Sunday, August 24, 2025

‘ভালো যদি বাসো’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

তোর বুঝি ভেঙে গেছে
মাথা নাড়া বুড়ো
ভেঙে গেছে পুতুল
খেলার সংসার ,
সময়ে দেখবি সব
জোড়া লেগে যাবে
চুপ কর বোকা মেয়ে
কাঁদিস না আর ।
( কবীর সুমন )

মেয়েদের পুতুল-জীবন অফুরান । পুতুল শ্বাস , পুতুল আশ , পুতুল প্রাণ , পুতুল আত্মা , পুতুলে বাস ‌। মনের কথা বলতে বলতে পুতুলেই ঘুম । পুতুলকে স্নান করানো , খাওয়ানো , আদর করা , ঘুম পাড়ানো , পুতুলের জ্বরে নাওয়া খাওয়া ভুলে প্রাণপণ শুশ্রূষা চলতেই থাকে শেষদিন পর্যন্ত । আর সেই প্রাণের দোসর যদি কোনভাবে হারিয়ে যায় ? পুতুল হারানো ছোট্ট মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েছেন কখনও ? উঃ , সে কি অন্ধকার ! তাকানো যায় না ।

এ নিয়ে গান , গল্প ও কবিতার শেষ নেই । হারিয়ে যাওয়া পুতুলের হদিশ কখনো মেলে , কখনও মেলে না । মিতুল কিংবা অন্য কোনো নামের পুতুলটি মেয়েদের অন্তর্লীন ভালোবাসার সর্বোত্তম উপাখ্যান বোধহয় । চিরদিনের , চিরকালের ।

ফ্রানৎজ কাফকার জীবনেও পুতুল নিয়ে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে । ‘ মেটামরফসিস’-এর স্রষ্টা , বিশ্ব-সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র ফ্রানৎজ কাফকা বেড়াতে গিয়েছিলেন বার্লিন । তাঁর বয়স তখন চল্লিশ । পড়ন্ত এক বিকেলে বার্লিনের এক পার্কে হাঁটছিলেন তিনি । হঠাৎই চোখে পড়লো একটি ছোট্ট মেয়ে খুব কাঁদছে । কাছে গিয়ে জানলেন , মেয়েটির প্রিয় পুতুলটি হারিয়ে গেছে , তাই তার ব্যাকুল কান্না যেন থামতেই চাইছে না । সান্ত্বনা দিতে চাইলেন কাফকা। বললেন , চলো দুজনে মিলে খোঁজা যাক পুতুলটিকে । শুরু হলো খোঁজ। কিন্তু সারা পার্ক তন্নতন্ন করে খুঁজেও পুতুলের সন্ধান পাওয়া গেল না ।

কাফকা বিষন্ন , হতাশ মেয়েটিকে কথা দিলেন যেভাবেই হোক পুতুলটা তিনি ঠিক খুঁজে বার করবেন এবং সেই কারণেই আবার তিনি এখানে আসবেন । মেয়েটিকেও বললেন পরদিন আবার পার্কে আসতে । পরদিন যথারীতি আবার শুরু হলো খোঁজাখুঁজি । কিন্তু ব্যর্থ হলো তাদের সমস্ত চেষ্টা । পাওয়া গেল না পুতুলের হদিশ ।
তখন ছোট্ট মেয়েটির হাতে একটা চিঠি দিলেন কাফকা । বললেন , এই চিঠিটা তোমার হারিয়ে যাওয়া পুতুলের লেখা।
সেখানে লেখা ছিল ,
” প্লিজ , তুমি আর কেঁদো না ।
আমি পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়েছি। কোন দেশে কি কি দেখলাম সেসব রোমাঞ্চকর কাহিনী তোমাকে আমি নিয়মিত লিখে জানাবো ” ।

এভাবেই শুরু হয়েছিল একটা গল্পের , যা চলেছিল কাফকার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত । মেয়েটির সঙ্গে নিয়মিত দেখা হতো লেখকের । প্রতিটি সাক্ষাতেই লেখক মেয়েটির হাতে একটি চিঠি তুলে দিয়ে বলতেন চিঠিটা তার হারিয়ে যাওয়া পুতুলের লেখা । সেই চিঠিগুলো জুড়ে থাকতো মেয়েটির হারিয়ে যাওয়া পুতুলের অলীক ভ্রমণের আশ্চর্য সব বিবরণ । এভাবেই প্রতিটি চিঠি পড়ার পর একটু একটু করে কমে আসছিল মেয়েটির দুঃখ । ধীরে ধীরে প্রশমিত হয়ে আসছিল পুতুল হারানোর শোক । শেষবার যেদিন মেয়েটির সাথে কাফকার দেখা হয় , সেদিন তাকে একটি পুতুল উপহার দেন তিনি । বলেন , এই নাও তোমার হারিয়ে যাওয়া পুতুল।

কিন্তু পুতুলটি দেখার পর মেয়েটি বলে , এই পুতুলটি মোটেও তার হারিয়ে যাওয়া পুতুলের মতো নয় । কাফকা তখন মেয়েটিকে আরও একটি চিঠি পড়ান যেখানে তার প্রিয় পুতুলটি লিখেছে ,” যেসব পথ ধরে আমি এতদিন এতসব জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি , সেইসব পথই আজ আমাকে এভাবে বদলে দিয়েছে ” । ছোট্ট মেয়ের তখন বিশ্বাস হয় এটিই তার সেই হারানো পুতুল। তখন সে বুকে জড়িয়ে নেয় পুতুলটিকে , ভেসে যায় আনন্দে-উচ্ছাসে । এর বছর খানেক পর মারা যান কাফকা।

তারপর , অনেক বছর পরে , ততদিনে মেয়েটাও অনেক বড়ো হয়ে গেছে , একদিন পুতুলটার কব্জির নিচের দিকে একটা সুক্ষ্ম ফাটলের মধ্যে আরও একটা চিঠি খুঁজে পায় সে ।

আরও পড়ুন- মির্জা গালিব স্ট্রিটে গুলি কাণ্ডে ধৃত ৪, অধরা মূল অভিযুক্ত!

কাফকার সই করা লুকোনো সেই চিঠিতে লেখা ছিল ,
” Everything you love will probably be lost , but in the end , love will return in another way ” .

তোমার ভালোবাসার সমস্ত কিছুই সম্ভবত হারিয়ে যাবে , তবে শেষ পর্যন্ত , ভালোবাসা অন্যভাবে , অন্য পথে ফিরে আসবে । কোনো ব্যক্তি অথবা বিশেষ কোনো প্রিয় বস্তু যা-ই তুমি ভালোবাসো না কেন , তোমার জীবন থেকে কোনো একদিন হঠাৎ করে তা হারিয়ে যেতে পারে চিরতরে , কিন্তু দিনশেষে সেই ভালোবাসা তোমার কাছে অবশ্যই ফিরে আসবে , হয়তো ভিন্ন কোনো রূপে ।

 

 

spot_img

Related articles

পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ‘শ্রমশ্রী’ প্রকল্পে নাম নথিভুক্তি শুরু

পরিযায়ী শ্রমিকদের সুবিধার্থে এবার আরও এক পদক্ষেপ রাজ্য সরকারের। ‘আমাদের পাড়া আমাদের সমাধান’ কর্মসূচির আওতায় দুয়ারে সরকার শিবিরেও...

‘নিখুঁত ভুলগুলি’, উৎপল সিনহার কলম

একটা দুঃখের কথা পথে ও বিপথে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে গান হয়ে ওঠে ...একটি দুঃখের কথা পথে ও বিপথে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে গান...

ষোলতেই ১৩০ কেজি! ছেলের খাবার জোগাতেই নাজেহাল বাবা-মা

মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি থানার কাবিলপুর পঞ্চায়েতের মথুরাপুর গ্রাম। এখানেই থাকেন দিনমজুর মুনশাদ আলি। তাঁর ছোট ছেলে জিশান আলি...

কবে থেকে শুরু জয়েন্টের কাউন্সেলিং? দিনক্ষণ জানিয়ে দিল বোর্ড

ফলপ্রকাশের পর এবার ১৫ দিনের মধ্যেই কাউন্সেলিং প্রক্রিয়া তথা ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করবে জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড। এবার কাউন্সেলিং...