Sunday, August 24, 2025
উৎপল সিনহা

স্যাটা বোসকে মনে আছে ? ঝকঝকে , স্মার্ট , ইংরেজ আদব- কায়দা অনুশীলনে সর্বদা তৎপর সেই বোহেমিয়ান বাঙালি , যাঁর আসল নাম সত্যসুন্দর বসু , মনে পড়লো ? বাঙালির পক্ষে স্যাটা বোসকে ভোলা বড় সহজ নয় । কারণ স্যাটা বোসের কথা ভাবলেই অবধারিতভাবে একটা গান এসে দাঁড়ায় স্মৃতির সরণিতে।

সেই যে ,
বড় একা লাগে এই আঁধারে
মেঘের খেলা আকাশ পারে …
( কণ্ঠ : মান্না দে , অভিনয় : উত্তমকুমার )

এটি ‘ চৌরঙ্গী ‘ ছায়াছবির গান । দারুণ জনপ্রিয় । মণি শংকর মুখোপাধ্যায়ের ( শংকর ) উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল ১৯৬৮ সালে । ছবির পরিচালক পিনাকী ভূষণ মুখোপাধ্যায় । সুরকার তথা সঙ্গীত পরিচালক অসীমা মুখোপাধ্যায় । স্যাটা বোসের ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করেন উত্তমকুমার । তাঁর বিপরীতে নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন অঞ্জনা ভৌমিক । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য , এই ছবির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত তিন ব্যক্তিত্ব গত ফেব্রুয়ারিতে একে একে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। আশ্চর্য সমাপতন।

১৭ ফেব্রুয়ারি , ১৯২৪ চলে যান অঞ্জনা ভৌমিক । ২০ ফেব্রুয়ারি বিদায় নেন অসীমা মুখোপাধ্যায় । আর ২৯ ফেব্রুয়ারি চলে গেলেন মিল্টু ঘোষ , ‘ বড় একা লাগে ‘ গানের স্রষ্টা । মৃত্যুকালে গীতিকারের বয়স হয়েছিল প্রায় ৯০ ।

মিল্টু ঘোষের লেখা গান ‘ এসো মা লক্ষ্মী বসো ঘরে ‘ ছাড়া আজও বাঙালির লক্ষ্মীপূজা সম্পূর্ণ হয় না । এঁর লেখা জনপ্রিয় গানের তালিকা বেশ দীর্ঘ । হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া বিখ্যাত গান ‘ ও আকাশ সোনা সোনা ‘ এবং ‘ জীবনের অনেকটা পথ ‘ বাঙালি শ্রোতাদের দারুণ পছন্দের । এছাড়াও ‘ কাজল কাজল কুমকুম ‘ ( গীতা দত্ত ) , ‘ মন্দ বলে লোকে ‘ ( মুকেশ ) আজও মানুষের স্মৃতিতে অমলিন ।

ছোটবেলায় দারুণ ফুটবল খেলতেন মিল্টু । কবিতাও লিখতেন খুব । যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা মিল্টু যে গীতিকার হিসেবে একদিন স্বনামধন্য হয়ে উঠবেন তা তিনি নিজেও কোনদিন ভাবেন নি । কোনো একটি অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত সুরকার সুধীন দাশগুপ্তের সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর । বেশ কয়েকটি গান তাঁর হাতে তুলে দেন মিল্টু । তার মধ্যে ‘ কাজল কাজল কুমকুম’ পছন্দ হয়ে যায় সুরকারের । ব্যস , আর পিছন ফিরে তাকাতে হয় নি মিল্টুকে। রাজ্য সরকারের পরিবহন দপ্তরের কর্মী মিল্টু ঘোষ দীর্ঘ চার দশক ধরে বাংলা গানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেন , তারপর একসময় হঠাৎই অন্তরালে চলে যান । অভিমান অথবা যে কোনো কারণেই হোক , নতুন করে আর যোগাযোগ করেন নি গানের জগতের সঙ্গে ।‌ ছায়াছবির জন্য গান লেখা ছিল তাঁর অন্যতম প্যাশন । তাঁর অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ‘ তুই কি আমার পুতুল পুতুল সেই ছোট্ট মেয়ে ‘ আজও গেঁথে আছে বাঙালি শ্রোতাদের মনে । তাঁর লেখা ‘ ওগো বন্ধু আমার ‘ কে ভুলতে পারে ?

মিল্টুরা ছিলেন চার ভাই ও দুই বোন । কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজে পড়াশোনা করা মিল্টু ১৯৬৯ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন শুভ্রাদেবীর সঙ্গে । ‘ এক তাজমহল গ’ড়ো হৃদয়ে তোমার আমি হারিয়ে গেলে ‘ মিল্টুর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃজন ।

আজকের প্রজন্মের ছেলেমেয়েরাও গুনগুন করে এই গান । সুরকার নচিকেতা ঘোষ । এই গান অমরত্ব লাভ করেছে প্রেমের গান হিসেবে । গেয়েছেন পিন্টু ভট্টাচার্য । ‘ জানি না কখন সে যে কিছুকিছু পিছুটান রেখে গেছে ‘ গানটিও পিন্টু ভট্টাচার্যের গাওয়া । সুরকার অনল চট্টোপাধ্যায় । এ প্রসঙ্গে পিন্টু ভট্টাচার্য ও অনল চট্টোপাধ্যায়ের যৌথতায় তৈরি মিল্টুর আরেকটি গান ‘ ফিরে যেতে চাই যেতে চাই ‘ উল্লেখ্য ।

বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী অপরেশ লাহিড়ীর বাড়িতে গুণীজনদের আড্ডায় নিয়মিত যাতায়াত ছিল মিল্টুর । সেখান থেকে অনেক শিখেছিলেন তিনি । মৃণাল চক্রবর্তীর সুরে ও কণ্ঠে থেকে গেছে মিল্টুর স্মৃতিমেদুর গান ‘ কেন জানি না যে শুধু তোমার কথাই মনে পড়ে ‘ । ‘ ও ময়না রে এই গয়না রে আর সয়না রে ‘ মিল্টুর আরেকটি অতি জনপ্রিয় সৃষ্টি ( কণ্ঠ : মুকেশ , সুর : ভি বালসারা ) ।

‘ প্রথম প্রেম ‘ নামে একটি বাংলা চলচ্চিত্রে মিল্টু ঘোষ প্রথমবারের মতো ছায়াছবির জন্য গান লেখার সুযোগ পান। সেই ছবিতে অভিনয় করেন ফুটবলার চুনী গোস্বামী। গতবছর ‘ এসো মা লক্ষ্মী ‘ গানের ৫০ বছর পূর্ণ হয়েছে । এই গান ব্যবহৃত হয়েছিল ‘ দাবি ‘ ছবিতে । গেয়েছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় । সুরকার অনল চট্টোপাধ্যায় ।

মিল্টু ঘোষ থাকতেন বরানগরে মতিলাল মল্লিক লেনে । ‘ টগবগ টগবগ ঘোড়া ছুটিয়ে ‘ দীর্ঘ চার দশকের সঙ্গীত-সফর যেন শেষ হয়েও হলো না শেষ । বাংলা গানের স্বর্ণযুগের অন্যতম সেরা গীতিকার মিল্টু ঘোষ বাংলা গানের ইতিহাসে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছেন । তাঁর ভাণ্ডারে রয়ে গেছে বেশ কিছু অবিস্মরণীয় গান । শুধু প্রেম , বিরহ আর চাঁদ-ফুল-জোছনা নয় , মানুষের জীবনের প্রতিটি মূল্যবান অনুভূতি ও উপলব্ধিকে ভাষা দিতে চেয়েছিলেন তিনি তাঁর গানের মাধ্যমে । লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করে গেছেন মানুষের জীবন সংগ্রাম । তাই মানুষ তাঁকে আজও ভোলে নি ।

আরও পড়ুন- ফরওয়ার্ড ব্লকের আপত্তিতেই চিড় বাম-আইএসএফের জোটে! নওশাদদের হাত ছাড়ল আলিমুদ্দিন

Related articles

বিহারে এত পাক নাগরিক! জানেই না প্রশাসন

বাংলার অরক্ষিত সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকদের অনুপ্রবেশ নিয়ে চিৎকার করছেন অমিত শাহ। এবার সীমান্তে অমিত শাহের (Amit Shah)...

চলন্ত ট্রেনের ওপর ছিঁড়ে পড়ল বিদ্যুতের তার, আতঙ্কিত যাত্রীরা

বড়সড় ট্রেন দূর্ঘটনার হাত থেকে রক্ষা। সঠিক সময়ে ট্রেন দাঁড় না করালে রবিবার সকালেই ঘটে যেত এক ভয়ঙ্কর...

দরিদ্রতম মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, দেশে সবচেয়ে ধনী মুখ্যমন্ত্রী কে? রইল তালিকা

দেশে কোটিপতি মুখ্যমন্ত্রীদের ভিড়ে ব্যতিক্রম শুধু একজন। তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়(Mamata Banerjee)। বর্তমানে দেশে সবথেকে গরিব মুখ্যমন্ত্রী তিনি।...

ধর্ষিত মূক- বধির-বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিশোরীর পাশে নেই যোগী সরকার!

যোগীরাজ্যে(Yogi Adityanath) মূক ও বধির বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিশোরীর(Disabled Girl) নৃশংস ধর্ষণ (Brutal Rape)। পাশে দাঁড়ায়নি সরকার। ফলে মেয়েকে...
Exit mobile version