‘যদি সত্যি বলো’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

প্রতিভার ভার দুর্বহ । বিপথচালিত হওয়ার আশঙ্কা পদে পদে । তারপর যদিও বা পথ পাওয়া গেলো সেও বড়ো দুর্গম , কণ্টকাকীর্ণ । প্রতিভার পথে পথে পাথর ছড়ানো চিরকাল । মেধাকে হিংসে করে নিম্নমেধা। প্রতিভার বড়ো শত্রু সম পেশার প্রতিভাবান শিল্পীরাও । এখানেই মুশকিল।

নিরন্তর সাধনায় পরিপূর্ণ শিল্পী হিসেবে যদিও বা নিজেকে মঞ্চে ওঠার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা গেল তখন বাধার পাহাড় এসে পথ আটকায় । সব বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে নিজেকে সফলভাবে উপস্থাপিত করতে কেউ কেউ পারেন বটে , কিন্তু অনেকেই পারেন না , তাঁরা হাল ছেড়ে দেন , হতাশার অন্ধকারে ডুবে যান , একা হয়ে যান , একসময় হারিয়ে যান ।

শিল্প-সাহিত্য হোক কিংবা খেলাধুলো , সঙ্গীত অথবা রাজনীতি , সর্বত্রই সর্বক্ষণ চলতে থাকে প্রতিভাকে দমিয়ে রাখার এই জটিল কুটিল খেলা । নৃশংস নির্মম খেলা । ছলে-বলে-কৌশলে কে কাকে পদদলিত করে এগিয়ে যেতে পারে তার একটা কর্দমাক্ত , অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতা চলতেই থাকে বিরামহীন । এই ইঁদুরদৌড়ে অধিকাংশই ক্লান্ত ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে , আবার অনেকে এই নোংরামির প্রতি ঘৃণায় , আত্মধিক্কারে নিজেদের গুটিয়ে নেয় ।

কে না জানেন ভালো সবসময় কম , মন্দ বেশি । আলো কম অন্ধকার বেশি । বিচার কম , অবিচার বেশি । এও তো সকলেরই জানা যে , শিল্পী অনেক , মানুষ কম । তার ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া স্বজনপোষণ । সরকারি অথবা বেসরকারি যে কোনো প্রতিষ্ঠানে কিংবা সংস্থায় প্রায় সব যুগেই কিভাবে যেন তৈরি হয়ে যায় একধরনের স্বজন-বলয় । একটা কোটারি । এই বলয় এতটাই দুর্ভেদ্য যে , দারুণ প্রভাবশালী না হলে এখানে প্রবেশ নিষেধ । এখানে প্রবেশপত্র পেতে গেলে শুধু প্রতিভাবান হওয়াই যথেষ্ট নয় , চাই অর্থবল , চাই অবিরাম তৈলমর্দনের অভ্যাস , চাই স্তাবকতার ক্ষমতা । এগুলো যাদের নেই তারা অবিচারের শিকার হবেই। প্রভাবশালীদের নোংরা খেলায় কত যে প্রতিভা অকালে ঝরে যায় তার হিসেব রাখে না কেউ । দুর্ভাগ্যের বিষয় , এইসব ঘৃণ্য চক্রান্তের নেতৃত্বে থাকেন এমন কয়েকজন বড়োমাপের শিল্পী , আপামর জনসাধারণের কাছে যাঁরা ঈশ্বরপ্রতিম । তাই এই নোংরা খেলা , এই হীন চক্রান্ত , এই পাপ ঢাকা থাকে অধিকাংশ সময় । জনসমক্ষে আসে না । চক্রান্তের শিকার হয়ে অকালে , চোখের আড়ালে ঝরে পড়ে প্রতিভা ।

এমনই এক মেঘে ঢাকা তারার নাম যতীন ভট্টাচার্য । ইনি সরোদ শিল্পী । বাবা আলাউদ্দিন খাঁর অন্যতম প্রিয় শিষ্য । যাঁকে ১৯৫৭ সালের ৮-ই আগস্ট আশীর্বাণী পাঠান উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ , ” কলিকাতা তোমাকে নিমন্ত্রণ করেছে ।

.. কলিকাতা হলো সঙ্গীতের বিচারের স্থান । এখানকার শ্রোতারা রাগ বিচার করে । আমার মতো রুখা বাজনা বাজাবে না । আশীর্বাদ করি সেখানে খুব নাম করো । ” সে বছর তানসেন সঙ্গীত সম্মেলনেই প্রথম প্রকাশ্যে অনুষ্ঠান করেন বেনারস- প্রবাসী এই সরোদিয়া । তারপর সুনাম ছড়িয়ে পড়তে দেরি হয় নি । একাধিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ , আকাশবাণী থেকে সরাসরি সম্প্রচার ছাড়াও ১৯৭২ সালে এইচ এম ভি থেকে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম এল পি রেকর্ড। অ্যালবামের এক পিঠে স্ব-সৃষ্ট সম্পূর্ণ-কানাড়া রাগ এবং অন্য পিঠে রাগ মারোয়া । নিজের নয় কানওয়ালা সরোদের মাথায় রুপো দিয়ে বাঁধানো পাতে থাকতো বাবা আলাউদ্দিনের ছবি । অথচ ভীষণ আশ্চর্যের বিষয় এই যে , ১৯৭৬- এর পর তাঁকে আর রেডিওতে পাওয়া যায় নি । রটিয়ে দেওয়া হয় তিনি নাকি অসুস্থ । কী ভয়ঙ্কর চক্রান্ত !

যতীনের জন্ম বেনারসে , সেখানেই কেটেছে জীবন । পড়াশোনায় দারুণ মেধাবী যতীনের হওয়ার কথা ছিল অধ্যাপক , কিন্তু সুরের অমোঘ আকর্ষণ তাঁকে অন্য কিছু হতে দিলো না । সুরের জগতে কাটালেন বটে , কিন্তু তাঁর ভালোবাসার জগতেই এমন অবিচারের শিকার হলেন যা শুনলে সঙ্গীত জগতের অন্ধকার দিকের কথা ভাবতেই হয় । আপাত সুন্দর এই সঙ্গীতজগতের আনাচে কানাচে প্রায় সবসময়ই চলতে থাকে নানা কুৎসিত কর্মকাণ্ড , যার জেরে অনেক প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটে ।

কী এক দুর্বোধ্য কারণে যতীন ভট্টাচার্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে এইচ এম ভি । তাঁর কাছে অনুষ্ঠান পরিবেশনের জন্য দেশ-বিদেশের আমন্ত্রণ আসতো , কিন্তু রহস্যময় কারণে অনুষ্ঠানের ঠিক আগে সেগুলো বাতিল হয়ে যেতো । মিথ ও মিথ্যের বিড়ম্বনা তাঁর জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল ।

২০২০ সালে তাঁকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন অরিন্দম সাহা সর্দার । তথ্যচিত্রের নাম , ‘ যদি সত্যি কথা বলো ‘ । এই তথ্যচিত্রে উঠে এসেছে অশ্রুত , বিস্মৃত এবং বঞ্চিত শিল্পী যতীন ভট্টাচার্যের জীবন ।

এমন তো হওয়ার কথা ছিল না , তবু সঙ্গীত জীবনের মধ্যগগন থেকে কীভাবে কোথায় হারিয়ে গেলেন তিনি ? এ প্রশ্নের উত্তর রয়ে গেল সম্ভবত ভবিষ্যতের গর্ভে।

আরও পড়ুন- সিভিয়ার সাইক্লোনে পরিণত হয়েছে রেমাল! বাতিল লোকাল ট্রেন, বন্ধ ফেরি সার্ভিস

 

Previous articleসিভিয়ার সাইক্লোনে পরিণত হয়েছে রেমাল! বাতিল লোকাল ট্রেন, বন্ধ ফেরি সার্ভিস
Next articleরবিবাসরীয় প্রচারে জনসভা, রোড শো অভিষেকের