‘মানিক জ্বলে’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

” পালঙ্ক শুদ্ধু ধরাধরি করে যখন ট্রাকে তোলা হয় তখন একটা চোখ খোলা , একটা বন্ধ ‌। শরীরের ওপর রক্তপতাকা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে । তার ওপরে ফুল । মুখটুকু বাদে সমস্ত শরীরটা ফুলে আর ফুলে ছেয়ে গেছে ।
উপচে পড়ছে দুপাশে …
মাথা এবং পায়ের কাছে দেশনেতা এবং সাহিত্যিক । সামনে পিছনে , দুইপাশে বহু মানুষ । সর্বস্তরের মানুষ । মোড়ে মোড়ে ভিড় । সিটি কলেজের সামনে মাথার অরণ্য । কিন্তু কাল কেউ ছিল না , কিছু ছিল না … জীবনে এত ফুলও তিনি পান নি । ” ( দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা )

” ফুলগুলো সরিয়ে নাও , আমার লাগছে । মালা জমে জমে পাহাড় হয় , ফুল জমতে জমতে পাথর । পাথরটা সরিয়ে নাও , আমার লাগছে।” ( পাথরের ফুল , সুভাষ মুখোপাধ্যায় )

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিন্নহৃদয় বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন ,” সেই ফুলের ভারে সেদিন সত্যিই দামি পালঙ্কের একটি পায়ায় চিড় ধরে গিয়েছিল । ” জীবনে যারে তুমি দাও নি মালা , মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল … গানটি যেন মানিকের জন্যই লেখা হয়েছিলো ।

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথা সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় । মাত্র ৪৮ বছরের জীবনে তিনি ৪০ টি উপন্যাস ও ৩০০ টি ছোটগল্প লিখে গেছেন । এছাড়াও রয়েছে বহু অপ্রকাশিত রচনা। মানুষের মনের অতল অন্ধকার দিকটি বারবার উঠে এসেছে তাঁর কলমে । মধ্যবিত্ত জীবনের ভণ্ডামি , কৃত্রিমতা ও দ্বিচারিতা , শ্রমজীবী মানুষের নিত্য সংগ্রাম , মার্কসীয় শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব এবং ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ তাঁর রচনার বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে এসেছে ।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত , হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় নি , অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে । হয়তো দিনকয়েক আগে নীলরতন সরকারের কাছে নিয়ে গেলে বাঁচানো যেতো । এই অবস্থায় বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায় গভীর বেদনায় মানিকের স্ত্রীকে বলেন , ‘ এমন অবস্থা , আগে টেলিফোন করেন নি কেন ? ‘

অত আশঙ্কা ও দুঃখের ভিতরেও মলিন হেসে ভদ্রমহিলা অস্ফুট উত্তর দিয়েছিলেন , ‘ তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই । ‘ দুঃসহ এই পরিস্থিতি রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার মতো ।

লেখককে শেষ জীবনে ঠাঁই নিতে হয় বস্তিতে । জীবনযুদ্ধে বিপন্ন , পর্যুদস্ত , অসহায় মানুষটি নিজেকে নিংড়ে দিয়েছিলেন সাহিত্য সাধনায়। নিকেলের চশমা , মলিন পোশাক , দীর্ঘকায়-শ্যামবর্ণ- ঋজু- আত্মদর্পী মানুষটি শেষকালে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন , — ” দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায় … ” ।

সাহিত্যে সর্বোচ্চ পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁচে থাকতে কোনো পুরস্কার পান নি ।‌ এমনকি মরণোত্তর পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় আজও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম নেই । এটা ভাবলে অবাক তো হতেই হয়, লজ্জায় মুখ লুকোনোর জায়গা পাওয়া যায় না । ধিক্কার জাগে অন্তরে। কমিউনিস্ট তো অনেক বড়ো কথা , বাংলায় দীর্ঘ ৩৪ বছরের রাজত্বকালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা একবারও মনে পড়লো না কেন বামফ্রন্টের ? তাঁরা তো অনেককেই পুরস্কৃত করেছেন।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কি বুর্জোয়া ? প্রতিক্রিয়াশীল ? তিনি কি তাঁর লেখায় ধনতন্ত্রের জয়গান গেয়ে গেছেন ? পুঁজির দাসত্ব থেকে মানুষের সার্বিক মুক্তির বিরোধী ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ? যদিও এই পুরস্কার পাওয়া না পাওয়ায় সম্ভবত কিছুই যেতো আসতো না নির্লোভ মানিকের। কিই বা হবে এখন ওই পুরস্কারে ! তবু মরণোত্তর পুরস্কার জগতের নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত জনগণের হয়ে কলম ধরার একটা স্বীকৃতি তো বটে।
সেটাও দেওয়া গেল না ৩৪ বছরে ? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপরাধটা কোথায় ?

বেদনাহত মানিক অনুরাগীরা এই না পাওয়ার একটা ব্যাখ্যা অবশ্য দিয়েছেন । তা হলো এই লেখকের একটি বিখ্যাত ছোটগল্প , ‘ কে বাঁচায় , কে বাঁচে ‘ । এমন গল্প তিনি না লিখলেই বোধহয় ভালো করতেন । গল্পটা খুব সরল সোজা । মনে আছে নিশ্চয় । সেই মৃত্যুঞ্জয় , সেই নিখিল । দুজনে একই অফিসে চাকরি করে । দুজনের বন্ধুত্বও খুব । একদিন অফিস যাওয়ার পথে ফুটপাতে মরে পড়ে থাকা একজন মানুষ দেখে ভীষণ বিমর্ষ হয়ে পড়লো মৃত্যুঞ্জয় ।

লোকটি নাকি না খেতে পেয়ে মারা গেছে । না খেতে পেয়ে ? স্রেফ না খেতে পেয়ে মৃত্যু ? না খেতে পেয়ে মরতে একটা মানুষের ঠিক কতটা কষ্ট হয় ? মৃত্যুঞ্জয় এইসব ভাবতে থাকে। ভাবে , সে নিজে বেঁচে থাকতে একটা লোক না খেয়ে মারা গেলো ? সে নিজে এত এত খায় , আর একটা লোক না খেতে পেয়ে মারা যায় ? এইসব ভাবতে ভাবতে মৃত্যুঞ্জয় একসময় খাওয়া বন্ধ করে দেয় । তার নিজের বেতন রিলিফ ফাণ্ডে দান করতে থাকে । প্রথমে একবেলা , তারপর দুবেলাই না খেয়ে থাকতে শুরু করে , সঙ্গে তার স্ত্রীও । বন্ধু নিখিল বিস্তর বোঝায় তাকে । এমন তো কতই ঘটে , না খেতে পেয়ে কতজনাই তো মারা যায় । তাবলে নিজেদের নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাওয়া কি যুক্তিসঙ্গত ? কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় এসব কথা কিছুই বুঝতে চায় না । না খেতে পেয়ে মারা যাওয়া মানুষটির কষ্ট ও তার মৃত্যুর অভিঘাত পাগল করে দেয় মৃত্যুঞ্জয়কে । বন্ধু নিখিলের যুক্তিতর্কের কথাগুলো তার মাথায় ঢোকে না আর , কারণ তার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কাছে তখন কথার মারপ্যাঁচ অর্থহীন হয়ে গেছে ।

তারপর একদিন সবার পিছে সবার নীচে সবহারাদের দলে মিশে যায় মৃত্যুঞ্জয় ।‌ অভুক্ত , চিরদুর্গত মানুষদের অংশ হয়ে পড়ে সে । স্বপ্নে নয় , কল্পনায় নয় , স্লোগানে কিংবা বিপ্লববিলাসে নয় , মধ্যবিত্তের নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব জীবন ছেড়ে সে সর্বহারাদের মাঝে নিজের জীবনের সার্থকতা খুঁজতে থাকে । তথাকথিত বামপন্থাকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া এমন গল্পকারকে মরণোত্তর পুরস্কারই বা কেন দেবেন বামপন্থীরা ?

আরও পড়ুন- লক্ষ্য দুর্নীতি মুক্ত পঞ্চায়েত! এবার বদলি নীতি কঠোরভাবে চালু রাজ্যের

 

Previous articleUEFA Euro 2024 : ‘চ্যাম্পিয়ন’ ইতালিকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে সুইজারল্যান্ড
Next articleবিশ্বকাপে সেরা হয়ে বিরাট ঘোষণা কোহলির,জানালেন এটাই শেষ টি-২০ বিশ্বকাপ