Saturday, August 23, 2025
উৎপল সিনহা

মেয়েটির তিন-তিনটি ইন্দ্রিয় বিকল , রুদ্ধ । তবু তার বুকে জেগে থাকে এক অপরূপ আশা , দেখা হবে , দেখা হবে , তাঁর সাথে একদিন ঠিক দেখা হবে ।

এই আশায় , এই আনন্দে তার কোমল দেহকক্ষের একাধিক রুদ্ধদ্বারের কথা প্রায়ই ভুলে যায় সে ।‌ তার স্থির বিশ্বাস , একদিন এক অবিনশ্বর আলো এসে দাঁড়াবে তার মুখোমুখি , উদ্ভাসিত হবে তার জীবন , ধন্য হবে মানবজীবন।

 

মাত্র ১৯ মাস বয়সে এক কঠিন অসুখে তাঁর শরীরে মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয় । তাঁর দু’চোখের দৃষ্টি চলে যায় । একইসঙ্গে তিনি মূক ও বধির হয়ে পড়েন । তাঁর ছ’বছর বয়সে তাঁর বাবা ও মা তাঁকে নিয়ে যান প্রসিদ্ধ বিজ্ঞানী তথা টেলিফোনের আবিষ্কারক আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল-এর কাছে । তিনি প্রাথমিকভাবে নিরীক্ষণ করে রায় দেন যে , মেয়েটি চোখে দেখতে পাবে না , কানেও শুনতে পাবে না , তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী তার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হলে হেলেন স্বাভাবিক জীবনের কাছাকাছি একটি সুন্দর জীবন পেতে পারে , কারণ সে খুবই মেধাবী ‌।
তারপর ব্রেইল পদ্ধতিতে তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় এনি সুলিভান নামে একজন গৃহশিক্ষিকার কাছে । ইনি নিজেও একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ছিলেন । হেলেনের জীবনে এই শিক্ষিকার অবদান অপরিসীম । ১০ বছর বয়সে নরওয়েতে উদ্ভাবিত এক পদ্ধতি অনুসরণ করে কথা বলা শেখেন হেলেন কেলার ।

দ্রুত উন্নতি করতে থাকেন পড়াশোনায় । ১৯০৪ সালে হেলেন প্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হিসেবে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন । তার আগেই তাঁর আত্মজীবনী ‘ দ্য স্টোরি অফ মাই লাইফ ‘ প্রকাশিত হয় ।

সমাজের বাক , শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সারা জীবন কাজ করে গেছেন হেলেন কেলার । তিনি আমেরিকান মেয়ে । তাঁর জীবদ্দশায় যুক্তরাষ্ট্রের সকল প্রেসিডেন্ট ছাড়াও মার্ক টোয়েন , চার্লি চ্যাপলিন প্রমুখ বিখ্যাত মানুষদের সহায়তা পান তাঁর কাজে । ১৯১৫ সালে ‘ হেলেন কেলার ইন্টারন্যাশনাল ‘ নামে একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন বিশেষ রূপে সক্ষম ব্যক্তিদের জন্য , যা এখনও নিরন্তর কাজ করে চলেছে । বাক , শ্রবণ ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং গণমানুষের সহায়তা অর্জনে নিবেদিত প্রাণ হেলেন কেলার সামাজিক আন্দোলনের ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন আরও একটি কারণে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে আহত , পঙ্গু ও বিকলাঙ্গদের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছেন নির্ভয়ে সেবা ও শুশ্রূষার দায়িত্ব নিয়ে এবং তাঁদের জুগিয়েছেন ভরসা ও আশ্বাস। নিজের শারীরিক অসহায়তা তুচ্ছ করে বারবার দাঁড়িয়েছেন দুর্গত ও বিপন্নদের পাশে । নিজের শরীর ও মন জুড়ে নেমে আসা অতল অন্ধকার সরিয়ে বারবার আলোকিত করেছেন নিজেকে এবং তাঁর সামাজিক পরিপার্শ্বকে ।

আমার দু’চোখ থেকে তারা দৃষ্টি সরিয়ে নিলো , যেখানে যা হওয়া উচিত ছিল , কিন্তু আমি স্মরণে রেখেছি মিল্টনের হারানো স্বর্গ ।

আমার শ্রবণশক্তি তারা কেড়ে নিলো , যেখানে যা হওয়া উচিত ছিল , বিটোফেন এসে মুছিয়ে দিলো আমার অশ্রু।

আমার জিভ অসাড় করে দিলো তারা , যেখানে যা হওয়া উচিত ছিল। ছোট থেকেই আমার ঈশ্বরের সাথে কথা হয়, অফুরান কথা। আমার আত্মাকে সরানোর অনুমতি তিনি কাউকে দেবেন না ।
( হেলেন কেলার , ২৭ জুন , ১৮৮০ — ১ জুন , ১৯৬৮ )

অপরাজিতা এই মেয়ে । এরই সম্মুখে একদিন এসে দাঁড়াবেন কান্তিময় আলোর এক দিশারী । ‘ অন্ধকারের উৎস হতে ‘ এসে যিনি অন্যতম পথপ্রদর্শক হয়ে উঠবেন হেলেন কেলারের । হেলেনের জীবন যেন এক রূপকথা । মহামান্য মার্ক টোয়েনের মতে হেলেন কেলার উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষ । ব্রেইল হরফে রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন হেলেন । তখন থেকেই তাঁর একান্ত ইচ্ছা কবিকে দেখার , তাঁর সঙ্গে কথা বলার । তারপর একদিন এলো সেই বহুকাঙ্খিত দিনটি । অসামান্য কিছু মুহূর্ত । ‘ মিড স্ট্রিম মাই লেইটার লাইফ ‘ বইয়ের একটি অধ্যায়ে হেলেন লিখে গেছেন তাঁর জীবনের সেই মহা মূল্যবান দিনটির কথা ।

রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন বিশ্বভারতীর জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে । বড়ো পৃথিবীর প্রাণের জোয়ার শান্তিনিকেতনের প্রাণধারার সঙ্গে মেলানোর জন্য । এখানে একটি কমিউনিটি হল-এ ‘ The meeting of East and West ‘ প্রবন্ধটি পাঠ করেন রবীন্দ্রনাথ । প্রবন্ধটির বক্তব্যে মুগ্ধ হন হেলেন কেলার । হেলেন পড়েছিলেন ‘ গীতাঞ্জলি ‘ ও ‘ গার্ডেনার ‘ ।

রবীন্দ্রনাথও উৎসাহী ছিলেন হেলেনের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়ে। কবির কাছে এসে উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন হেলেন । কবির মুখ , ঠোঁট ও কণ্ঠ স্পর্শ‌ করে হেলেন যেন ছুঁতে চাইলেন এক মহামানবের হৃদয়কে । এরপর যেন সত্য ও সুন্দরের উপাসনার মাঝেই প্রাণের আরাম ও আত্মার শান্তি গভীরভাবে উপলব্ধি করলেন তিনি । আলো বিনিময়ের সূত্রে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের গভীর বন্ধুত্ব মরণসাগরপারে অমর হয়ে রইলো ।

আরও পড়ুন- আচমকাই উড়ে এল ইট! প্রচারে বেরিয়ে আহত জগন, চিকিৎসা সেরেই ‘কামব্যাক’

বিপুল সুদূরের আহ্বান শুনেছিলেন দুজনেই । এই আন্তরিকতাই মিলিয়ে দিলো দুই কৃতীকে । রবীন্দ্রনাথকে আশ্রয় করেই বাকি জীবন কাটালেন হেলেন কেলার । লিখে গেলেন , ‘ প্রত্যেক মানুষেরই মনের অতলে রয়ে গেছে সবুজ মাটি আর টলটলে জলের স্মৃতি । অন্ধত্ব বা বধিরতা আমাদের পূর্বপুরুষদের দেওয়া এ অধিকার লুট করে নিতে পারে না । উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া এ ক্ষমতা অনেকটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মতো — আত্মার ইন্দ্রিয় , যা একইসঙ্গে দেখে , শোনে এবং অনুভব করে ‘ ।

 

 

Related articles

ফের ডুরান্ড কাপ জয় নর্থইস্টের

প্রতিযোগিতায় দুরন্ত শুরুটা করলেও শেষরক্ষা করতে পারল না। একটানা ম্যাচ। নর্থইস্ট ইউনাইটেডের(North East United) বিরুদ্ধে খানিকটা ক্লান্তিটাই যেন...

‘মাখন চোর’ বলা যাবে না! কৃষ্ণের লীলা বদলানোর চেষ্টা মধ্যপ্রদেশে, কড়া জবাব বিরোধীদের

এবার বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর আজব দাবি! কৃষ্ণের লীলা বদলানোর চেষ্টা করছে গেরুয়া শিবির। শ্রীকৃষ্ণকে ‘মাখন চোর’ বলায়...

মোদি-শাহ যেখানে যাবে, সেখানেই জিতবে তৃণমূল

মোদি-শাহ বাংলার যেখানে পা দেবে সেখানেই জিতবে তৃণমূল কংগ্রেস (TMC)। ওরা যত ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করবে তত ভোট বাড়বে...

বাংলা ভাষার অপমান মানব না, সরব গর্বিত বাঙালি ঋতুপর্ণা

বিজেপি রাজ্যে বাংলাভাষীদের হেনস্থা, ক্রমাগত বাংলা ভাষার অপমানে গর্জে উঠেছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। বাংলা ভাষা ও বাঙালির...
Exit mobile version