‘ভালো যদি বাসো’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

তোর বুঝি ভেঙে গেছে
মাথা নাড়া বুড়ো
ভেঙে গেছে পুতুল
খেলার সংসার ,
সময়ে দেখবি সব
জোড়া লেগে যাবে
চুপ কর বোকা মেয়ে
কাঁদিস না আর ।
( কবীর সুমন )

মেয়েদের পুতুল-জীবন অফুরান । পুতুল শ্বাস , পুতুল আশ , পুতুল প্রাণ , পুতুল আত্মা , পুতুলে বাস ‌। মনের কথা বলতে বলতে পুতুলেই ঘুম । পুতুলকে স্নান করানো , খাওয়ানো , আদর করা , ঘুম পাড়ানো , পুতুলের জ্বরে নাওয়া খাওয়া ভুলে প্রাণপণ শুশ্রূষা চলতেই থাকে শেষদিন পর্যন্ত । আর সেই প্রাণের দোসর যদি কোনভাবে হারিয়ে যায় ? পুতুল হারানো ছোট্ট মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েছেন কখনও ? উঃ , সে কি অন্ধকার ! তাকানো যায় না ।

এ নিয়ে গান , গল্প ও কবিতার শেষ নেই । হারিয়ে যাওয়া পুতুলের হদিশ কখনো মেলে , কখনও মেলে না । মিতুল কিংবা অন্য কোনো নামের পুতুলটি মেয়েদের অন্তর্লীন ভালোবাসার সর্বোত্তম উপাখ্যান বোধহয় । চিরদিনের , চিরকালের ।

ফ্রানৎজ কাফকার জীবনেও পুতুল নিয়ে এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে । ‘ মেটামরফসিস’-এর স্রষ্টা , বিশ্ব-সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র ফ্রানৎজ কাফকা বেড়াতে গিয়েছিলেন বার্লিন । তাঁর বয়স তখন চল্লিশ । পড়ন্ত এক বিকেলে বার্লিনের এক পার্কে হাঁটছিলেন তিনি । হঠাৎই চোখে পড়লো একটি ছোট্ট মেয়ে খুব কাঁদছে । কাছে গিয়ে জানলেন , মেয়েটির প্রিয় পুতুলটি হারিয়ে গেছে , তাই তার ব্যাকুল কান্না যেন থামতেই চাইছে না । সান্ত্বনা দিতে চাইলেন কাফকা। বললেন , চলো দুজনে মিলে খোঁজা যাক পুতুলটিকে । শুরু হলো খোঁজ। কিন্তু সারা পার্ক তন্নতন্ন করে খুঁজেও পুতুলের সন্ধান পাওয়া গেল না ।

কাফকা বিষন্ন , হতাশ মেয়েটিকে কথা দিলেন যেভাবেই হোক পুতুলটা তিনি ঠিক খুঁজে বার করবেন এবং সেই কারণেই আবার তিনি এখানে আসবেন । মেয়েটিকেও বললেন পরদিন আবার পার্কে আসতে । পরদিন যথারীতি আবার শুরু হলো খোঁজাখুঁজি । কিন্তু ব্যর্থ হলো তাদের সমস্ত চেষ্টা । পাওয়া গেল না পুতুলের হদিশ ।
তখন ছোট্ট মেয়েটির হাতে একটা চিঠি দিলেন কাফকা । বললেন , এই চিঠিটা তোমার হারিয়ে যাওয়া পুতুলের লেখা।
সেখানে লেখা ছিল ,
” প্লিজ , তুমি আর কেঁদো না ।
আমি পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়েছি। কোন দেশে কি কি দেখলাম সেসব রোমাঞ্চকর কাহিনী তোমাকে আমি নিয়মিত লিখে জানাবো ” ।

এভাবেই শুরু হয়েছিল একটা গল্পের , যা চলেছিল কাফকার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত । মেয়েটির সঙ্গে নিয়মিত দেখা হতো লেখকের । প্রতিটি সাক্ষাতেই লেখক মেয়েটির হাতে একটি চিঠি তুলে দিয়ে বলতেন চিঠিটা তার হারিয়ে যাওয়া পুতুলের লেখা । সেই চিঠিগুলো জুড়ে থাকতো মেয়েটির হারিয়ে যাওয়া পুতুলের অলীক ভ্রমণের আশ্চর্য সব বিবরণ । এভাবেই প্রতিটি চিঠি পড়ার পর একটু একটু করে কমে আসছিল মেয়েটির দুঃখ । ধীরে ধীরে প্রশমিত হয়ে আসছিল পুতুল হারানোর শোক । শেষবার যেদিন মেয়েটির সাথে কাফকার দেখা হয় , সেদিন তাকে একটি পুতুল উপহার দেন তিনি । বলেন , এই নাও তোমার হারিয়ে যাওয়া পুতুল।

কিন্তু পুতুলটি দেখার পর মেয়েটি বলে , এই পুতুলটি মোটেও তার হারিয়ে যাওয়া পুতুলের মতো নয় । কাফকা তখন মেয়েটিকে আরও একটি চিঠি পড়ান যেখানে তার প্রিয় পুতুলটি লিখেছে ,” যেসব পথ ধরে আমি এতদিন এতসব জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছি , সেইসব পথই আজ আমাকে এভাবে বদলে দিয়েছে ” । ছোট্ট মেয়ের তখন বিশ্বাস হয় এটিই তার সেই হারানো পুতুল। তখন সে বুকে জড়িয়ে নেয় পুতুলটিকে , ভেসে যায় আনন্দে-উচ্ছাসে । এর বছর খানেক পর মারা যান কাফকা।

তারপর , অনেক বছর পরে , ততদিনে মেয়েটাও অনেক বড়ো হয়ে গেছে , একদিন পুতুলটার কব্জির নিচের দিকে একটা সুক্ষ্ম ফাটলের মধ্যে আরও একটা চিঠি খুঁজে পায় সে ।

আরও পড়ুন- মির্জা গালিব স্ট্রিটে গুলি কাণ্ডে ধৃত ৪, অধরা মূল অভিযুক্ত!

কাফকার সই করা লুকোনো সেই চিঠিতে লেখা ছিল ,
” Everything you love will probably be lost , but in the end , love will return in another way ” .

তোমার ভালোবাসার সমস্ত কিছুই সম্ভবত হারিয়ে যাবে , তবে শেষ পর্যন্ত , ভালোবাসা অন্যভাবে , অন্য পথে ফিরে আসবে । কোনো ব্যক্তি অথবা বিশেষ কোনো প্রিয় বস্তু যা-ই তুমি ভালোবাসো না কেন , তোমার জীবন থেকে কোনো একদিন হঠাৎ করে তা হারিয়ে যেতে পারে চিরতরে , কিন্তু দিনশেষে সেই ভালোবাসা তোমার কাছে অবশ্যই ফিরে আসবে , হয়তো ভিন্ন কোনো রূপে ।

 

 

Previous articleকিশোর-সহ নিমতলা ঘাটে তলিয়ে গেল গাড়ি!
Next article‘মানিকতলা এবার নিজের বৌদিকেই চায়’, সুপ্তি পাণ্ডের সমর্থনে রবিবাসরীয় প্রচারে কুণাল