প্রাক্কালে সবারই মন রঙিন । সেই অবসরে রসিক অধ্যাপক ছাত্রদের বুদ্ধির পরীক্ষা নিচ্ছেন ।
‘ কি হলো , উঠে দাঁড়াও ! ‘
স্তব্ধ ক্লাস । কে আর সাধ করে গাধা হতে চায় । বেশ কিছুক্ষণ পরে একজন উঠে দাঁড়ালো । গোটা ক্লাস জুড়ে হাসির হিল্লোল । অধ্যাপক একগাল হেসে বললেন , ‘ ও , তাহলে তুমিই সেই গাধা !’
ছাত্রটি বিনীত স্বরে বললো , ‘ না স্যার , তা নয় , আসলে আমার মনে হলো আপনি একা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছেন , আপনার প্রশ্নের পর সেটা মোটেই শোভন দেখাচ্ছিল না , তাই আপনাকে সঙ্গ দেওয়া উচিত ভেবে আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। ‘
আবার গোটা ক্লাস জুড়ে তুমুল হাসির হল্লা ।

গাধা নিয়ে গল্পের শেষ নেই ।
এক গাধা পালকের পঞ্চাশটি গাধা । বড় বদমেজাজ সেই মালিকের । পান থেকে চুন খসলেই লাঠির বাড়ি পড়ে গাধাদের পিঠে । লাগাতার মার খেতে খেতে বিপন্ন গাধারা একদিন ঠিক করলো মালিকের এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে তারা বিক্ষোভ দেখাবে । তারা নিজেদের মধ্যে অনেক শলাপরামর্শ করে প্রকাশ্য সমাবেশের ডাক দিলো ।

সমাবেশের শুরুতেই গাধাদের মোড়ল চিৎকার করে বললো , ‘ ভাইসব , তোমরা যদি মালিকের কালো হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাও তাহলে সবাই সমস্বরে গর্জন করো । ‘ অমনি গাধারা সবাই তাদের বিকট স্বরে ‘ ঢেঁচু ঢেঁচু ‘ করে ডেকে উঠলো । সেই বিকট চিৎকার শুনে মালিক লাঠি নিয়ে তেড়ে এসে গাধাদের এলোপাতাড়ি পেটাতে লাগলো । গাধারা মার খেয়ে ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করলো । একটা গাধা চেঁচিয়ে উঠলো ,
‘ আমি তো প্রথমেই বলেছিলাম , প্রকাশ্য সমাবেশের ডাক দেওয়া একেবারেই উচিত হবে না । ‘

নির্বোধ হিসেবে গাধার যতোই বদনাম থাকুক না কেন , আদপে তা মোটেও সত্য নয় । গাধার প্রশংসা করা সহজ না হলেও প্রকৃত অর্থে কিন্তু গাধারা দারুণ বুদ্ধিমান প্রাণী। তারা নিরীহ এবং মানুষের অত্যন্ত অনুগত । কারো ক্ষতি তো এরা করেই না , বরং উপকারই করে । মানুষ ‘ গাধা ‘ শব্দটি ব্যবহার করে নেতিবাচক অর্থে । কিন্তু সত্যিটা হলো এই যে , গাধা খুবই বুদ্ধিমান , কর্মঠ ও কর্তব্যনিষ্ঠ । গাধার আত্মপ্রত্যয় ও সম্মানবোধ অন্যান্য প্রাণীদের চেয়ে বেশি। গাধা মোটেও বোকা নয় , বুদ্ধিহীন তো কিছুতেই নয় ।

গাধাকে ঘোড়ার ছোট সংস্করণ বললে খুব ভুল হবে না । অথচ একটি গাধা একই আকারের একটি ঘোড়ার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। গাধার স্মৃতিশক্তি অবিশ্বাস্য । তারা ২৫ বছর আগে দেখা এলাকা এবং অন্য গাধাদের সহজেই শনাক্ত করতে পারে । তারা প্রচণ্ড জেদি । তাদের আত্মরক্ষা করার প্রবল ক্ষমতা আছে । গাধাদের ভয় দেখিয়ে অথবা জোর খাটিয়ে কোনো কাজ করানো যায় না।

এরা প্রখর কৌতুহলী এবং সহজে চমকে ওঠে না । এরা স্বাধীন থাকতে ভালোবাসে এবং নিজেদের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারে । একটি গাধা মরু পরিবেশে ৬০ মাইল দূরে থেকেও অন্য গাধার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে পারে । ঘোড়ার চেয়ে বড় কান গাধাদের শীতল থাকতে সাহায্য করে । গাধা একা থাকতে পছন্দ করে না । সঙ্গী হিসেবে অন্য প্রাণী তাদের পছন্দ । একজন দক্ষ পশুপালক পশুদের নেতা হিসেবে গাধাকেই বেছে নেবেন । কেননা খামারে পালিত পশুরা অন্য হিংস্র পশুদের দ্বারা আক্রান্ত হলে তাদের রক্ষা করতে গাধাই প্রথমে এগিয়ে আসে । গাধা কিন্তু নেকড়ে বাঘ বা অন্য শিকারীদের হাত থেকে সবাইকে রক্ষা করতে পারে সঙ্কেতের সাহায্যে । প্রাণী হিসেবে এরা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

গাধা বা গর্দভের বৈজ্ঞানিক নাম ইকুস আফ্রিকানাস এসিনাস । ঘোড়া পরিবারের অযুগ্ম খুরযুক্ত চতুস্পদ প্রাণী গাধা কালক্রমে গৃহপালিত পশুতে পরিণত হয়েছে । বিশ্বসভ্যতার ঐতিহ্য গড়তেও গাধার ভূমিকা কম নয় । আদিকালে যখন গাড়ি ছিল না তখন এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পণ্য পরিবহনে গাধাদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম । মিশরীয় ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা সমূহের অধিকাংশ ধাতু বহন করা হয়েছিল গাধাদের মাধ্যমে ।
প্রাচীন গ্রিক সভ্যতায় সঙ্কীর্ণ পথের ওপর কাজ করার জন্য ব্যবহার করা হতো গাধাদের ।

রোমান সেনারা গাধাদের কৃষি পণ্য বহনকারী প্রাণী হিসেবে ব্যবহার করতো । ভারতের মরু অঞ্চলে , বিশেষ করে রাজস্থান প্রদেশের বেশ কিছু জায়গায় অন্যতম বাহন গাধা । এছাড়া দেশের দুর্গম অঞ্চলে মালপত্র নিয়ে যাত্রী পরিবহনে গাধারাই ভরসা । নোংরা ও ঘোলা জল গাধাদের অপছন্দ । এরা পরিষ্কার জল ছাড়া পান করে না । তরতাজা সবুজ ঘাস এরা খুব পছন্দ করে । খড় খেতেও পছন্দ করে খুব ।

গাধারা তাদের বাচ্চাদের ভীষণ ভালোবাসে । সবসময় তাদের আগলে রাখে । অন্য প্রাণীদের দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষেত্রেও গাধাদের কোনো বিকল্প নেই । এরা ভীষণ দায়িত্বশীল । অসুস্থ , আহত ও প্রতিবন্ধী প্রাণীরা গাধাদের তত্ত্বাবধানে থাকতে পছন্দ করে । গাধাদের মত সহৃদয় ও স্নেহশীল প্রাণী খুব বেশি নেই ।

প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী মা শীতলা অর্থাৎ শীতলা দেবীর বাহন গাধা । মায়ের একহাতে কলস ও অন্য হাতে ঝাড়ু । ভক্তদের বিশ্বাস এই যে , কলস থেকে সুধা দান করেন মা এবং ঝাড়ুর মাধ্যমে রোগাক্রান্তদের রোগ দূর করেন । আফ্রিকান বন্য গাধা থেকে উদ্ভূত একটি উপ-প্রজাতি অথবা একটি পৃথক প্রজাতি হিসেবে এদের চিহ্নিত করা যেতে পারে । ৫০০০-৭০০০ বছর আগে আফ্রিকায় এরা গৃহপালিত শান্ত পশু ও কর্মজীবী হিসেবে মানুষের একান্ত আস্থাভাজন ও আপন হয়ে উঠেছিল । এরপরেও কি আর কাউকে
‘ গাধা ‘ ব’লে বিদ্রুপ করা উচিত হবে ?

আরও পড়ুন- ভোট চলাকালীন সমাজমাধ্যমে প্রচার! ফের রাহুলের বি.রুদ্ধে কমিশনে অ.ভিযোগ বিজেপির

Previous articleভোট চলাকালীন সমাজমাধ্যমে প্রচার! ফের রাহুলের বি.রুদ্ধে কমিশনে অ.ভিযোগ বিজেপির
Next articleপড়ুয়াদের পাশে পশ্চিমবঙ্গ মারওয়াড়ি সম্মেলন শিক্ষা কোষ