নিঃসঙ্গতার শতবর্ষ, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

” মানুষ বুড়ো হয়ে যায় বলে স্বপ্নের পেছনে ছোটা বন্ধ করে দেয় এটা ঠিক নয় , বরং তারা স্বপ্নের পেছনে ছোটা বন্ধ করে দেয় বলেই বুড়ো হয়ে যায় । ” ( লাভ ইন দ্য টাইম অফ কলেরা )

একশো বছরের নিঃসঙ্গতার কথক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ নোবেল পুরস্কার গ্রহণের পর তাঁর ভাষণে বলেন , ” এই পুরস্কার আসলে লাতিন আমেরিকার সব কবির , ভিখারিদের , বাজনদারদের , দার্শনিকদের ,
যুদ্ধবাজদের আর লম্পটদের জন্য ” ।

দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে আশ্চর্য সব কথা বলে গেলেন ম্যাজিক রিয়ালিজমের অন্যতম গুরু । এখানে হুবহু তুলে ধরা যাক সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত কিছু অংশ :

নিজেকে নিয়ে রসিকতা করার সময় মাঝেমাঝে আমার মনে হয়েছে যে আমার কোনো সাহিত্য শিক্ষা নেই । কল্পনা ও অভিজ্ঞতা মিশিয়ে আমি লিখি । আমার লেখালিখির গুরু হলেন ফকনার , হেমিংওয়ে প্রমুখ ।
এঁরা তো পরদেশী লেখক । কলম্বিয়ার শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে নিদারুণভাবে কমই জানি আমি । কলম্বিয়া অবশ্যই আমাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে , তবে তা কিন্তু এখানকার সাহিত্য নয় । কোনো বইপত্র নয় ‌। আমার মনে হয় যা আমার চোখ খুলে দিয়েছে তা হলো সঙ্গীত , বিশেষ করে লোকগীতি । আজ থেকে তিরিশ বছর আগে ম্যাগডালেনা উপত্যকার বাইরে এক কোনায় চর্চা হতো এর । আর আমার মনোযোগ ছিল মূলত গানগুলোর ফর্মের দিকে , এগুলো কিভাবে একটা কাহিনী বয়ান করে , একটা গল্প বলে চলে … খুব সাধারণ ও স্বতস্ফূর্ত এর কারুকাজ । তারপর যখন লোকগীতি বানিজ্যিকভাবে আসা শুরু হলো , দেখা গেলো ভাব আর ছন্দই প্রধান হয়ে উঠলো । এই লোকগীতিই যেন আমার দাদু গাইতেন , আমার মনে আছে । পরে যখন আমি স্প্যানিশ রোমান্সেরো-এর ব্যালাড লেখা শুরু করলাম , দেখলাম যে এদের মধ্যে অভূতপূর্ব নান্দনিক মিল রয়েছে । রোমান্সেরো-এর মধ্যে আমি আমার লোকগীতিকে আবিষ্কার করলাম ।

সঙ্গীতই আমাকে সব থেকে বেশি প্রশান্ত করে ।‌ মাঝেমাঝে মানুষ খুব অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠে , এমনকি গোপন কথা নিয়ে আলোচনা করার সময় মানুষ যেমন পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে , তার চেয়েও বেশি আপন হয়ে ওঠে যখন তারা সঙ্গীত নিয়ে আলোচনা করে । সকালবেলা মোৎসার্ট শোনাই ভালো । ড্যানিয়েল স্যাটোস , মিগুলিয়েটো ভ্যালডেস প্রমুখ সঙ্গীতজ্ঞদের তাত্বিকেরা ভালো চোখে না দেখলেও আমি কিন্তু তাঁদের থেকে প্রচুর নিয়েছি । আমি কোনো জিনিসের মধ্যে বিভেদ তৈরি পছন্দ করি না ।

প্রতিটি জিনিসেরই একটা মূল্য আছে । সঙ্গীত থেকে আমার পাওয়ার শেষ নেই । প্রতিদিন আমি অন্তত দু’ঘন্টা গান শুনি । আমার মানসিক অবস্থা ঠিক রাখে সঙ্গীত । আমার মানস ভ্রমণের প্রধান সহায়ক সঙ্গীত।
লোকে বলে যেখানে বই থাকে সেটাই ঘর । আমার মনে হয় যেখানে গানের রেকর্ড আছে সেটাই আমার ঘর। আমার পাঁচ হাজারের বেশি রেকর্ড আছে ।

এবার কবিতার কথা । মূলত আমার লিটারারি ব্যাকগ্রাউন্ড হলো কবিতা , কিন্তু তা হলো বাজে কবিতা । এই বাজে কবিতাগুলোই আমার কাছে ভালো কবিতা হিসেবে আসতো । স্কুলের পাঠ্য বইয়ের কবিতা পড়েও আমি প্রভাবিত হয়েছি । তবে বিশ্বসাহিত্য বুঝতে হলে কলম্বিয়ার কবিতার কাছে আসতে হবে ।‌ স্প্যানিশ সাহিত্যও আমি প্রচুর পড়েছি। বিভিন্ন ধরনের লেখা । কোনো বাছবিচার করি নি । আমি জানি না আমি কিভাবে উপন্যাস লেখায় জড়িয়ে গেলাম । কবিতাই আমাকে বেশি আন্দোলিত করতো । আমি মনে করতে পারছি না ঠিক কখন আমি উপলব্ধি করলাম যে , আমি যা বলতে চাই তা উপন্যাসেই সম্ভব । সম্ভবত কাফকার মেটামরফসিস ছিল আমার কাছে একটা বিবর্তনের মতো। এটা পড়ার পর প্রায় ৬ বছর আমি কিছু লিখতে পারি নি ।

আমার দাদুও গভীর কোনো বিষয় এমনি নির্বিকারভাবে বলে যেতেন । আমি তখন ভাবতে শুরু করলাম মানবসভ্যতার শুরুর পর থেকে আজ পর্যন্ত জগতে কী কী ঘটে গেছে ।‌ তখন আমি লেখাপড়া ছেড়ে দিলাম।‌ কিছুদিন পর গল্প লেখা শুরু করলাম । তারপর বোগোটা ছেড়ে দিলাম দাঙ্গার জন্য । উপকূল ছেড়ে চললাম অন্যত্র। সংবাদপত্রে চাকরি জোটালাম । ফেলে আসা সেই উপকূলকে আমি বিশদে ব্যাখ্যা করতে চাই না ।‌ তারপর ক্রমাগত লিখতে লাগলাম যেন একটা জ্বরের ঘোরের মধ্যে লিখে চলেছি ।

‘ লিফস্টর্ম ‘ বইটি আমার খুব পছন্দের । এর লেখকের প্রতি আমার সমবেদনা আছে ।‌ আশ্চর্য ব্যাপার । একটা ২২-২৩ বছরের ছেলে যে সে আর জীবনে কিছুই লিখবে না। সে মনে করে এটাই তার একমাত্র পরিবর্তন । তার যা কিছু মনে আছে সমস্তই সে ভুলে যেতে চায় । শিল্প-সাহিত্যের নানা ধরনের কৌশল যা সে শিখেছে বা বড়ো লেখকদের মধ্যে যা যা সে দেখেছে তার সমস্ত কিছু সে ভুলে যেতে চায় । ক্রমে ক্রমে আমি উপলব্ধি করি যে , কাফকার বাস্তবতা আর আমার ফেলে আসা উপকূলের বাস্তবতা এক নয় ।

আমেরিকান ঔপন্যাসিকদের আমি যথাযথভাবে চিনতে শিখলাম । আমেরিকান বাস্তবতার তীব্র রূপান্তর আর প্রকাশ ছিল ফকনারের লেখায় । তাঁদের কাছ থেকে আমি একটা বীক্ষণ শক্তি পেয়েছি ।‌ বেশ্যাপাড়া , শহর , সঙ্গীত ( বিশেষত লোকগীতি ) আর দৈনন্দিন জীবন মিলেমিশে একাকার মাথার মধ্যে , ভাবনায় । কঠোর বাস্তবতাকে উন্মোচিত করা নয় , একটু অন্যভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছি । সংকেত নির্ভর লেখা লিখতে চেয়েছি । ( মার্কেজ : অটাম )

একসময় এক মিনিটের জন্য একটা কফির কাপ হাতে এক কোনায় বসলে আমি এমন একটা পৃথিবী খুঁজে পেতাম যা খুবই আলাদা । কিন্তু যখন উপকূল ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হলো তখন বুঝলাম বাস্তবতা কাকে বলে । বই – পড়া পৃথিবী আর বাস্তব দুনিয়ার একটা সম্পর্ক সেদিন খুঁজে পেলাম ।

আরও পড়ুন- বাংলার রাজনীতি মানেই দুর্নীতি! কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কমিশনে নালিশ তৃণমূলের

Previous articleবাংলার রাজনীতি মানেই দুর্নীতি! কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কমিশনে নালিশ তৃণমূলের
Next articleসুপার সানডে: রবিবাসরীয় রোড শো-তে আজ ঘাটালে অভিষেক-দেব