Wednesday, May 21, 2025

‘যদি সত্যি বলো’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

প্রতিভার ভার দুর্বহ । বিপথচালিত হওয়ার আশঙ্কা পদে পদে । তারপর যদিও বা পথ পাওয়া গেলো সেও বড়ো দুর্গম , কণ্টকাকীর্ণ । প্রতিভার পথে পথে পাথর ছড়ানো চিরকাল । মেধাকে হিংসে করে নিম্নমেধা। প্রতিভার বড়ো শত্রু সম পেশার প্রতিভাবান শিল্পীরাও । এখানেই মুশকিল।

নিরন্তর সাধনায় পরিপূর্ণ শিল্পী হিসেবে যদিও বা নিজেকে মঞ্চে ওঠার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা গেল তখন বাধার পাহাড় এসে পথ আটকায় । সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে নিজেকে সফলভাবে উপস্থাপিত করতে কেউ কেউ পারেন বটে , কিন্তু অনেকেই পারেন না , তাঁরা হাল ছেড়ে দেন , হতাশার অন্ধকারে ডুবে যান , একা হয়ে যান , একসময় হারিয়ে যান ।

শিল্প-সাহিত্য হোক কিংবা খেলাধুলো , সঙ্গীত অথবা রাজনীতি , সর্বত্রই সর্বক্ষণ চলতে থাকে প্রতিভাকে দমিয়ে রাখার এই জটিল কুটিল খেলা । নৃশংস নির্মম খেলা । ছলে-বলে-কৌশলে কে কাকে পদদলিত করে এগিয়ে যেতে পারে তার একটা কর্দমাক্ত , অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা চলতেই থাকে বিরামহীন । এই ইঁদুরদৌড়ে অধিকাংশই ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে , আবার অনেকে এই নোংরামির প্রতি ঘৃণায় , আত্মধিক্কারে নিজেদের গুটিয়ে নেয় ।

কে না জানেন ভালো সবসময় কম , মন্দ বেশি । আলো কম অন্ধকার বেশি । বিচার কম , অবিচার বেশি । এও তো সকলেরই জানা যে , শিল্পী অনেক , মানুষ কম । তার ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া স্বজনপোষণ । সরকারি অথবা বেসরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠানে কিংবা সংস্থায় প্রায় সব যুগেই কিভাবে যেন তৈরি হয়ে যায় একধরনের স্বজন-বলয় । একটা কোটারি । এই বলয় এতটাই দুর্ভেদ্য যে , দারুণ প্রভাবশালী না হলে এখানে প্রবেশ নিষেধ । এখানে প্রবেশপত্র পেতে গেলে শুধু প্রতিভাবান হওয়াই যথেষ্ট নয় , চাই অর্থবল , চাই অবিরাম তৈলমর্দনের অভ্যাস , চাই স্তাবকতার ক্ষমতা । এগুলো যাদের নেই তারা অবিচারের শিকার হবেই। প্রভাবশালীদের নোংরা খেলায় কত যে প্রতিভা অকালে ঝরে যায় তার হিসেব রাখে না কেউ । দুর্ভাগ্যের বিষয় , এইসব ঘৃণ্য চক্রান্তের নেতৃত্বে থাকেন এমন কয়েকজন বড়োমাপের শিল্পী , আপামর জনসাধারণের কাছে যাঁরা ঈশ্বরপ্রতিম । তাই এই নোংরা খেলা , এই হীন চক্রান্ত , এই পাপ ঢাকা থাকে অধিকাংশ সময় । জনসমক্ষে আসে না । চক্রান্তের শিকার হয়ে অকালে , চোখের আড়ালে ঝরে পড়ে প্রতিভা ।

এমনই এক মেঘে ঢাকা তারার নাম যতীন ভট্টাচার্য । ইনি সরোদ শিল্পী । বাবা আলাউদ্দিন খাঁর অন্যতম প্রিয় শিষ্য । যাঁকে ১৯৫৭ সালের ৮-ই আগস্ট আশীর্বাণী পাঠান উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ , ” কলিকাতা তোমাকে নিমন্ত্রণ করেছে ।

.. কলিকাতা হলো সঙ্গীতের বিচারের স্থান । এখানকার শ্রোতারা রাগ বিচার করে । আমার মতো রুখা বাজনা বাজাবে না । আশীর্বাদ করি সেখানে খুব নাম করো । ” সে বছর তানসেন সঙ্গীত সম্মেলনেই প্রথম প্রকাশ্যে অনুষ্ঠান করেন বেনারস- প্রবাসী এই সরোদিয়া । তারপর সুনাম ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয় নি । একাধিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ , আকাশবাণী থেকে সরাসরি সম্প্রচার ছাড়াও ১৯৭২ সালে এইচ এম ভি থেকে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম এল পি রেকর্ড। অ্যালবামের এক পিঠে স্ব-সৃষ্ট সম্পূর্ণ-কানাড়া রাগ এবং অন্য পিঠে রাগ মারোয়া । নিজের নয় কানওয়ালা সরোদের মাথায় রুপো দিয়ে বাঁধানো পাতে থাকতো বাবা আলাউদ্দিনের ছবি । অথচ ভীষণ আশ্চর্যের বিষয় এই যে , ১৯৭৬- এর পর তাঁকে আর রেডিওতে পাওয়া যায় নি । রটিয়ে দেওয়া হয় তিনি নাকি অসুস্থ । কী ভয়ঙ্কর চক্রান্ত !

যতীনের জন্ম বেনারসে , সেখানেই কেটেছে জীবন । পড়াশোনায় দারুণ মেধাবী যতীনের হওয়ার কথা ছিল অধ্যাপক , কিন্তু সুরের অমোঘ আকর্ষণ তাঁকে অন্য কিছু হতে দিলো না । সুরের জগতে কাটালেন বটে , কিন্তু তাঁর ভালোবাসার জগতেই এমন অবিচারের শিকার হলেন যা শুনলে সঙ্গীত জগতের অন্ধকার দিকের কথা ভাবতেই হয় । আপাত সুন্দর এই সঙ্গীতজগতের আনাচে কানাচে প্রায় সবসময়ই চলতে থাকে নানা কুৎসিত কর্মকাণ্ড , যার জেরে অনেক প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটে ।

কী এক দুর্বোধ্য কারণে যতীন ভট্টাচার্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এইচ এম ভি । তাঁর কাছে অনুষ্ঠান পরিবেশনের জন্য দেশ-বিদেশের আমন্ত্রণ আসতো , কিন্তু রহস্যময় কারণে অনুষ্ঠানের ঠিক আগে সেগুলো বাতিল হয়ে যেতো । মিথ ও মিথ্যের বিড়ম্বনা তাঁর জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল ।

২০২০ সালে তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন অরিন্দম সাহা সর্দার । তথ্যচিত্রের নাম , ‘ যদি সত্যি কথা বলো ‘ । এই তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে অশ্রুত , বিস্মৃত এবং বঞ্চিত শিল্পী যতীন ভট্টাচার্যের জীবন ।

এমন তো হওয়ার কথা ছিল না , তবু সঙ্গীত জীবনের মধ্যগগন থেকে কীভাবে কোথায় হারিয়ে গেলেন তিনি ? এ প্রশ্নের উত্তর রয়ে গেল সম্ভবত ভবিষ্যতের গর্ভে।

আরও পড়ুন- সিভিয়ার সাইক্লোনে পরিণত হয়েছে রেমাল! বাতিল লোকাল ট্রেন, বন্ধ ফেরি সার্ভিস

 

spot_img

Related articles

বুধে উত্তরকন্যায় মুখ্যমন্ত্রীর প্রশাসনিক বৈঠক, উত্তরবঙ্গ উন্নয়নে জোর রাজ্যের

বুধবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর তিন দিনের উত্তরবঙ্গ সফরের শেষ দিনে উত্তরকন্যায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন।...

IPL-এর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে সম্মেলনের প্রচার SFI-এর! কী বলছেন সৃজন

CPIM-এর মতো বাম ছাত্র সংগঠনগুলির সমর্থনও কি তলানিতে? না হলে কেন সর্বভারতীয় সম্মেলনে লোক টানতে আইপিএলকে কাজে লাগিয়েছে...

মামলা যাঁদের, আন্দোলনে উস্কানিও তাঁদের: বাম দ্বিচারিতার পর্দাফাঁস কুণালের

চাকরিহারা শিক্ষকদের নিয়ে দুমুখো রাজনীতি বামপন্থী নেতাদের। একদিকে চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন মঞ্চে গিয়ে সহানুভূতি দেখানো, আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata...

১৩১ পরিবার পেল মাথার ছাদ! বন্যাদুর্গত মানুষদের জন্য ‘তিস্তাপল্লি’ উপহার মুখ্যমন্ত্রীর

তিস্তা নদীর ভাঙনে সর্বস্ব হারিয়েছিল মেজুয়া ও লালডং চুমুকডালি গ্রামের ১৩১ জন মানুষ। আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছিলেন তাঁরা। এবার...