‘এ নদী এমন নদী’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

এ নদীতে নেমো না,

পুড়ে যাবে চোখ ।

জীবন্ত প্রাণীগুলো যখন এ নদীর জলে পড়ে , প্রথমেই পুড়ে যায় তাদের চোখ , অন্ধ হয়ে যায় , ঝলসে যায় , সেদ্ধ হয়ে যায় , গলে গিয়ে ফ্যাটফেটে সাদা হয়ে যায় ।
এ নদীর ফুটন্ত জলে কোনোভাবে পড়ে গেলেই ভবলীলা সাঙ্গ । পুড়ে যাওয়া চোখ নিয়ে ছটফট করতে করতে প্রাণীগুলো প্রাণপণ চেষ্টায় পার হতে চায় নদী ।
তীর খোঁজে , বাঁচতে চায় । কিন্তু যতই এগোতে থাকে ততই পুড়তে থাকে এদের দেহ। ধীরে ধীরে এদের পেশী ও হাড় সেদ্ধ হতে শুরু করে ।

প্রচণ্ড উত্তপ্ত ফুটন্ত জল মুখের ভেতর দিয়ে ঢুকে গোটা দেহ অবশ করে দেয় । প্রাণীগুলো ধীরে ধীরে শক্তি হারাতে থাকে। একসময় মারা যায় । পুড়ে যায় জীবন নশ্বর । ভেসে থাকে এদের গলিত শব । এ অনেকটা যেন রূপকথার মতো , কিন্তু রূপকথা মোটেই নয়। এ পৃথিবীতে সত্যিই আছে ফুটন্ত এক রহস্যময় নদী , যে নদীর জলে আঙুল ছোঁয়ানো মাত্র আঙুল পুড়ে যায় , গভীর ক্ষতচিহ্ন তৈরি হয় পোড়া আঙুলে ।

” আমি নদীতে বিভিন্ন প্রাণীকে মরে পড়ে থাকতে দেখেছি । এরা সবাই পুড়ে ঝলসে মারা গেছে । এটা আমাকে খুব অবাক করেছে ।

কারণ সকল ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াটি প্রায় একইরকম । ” বলেছেন পেরুর ভূ-বিজ্ঞানী আন্দ্রে রুজো , যিনি নিজে সেই নদীর কাছে গিয়ে স্বচক্ষে দেখে এসেছেন কীভাবে এই নদীর ফুটন্ত জলে পুড়ে মরে যায় প্রাণীরা । কখনো কখনো রূপকথার গল্পকেও হার মানায় রুঢ় বাস্তব । রহস্যময় এ নদীর নাম শ্যানাই – টিম্পিশকা । আমাজনের গভীর অরণ্যে রয়েছে এই নদী , যার জল টগবগ করে ফুটছে সবসময় । ২০১৪ সালে টেড এক্স-এর এক বক্তৃতায় এই নদী নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা ও গবেষণালব্ধ প্রায় সমস্ত তথ্যাবলী এবং ফলাফল সকলের সামনে তুলে ধরেন আন্দ্রেজ রুজো ।

তিনি বলেন, আমাজনে কোনো আগ্নেয়গিরি নেই । পেরুর বেশিরভাগ অংশেও নেই । যে জায়গায় এই নদীটি রয়েছে তার থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে রয়েছে নিকটবর্তী আগ্নেয়গিরি । তিনি আমাজনের এই উষ্ণ- প্রস্রবণ স্বচক্ষে দেখে হতবাক হয়ে যান । দূর থেকেই তিনি শুনতে পেয়েছিলেন নদীর জলের মৃদু তরঙ্গের শব্দ । যত কাছে যাচ্ছিলেন শব্দও তত জোরালো হচ্ছিল । অনেকটা সমুদ্রের ঢেউয়ের ক্রমাগত আছড়ে পড়ার শব্দের মতো সেই শব্দ । এরপর নদীর যত কাছে গিয়েছেন দেখেছেন বাষ্প ক্রমাগত নিচ্ছে ধোঁয়ার মতো রূপ । এরপর নদীর জলের গড় তাপমাত্রা মাপেন তিনি । তা ছিল ৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস ( ১৮৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট ) । দ্রুত প্রবাহিত হয় এই গরম নদী । এই নদীকে অনুসরণ করে কিছুটা এগোনোর পর রুজো লক্ষ্য করেন এক অদ্ভুত বিষয় । নদীর পবিত্র স্থান শামানের আখড়া থেকে ঠাণ্ডা স্রোতের প্রবাহ দেখা যায় । এই নদী শামানদের দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ ।‌ তারা এ নদীর জল পান করে । এর বাষ্প গ্রহণ করে । রান্নার কাজে ব্যবহার করে ।‌ এ নদীর জল দিয়ে তৈরি করে ওষুধ । নদীর ধারের তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে গিয়ে এক আশ্চর্য ব্যাপারের হদিশ পান আন্দ্রে । শুরুতে নদীর জল ঠাণ্ডা , তারপর ধীরে ধীরে উত্তপ্ত ও ফুটন্ত , তারপর আবার ঠাণ্ডা , আবার গরম এবং ততক্ষণ উত্তপ্ত যতক্ষণ না ঠাণ্ডা জলের ধারায় গিয়ে মিশছে ।

ইনকাদের কাছে এই নদী ছিল সূর্যদেবের জলস্রোত । সূর্যের তাপেই ফুটতো নদীর জল — এটাই বিশ্বাস ছিল প্রাচীন এই জনজাতির । এঁরা ছিলেন সূর্যের উপাসক ।

পেরুর রাজধানী লিমা-র বাসিন্দা আন্দ্রে রুজো এই নদীর কথা শুনে তাঁর কিশোর বয়সেই ভেবে রেখেছিলেন একদিন না একদিন এই আশ্চর্য নদীর রহস্য উন্মোচন করবেন তিনি । টেক্সাসের সাদার্ন মেথডিস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে জিওফিজিক্স-এ স্নাতক হন তিনি । তারপর তৈরি করেন পেরুর থার্মাল ম্যাপ অর্থাৎ তাপমানচিত্র । এরপর তিনি বুঝতে পারেন যে সূর্যের তাপে নয় , নদী ফুটছে পৃথিবীর ভূভাগের অভ্যন্তরস্থ তাপে ।

তারপর নদীর রহস্য ভেদ করতে ২০১১ সালের নভেম্বরে পেরুর মধ্য অংশ অভিযানে যান রুজো । বহু বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে অবশেষে সন্ধান মেলে সেই নদীর । কিন্তু শেষমুহুর্তেও বাধা । তিনি বহিরাগত , তাই নদীর কাছে যেতে দিতে রাজি নন নদীর তীরবর্তী গ্রামের পুরোহিত সম্প্রদায় ( শামান ) । বিস্তর সাধ্যসাধনার পর মেলে নদীর কাছে যাবার ছাড়পত্র ।

ছয় মাইল লম্বা এই নদীকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে ঘন গাছের সবুজ প্রাচীর । নদীর গভীরতা ১৬ ফুট পর্যন্ত উষ্ণপ্রস্রবণের মতো নিজের খেয়ালেই সে l যাত্রাপথের শেষে মিশে গিয়েছে আমাজনের গভীরে ।

জিওথার্মাল বা হাইড্রোথার্মাল চক্রের বিক্রিয়াই ফুটন্ত জলের নদীর মূল রহস্য । ‘ দ্য বয়েলিং রিভার ; অ্যাডভেঞ্চার অ্যান্ড ডিসকভারি ইন আমাজন ‘ বইয়ে নিজের অভিজ্ঞতা লিখেছেন আন্দ্রে । তিনি বলেন , এই বিস্ময়- নদীকে বাঁচাতে আমাজন অরণ্যে বৃক্ষনিধন বন্ধ করতেই হবে ।

 

 

Previous articleসোমেই ভর্তি, রবিবাসরীয় দুপুরে হুগলি থেকে বর্ধমান কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে পাঠানো হল অর্ণবকে
Next articleতালডাঙায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বেঘোরে প্রা.ণ গেল এক তরতাজা যুবকের