‘দ্য লাস্ট সাপার’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

” এটাই তোমাদের সঙ্গে আমার শেষ নৈশভোজ । তোমাদের মধ্যে একজন বিশ্বাসঘাতকতা করবে আমার সঙ্গে । ” যিশুর মুখে এমন কথা শুনে তাঁর শিষ্যরা চমকে উঠলেন , শুধু একজন নির্বিকার বসে রইলেন । তিনি জুডাস । শেষ নৈশভোজে যিশুখ্রীস্টের ১২ জন শিষ্যের অন্যতম তিনি । বাকি শিষ্যদের প্রতিক্রিয়া একেকজনের একেকরকম । তাঁদের হাতের ভঙ্গি , মুখের অভিব্যক্তি নাটকীয় ।

” কী বলছেন প্রভু , এও কি সম্ভব ” ? ” হে প্রভু , আপনি কি আমাকেই ইঙ্গিত করছেন” ? ” না না , এ কখনও হতে পারে না প্রভু , আপনি আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারেন না ” । ” প্রভু , আমি বিশ্বাস করি না এমন খারাপ কাজ আমাদের মধ্যে কেউ করতে পারে ” ! ” প্রভু , দয়া করে বলুন আমাদের মধ্যে কে সেই বিশ্বাসঘাতক ” । ” প্রভু , আপনি আমাদের ক্ষমা করুন ” ।

শিষ্যদের নিয়ে শেষ নৈশভোজে যিশুখ্রীস্টের এই ভবিষ্যদ্বাণী , আর শিষ্যদের নাটকীয় প্রতিক্রিয়াগুলি তুলে ধরেছিলেন শিল্পী লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চি তাঁর ‘ দ্য লাস্ট সাপার ‘ ছবিতে । অসামান্য এই চিত্রটিতে দেখা যায় শিষ্যদের কারো মুখে ভয় ও উদ্বেগ , কারো মুখে সন্দেহ , কারো মুখে বিষন্নতার বেদনা । শুধু জুডাস প্রতিক্রিয়াহীন ।

বাইবেলের গল্প অনুযায়ী জুডাস বেইমানি করেন এবং যিশুখ্রীস্টের মৃত্যু ডেকে আনেন । গল্পে আছে , জুডাস যিশুর সঙ্গে একই সময়ে নিজের অজান্তে পাউরুটিতে হাত রাখবে । লিয়োনার্দো তাঁর ছবিতে জুডাসকে বাঁদিক থেকে চতুর্থ স্থানে বসিয়েছেন । ছবিতে জুডাসই একমাত্র , যাঁর কনুই টেবিলের ওপর ভর দেওয়া , যাঁর বাঁ হাতটি যিশুর সঙ্গে একই সময়ে পাউরুটির দিকে এগিয়ে এসেছে । জুডাসের সামনে একটা লবনদানি উল্টে পড়ে আছে ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন , এর মধ্যে দিয়ে শিল্পী লিয়োনার্দো ‘ নিমকহারাম ‘ বা ‘ নমকহরাম’-এর ইঙ্গিত দিয়েছেন । ‘ Betary the salt’ কথাটির উৎপত্তি সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যে । ইতালিয়ান লোকাচারে নুন উল্টে ফেলা খুবই অশুভ ব্যাপার বলে ধরা হয় ।‌জুডাস ছাড়াও এই চিত্রে আরেকটি ফিগার নিয়ে নানা রহস্য ও কৌতূহল আছে । যিশুখ্রীস্টের ডানদিকে প্রথম ফিগারটি হল সর্বকনিষ্ঠ শিষ্য অ্যাপোস্টল জন-এর । অনেকেই মনে করেন লিয়ো সুকৌশলে পুরুষ নয় , একটি নারীমূর্তি এঁকেছেন এবং সম্ভবত এটি মেরি ম্যাগদালেনের । কথিত আছে , ম্যাগদালেন যিশুর অবিবাহিত স্ত্রী এবং তাঁর সন্তানের মা । যদিও এই বিষয়টি ক্যাথলিকরা মানেন না , এ নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই ।

লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চি বিশ্ববিশ্রুত ইতালিয়ান চিত্রশিল্পী । অবিস্মরণীয় শিল্পকর্ম ‘ মোনালিসা ‘ তাঁরই সৃষ্টি । ‘ দ্য লাস্ট সাপার ‘ শিল্পকর্মটি সম্পূর্ণ করতে তাঁর তিন বছর সময় লেগেছিল । ১৪৯৫ থেকে ১৪৯৮ সাল । এটি একটি দেয়ালচিত্র ( মুরাল ) । এই অসামান্য চিত্রটি এখন শোভা পাচ্ছে ইতালির মিলানের সান্তা মারিয়া দেলে গ্রাজির ডাইনিং হলের পিছনের দেওয়ালে । দ্য ভিঞ্চি যিশুর মুখ ফুটিয়ে তোলার জন্য দীর্ঘ সময় নিয়েছিলেন , যাতে যিশুর মুখে একটা অভিব্যক্তিহীন পবিত্রতার আবহ রচনা করা যায় ।

যিশু তাঁর মৃত্যুর আগে তাঁর বারোজন শিষ্যকে নিয়ে যে নৈশভোজ সারেন ( যাকে সান্ধ্যভোজ বলেছেন কেউ কেউ ) তারই চিত্র এই ‘ দ্য লাস্ট সাপার ‘ । এই নৈশভোজে সমবেতভাবে রুটি ভাগ করে খাওয়া হয় এবং মদ্যপান করা হয় । এখানেই যিশু আভাস দেন তাঁর মর্মান্তিক পরিণতির এবং প্রিয় শিষ্যদের মধ্যেই লুকিয়ে থাকা একজনের দিকে ইঙ্গিত করেন , যিনি বিশ্বাসঘাতকতা করবেন ।

শিষ্যদের রুটি ও মদ দেখিয়ে যিশু জানান যে , এই রুটি তাঁর দেহ এবং মদ তাঁর রক্ত । পরের দিনই এক শিষ্যের বিশ্বাসঘাতকতায় মৃত্যুবরণ করতে হবে তাঁকে । মিলে যায় যিশুর ভবিষ্যদ্বাণী । তিরিশটা রূপার মুদ্রার লোভে জুডাস ইস্কারিওট যিশুকে চিনিয়ে দেন শত্রুপক্ষের কাছে । বাইবেলের এই নাটকীয় বর্ণনার দৃশ্য এঁকেছেন অনেকেই । কিন্তু জনপ্রিয় হয়ে ওঠে লিয়োনার্দোর শিল্পকর্ম ‘ দ্য লাস্ট সাপার ‘ ।

রেনেসাঁ যুগের কালজয়ী চিত্রকর লিয়োনার্দো দা ভিঞ্চির এই দেয়ালচিত্র নিয়ে অসংখ্য গল্প ও জল্পনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । এখানে উল্লেখ্য যে , ভয়ঙ্কর অপরাধীদের মুখও নির্বিকার ও অভিব্যক্তিহীন হয় । তাদের মাথা ঠাণ্ডা থাকে । তারা অসম্ভব ধূর্ত হয় । কিন্তু তাদের মুখে একটা চাপা ক্রুরতা লক্ষ্য করা যায় , যেটা সহজে লুকোনো যায় না । জুডাসের গোপন নৃশংসতা এবং আপাত অভিব্যক্তিহীন মুখ অসামান্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তুলেছেন লিয়োনার্দো । আর যিশুর মুখে এনেছেন প্রশান্ত সারল্য ও এক আকাশ পবিত্রতা , যা বিশ্বমানবতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ পুরুষের মুখেই মানায় ।

আরও পড়ুন- দাঁড়াতে হবে না লম্বা লাইনে! বাড়ি বসেই সম্ভব গ্যাস ও Aadhaar লিঙ্ক, কীভাবে?

Previous articleগোয়ার কাছে ১-৪ গোলে হারলো মোহনবাগান
Next articleরেখার কথায় চোখ ছলছল অমিতাভের! কেবিসির মঞ্চে আবেগপ্রবণ বিগ বি