
বিদায় বন্ধুগণ , গনগনে
আঁচের মধ্যে শুয়ে
এই শিখার রুমাল নাড়া
নিভে গেলে
ছাই ঘেঁটে দেখে নেবেন
পাপ ছিল কিনা ।

মানুষের জন্য পাথর ভাঙতে ভাঙতে একসময় নিজেই ভেঙে পড়েন কবি । শেষ হয়ে যান । পুড়ে যায় জীবন নশ্বর। ফসিল হয়ে যান ক্রমশ । তখন অক্সিজেনের অভাবে আর কষ্ট পান না । ভেঙে পড়ার আগে জেনে যান দেহ মানে ক্ষুধা ও যৌনতা ছাড়া কিছু অনিবার্য পরম্পরা । জীবনের জন্য , মানুষের জন্য , সমাজ ও সভ্যতার জন্য সর্বস্ব সমর্পণ করে নিঃস্ব হয়ে যান প্রকৃত কবি । তারপর একসময় নির্বাপিত হন । তবু কী আশ্চর্য ! কখনও কবির মুখে শোনা যায় না অপাত্রে দানের আক্ষেপ । বরং জীবনব্যাপী কাজের বিশুদ্ধতা নিয়ে মানুষের সংশয়ে ভীষণ আহত বোধ করেন । ক্ষতবিক্ষত হন ।
মাত্র ৪২ বছরের মাথায় পৃথিবীকে দুচ্ছাই করে বিদায় নিয়েছিলেন কবি তুষার রায় ।
রেখে গিয়েছিলেন মাত্র দু’খানি গ্রন্থ , আর অপ্রকাশিত বেশ কিছু অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ।
কবি মৃদুল দাশগুপ্তের বয়ানে তুষারের কবিতা যেন বাংলা কবিতায় বিদ্যুতের ঝলক । ছড়াতেও নিজেকে কিছুটা ছড়িয়ে গেছেন সুরসিক তুষার।

ছড়া লিখলো তুষার
বেরলো বই বাজারে
বিকোবে ঠিক হাজারে ।

১৯৭৭-এর ১১-ই নভেম্বরের ভোরে দেড়’শো টাকার পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে শুকনো কাঠের বিছানায় গা এলিয়ে দেন তুষার । নির্বিকার , নিশ্চিন্তে ঘুম । গনগনে আগুনের শিখা রুমাল নাড়তে থাকে । যে ক্ষয়রোগ একদিন বিস্তর ভুগিয়েছে কবিকে , তা আজ চিরকালের জন্য অন্তর্হিত হওয়ার পথে । আর কোনোদিন আগুনখেকো তুষারকে ডাকবে না স্যানিটোরিয়ামের বিছানা ।
কবিও আর কখনও লিখবেন না ,
বিপ্লব যবে শুরু হয়েছিল
তুমি ছিলে পুরোভাগে
ধর-পাকড়ের মাহেন্দ্রক্ষণে
তুমিই ভেগেছো আগে ।
অথবা , লিখবেন না আর কোনোদিন ,
নির্বাচনে জিতলে পরে
নাচতে এলো রায়বেশে
আগে ছিলেন সিপিআইএম
এবার এলেন কংগ্রেসে ।

আসলে শত্রুমিত্র উভয়কেই ভুলভাল ভালবাসার তালিকায় রেখে প্রকৃত অর্থে ভালবাসাকেই অপমান করতে ভালো লাগতো না কবির । কিন্তু নিরুপায় জীবনের কিছু ঘৃণ্য বাধ্যতা ছায়ার মতো অনুসরণ করতো কবিকে । তুষার আসলে ছিলেন আগুনের গোলা ।

যে লোকটা কাঠের ক্রুশ
তৈরি করছে
অথবা যারা বানাচ্ছে
পেরেক আমার জন্য
তাদের দিকে তাকিয়ে
জানতে পারি
আমিই সেই যিশু
কিংবা কালোবাজারি
যাকে ঝোলানো হবে
নিকটবর্তী ল্যাম্পপোস্টে
তখন আমি ভালোবাসতে
শুরু করি ল্যাম্পপোস্টকেও

তুষারের জন্ম ১৯৩৫-এর ২৬ মে । জমিদার বাড়ির ছেলে । পড়াশোনায় তেমন মন ছিল না । তাঁদের পারিবারিক আয় একসময় তলানিতে এসে ঠেকায় কিছু রোজগারের আশায় হাতে কলম তুলে নেন তুষার । ‘ শেষ নৌকা ‘ ও ‘ তিমির তলপেটে সুখ ‘ পড়লে সামান্য চেনা যায় তুষার কবিকে । তাঁর ‘ ব্যান্ডমাস্টার ‘ অসামান্য । শেষ নৌকার সমালোচনায় বিরক্ত হয়ে তুষার লিখেছিলেন , শেষ নৌকা সম্পর্কে বঙ্গবাজারে ছিরিকপানি সমালোচনা ও যুববাণী মারানো ফচকের ফ্যাচর ফ্যাচর ইত্যাদি দেখে মনে হলো এখনো কোনো মহান নিরীক্ষা বোঝা বা বোঝানোর মত পাঠক তৈরী হয় নি এই দেশে ।

মাত্র ৪২ আয়ুর জীবনে একদা এক বন্ধুকে চুপিচুপি জানান , আই ইউজ টু প্লে ডেথ ডেথ । তাই বোধহয় নিজের স্মৃতিফলকের জন্য ‘ মরুভূমির আকাশে তারা’-য় কিছু ছাই লিখে যান তুষার :

সেই কবি শুয়ে আছে এইখানে
তিনটি বুলেট নিয়ে
শুয়ে আছে এইখানে
সেই কবি মিছিলের
ঠিক পুরোভাগে ছিল
তিনটি বুলেট তাকে
শুইয়ে রাখে নি যেন ,
ভ্যালেরির মতন
ফিরেছে সেই কবি ;
ফিরে এসে তিনটি বুলেটে
ঠিক মৃত্যুকে কিনে
শুয়ে আছে ।

শুধু কি বিপ্লব ? খোঁপাবাঁধা চুলে গন্ধরাজ বসিয়ে প্রেয়সীকে আরও সুন্দর করে তোলার নিবিড় বাসনা ও বিশ্বাস নিয়ে চলে গেলেন কবি । বসতভিটা , প্রিয় পুকুরপাড় , ভালবাসা , স্বাধীনতাস্পৃহা , জন্মভূমিকে শেষবারের মতো প্রণাম করার ইচ্ছে ছড়িয়ে রইলো তুষারের কবিতায় । কবিতার খোরাক জমে জমে পাহাড় হয়ে যায় । সেই পাহাড় কেটে বানানো হয় পথ । এর শেষ নেই ।

মেয়েটির শরীর আর
ছেলেটির বিস্ময় , সারা রাত
সারা বছর
অসমাপ্তির কবিতা ছুটে চলে
পৃথিবীর প্রেমিক প্রেমিকার ।

চাঁদের আলোয় পুড়তে থাকা
তুষার , যিনি আগুনের বন্ধু ও কবি । তাঁর সদা স্বতস্ফুর্ত ধ্বনি হিল্লোল অবজ্ঞা করবে কে ?
আজ আত্মার ট্রিগারে হাত
সুতরাং চাঁদমারি —
তোমার গোল চক্কর চোখ
বন্ধ করো ,
আজ একলব্যের
নীল তপস্যা সিদ্ধ …

প্রথাগত কবিতার বাজারকে টলিয়ে দিয়ে বাংলা কবিতার অরণ্যে এনেছিলেন বেপরোয়া বাতাস । শব্দ-ছন্দ নির্মাণে এবং প্রয়োগেও । বিস্ময় , বিদ্রুপ ও সন্দেহে দুলে দুলে এই নগরের এক মৃত্যুমুখর ম্যাজিশিয়ান রচনা করেছিল এই নগরেরই জাদু আখ্যান । মানুষ মানুষের প্রতিটি জানলা , প্রতিটি মুখোশ যিনি খুলতে চেয়েছেন,
স্বেদে , রোমে , ছালে ও চামড়ায় মানুষের পোশাক খুলে ফেলতে চেয়েছিলেন ।

স্টিল লাইফের মতো যিনি দেখতে চেয়েছিলেন রক্ত , হাড় , মেদমজ্জা ও ক্ষয়িত লিভার । মনুমেন্টের চূড়ায় উঠে যিনি বলতে চেয়েছিলেন :
মশায় আপনারা দেবেন বলেছিলেন সার , বীজ
বলে গছিয়ে গেলেন
এমন চিজ ,
যাতে তিক্ত বিরক্ত আমি …
তীব্র স্যাটায়ারে নিজের যথাযথ অবস্থান খোঁজেন কবি তুষার :
ইনি ওনার , উনি তাহার ,
বাংলা বাজার
উনি রামের , ইনি বামের ,
আমি কাহার ।
কার আবার ? একদা রতনবাবু রোডের এক গুজরাতি পরিবারের মেয়ে সারদা প্যাটেলের সাথে সাতপাকে বাঁধা পড়তে চেয়েছিলেন কবি । সায় দেয় নি রায় পরিবার । সারদারা কলকাতা ছেড়ে চলে যায়।
আজ এতবছর পরেও কে জানে কী যাদুবলে রসিক বাঙালি পাঠকের মন থেকে মনান্তরে হেঁটে বেড়ান তুষার।
শেষে কী লিখে গেলেন কবি ?
একলা একসঙ্গে কল্পনার
সোমরস পান করেছিলাম
আজ বড়ো একা লাগে
সারাক্ষণ লোডশেডিং ,
কিছুই করার নেই তেমন
এমন সময় কে যেন ডাকে
চৌকাঠ টপকে রেলিঙে
ঝুঁকে দেখি
চাঁদের আলোয় তুষার
পুড়তে থাকে ।
আরও পড়ুন- অসমে ভরাডুবি, বাংলায় আকাশ ছোঁয়া প্রত্যাশা! কংগ্রেসকে তীব্র কটাক্ষ অভিষেকের