অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও গোঁয়ার মনোভাব ঠিক কতটা বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে ৩ রাজ্যে হারের পর তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন অশোক গেহলট, কমল নাথ, ভূপেশ বাঘেলরা। অন্যদিকে তেলেঙ্গানায় পরিস্থিতি বিচার করে সঠিক পরিকল্পনা সাজিয়ে নির্বাচনী যুদ্ধে নেমে সাফল্যের বাহবা পাচ্ছেন একদা পিকের সহকর্মী সুনীল কানুগোলু।

হিন্দি বলয়ে ৩ রাজ্যে গোহারা হারের পর কংগ্রেসের কাঠগড়ায় এখন ৩ নেতা অশোক গেহলট, কমল নাথ, ভূপেশ বাঘেল। গোষ্ঠী কোন্দলতো ছিলই, একইসঙ্গে রাজস্থানে নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের ভোটকুশলী সুনীল কানুগোলু নিজস্ব সমীক্ষা চালিয়ে বলেছিলেন, সিংহভাগ মন্ত্রী-বিধায়কের বিরুদ্ধে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। তাঁদের সরিয়ে অন্যদের প্রার্থী করতে হবে। কিন্তু অশোক গহলৌত তা মানতে চাননি। কারও কথায় কান না দিয়ে নিজের মতো করে পছন্দের লোককে প্রার্থী করেছিলেন। মধ্যপ্রদেশে কমল নাথের নেতৃত্বে প্রদেশ কংগ্রেস চার বার সমীক্ষা চালিয়েছিল। চারটি সমীক্ষাতেই দেখা গিয়েছিল, কংগ্রেস জিতছে। কিন্তু সুনীল কানুগোলুর সমীক্ষা অন্য কথা বলেছিল। কমল নাথ মানতেই চাননি। এখানেও সেই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। একই ভাবে ছত্তিশগড়ে বিদায়ী মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলের হাতেই ছিল রাজ্যের সরকার ও কংগ্রেসের সংগঠনের রাশ। সেখানেও টি এস সিং দেও-র মতো বাকি নেতাদের কার্যত কোণঠাসা করে রেখেছিলেন বাঘেল। শেষ বেলায় সিং দেও-কে উপমুখ্যমন্ত্রী করে কংগ্রেস হাইকমান্ড বাঘেলকে সবাইকে নিয়ে চলার বার্তা দিয়েছিলেন। মোট কথা তিন রাজ্যের ভোটে কংগ্রেস হাইকমান্ড এই তিন নেতার উপরেই পুরোপুরি রাশ ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিন জনের কেউই এআইসিসি-র নেতাদের রাজ্যে বিশেষ নাক গলাতে দেননি। তা সে রণকৌশল তৈরি হোক বা প্রার্থী বাছাই।

তবে একমাত্র তেলঙ্গানায় সুনীল কানুগোলুকে ভোটকুশলী হিসেবে নিয়োগ করে পুরো ক্ষমতা দিয়েছিল কংগ্রেস। যার পরিকল্পনাতেই তেলেঙ্গানা রাজ্য গঠনের পর প্রথম সেখানে ক্ষমতায় এলো কংগ্রেস। উল্লেখ্য, কর্ণাটকে কংগ্রেসের জয়ের পিছনেও মূল ভূমিকা ছিল এই কানুর। অথচ রাজস্থানে অশোক গেহলট, মধ্যপ্রদেশে কমলনাথ, ছত্তিশগড়ে ভূপেশ বাঘেল সুনীল কানুগোলুর উপদেশ মেনে কাজ করতে চাননি। নিজেদের মতো করে ইচ্ছামতো প্রার্থী দেওয়া, প্রচারের পরিকল্পনা করেছিল তাঁরা। অভিযোগ মধ্যপ্রদেশে শিবরাজ মুখ্যমন্ত্রী মুখ না হয়েও যেভাবে প্রচার করেছেন, তার সিকিভাগও করেননি কমল। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে কমল নাথের চাপে রাজ্যের ভারপ্রাপ্ত এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক জে পি আগরওয়ালকে সরিয়ে রণদীপ সুরজেওয়ালাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। সুরজেওয়ালার দায়িত্বে কর্নাটকে কংগ্রেস জিতলেও তিনি মধ্যপ্রদেশে কমল নাথের কাছে পাত্তা পাননি। শুধু তাই নয়, এই রাজ্যে সপা আসন সমঝোতা করতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি কমলের আপত্তিতে।

একই হাল রাজস্থানে। কংগ্রেস হাইকমান্ডকে রাজ্যে বিশেষ নাক গলাতে দেননি অশোক গেহলট। রাজস্থানে গেহলটের মূল অস্ত্র ছিল সরকারের জনমুখি প্রকল্প। মুখ্যমন্ত্রীর গদি আঁকড়ে থাকবেন বলে কংগ্রেস সভাপতির পদও নিতে চাননি। ভোটের আগে প্রার্থী বাছাইয়ের সময় তিনি পছন্দের লোকেদের প্রার্থী করা নিয়ে জেদ ধরেছিলেন। তা নিয়ে রাহুল গান্ধী-মল্লিকার্জুন খড়গের সঙ্গে তাঁর মতানৈক্য হয়। সচিন পাইলটের দাবি ছিল, তরুণ প্রজন্মের নেতাদের প্রার্থী করা হোক। তা পুরোপুরি মানেননি গেহলট। তবে কংগ্রেসের কাছে সবচেয়ে আকস্মিক হার ছত্তিশগড়ে। এখানেও বাঘেলের বেপরোয়া মানসিকতা, সিং দেও-এর সঙ্গে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব সবকিছুকে ছাপিয়ে শেষ বেলায় মহাদেব অ্যাপ দুর্নীতি কংগ্রেসের জন্য মারণ অস্ত্র হয়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, গত পাঁচ বছর বিজেপি ছত্তিশগড়ে সে ভাবে লড়াইয়ে ছিল না বলে বঘেল অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন।

অবশ্য হার থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের শোধরাতে তৎপর হয়েছে কংগ্রেস। আগামী লোকসভা নির্বাচনের রণকৌশল তৈরির ভার তেলেঙ্গানার ‘নায়ক’ ভোটকুশলী সুনীল কানুগোলুর হাতে তুলে দিতে চাইছে। উল্লেখ্য, সুনীল ২০১৪-য় প্রশান্ত কিশোরের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদির প্রচারে কাজ করেছেন। কিশোর বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করার পরে সুনীলই ছিলেন বিজেপির ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রিলিয়ান্ট মাইন্ডস’-এর প্রধান। ২০১৭-য় উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে পিকে যখন কংগ্রেসের দায়িত্বে, তখন সুনীল বিজেপির ভোটের রণকৌশল তৈরির দায়িত্বে ছিলেন। উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথের সরকার গঠন হয়। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন, ২০২১-র বিধানসভা নির্বাচনে তামিলনাড়ুতে ডিএমকে-র জয়ের পিছনেও ছিল সুনীলের মস্তিষ্ক।
