Friday, May 23, 2025

‘বিলাসখানি টোড়ি’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

তুমি যে সুরের আগুন
লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে
এ আগুন ছড়িয়ে গেল
সব খানে
যত সব মরা গাছের
ডালে ডালে নাচে আগুন
তালে তালে রে …

গান গেয়ে আগুন জ্বালানো কি মুখের কথা ? তবু আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলতে পারেন কেউ কেউ । যিনি গান গেয়ে আগুন জ্বালাতে পারেন , তিনি নিশ্চয়ই সে আগুন নেভানোর মন্ত্রও জানেন ।
সুরসম্রাট তানসেন রাগ দীপক গেয়ে আগুন জ্বালাতেন , আর সে আগুন নেভাতেন রাগ মেঘমল্লার গেয়ে । তিনি ছিলেন প্রকৃতই কিংবদন্তি । তাঁকে নিয়ে অজস্র জনশ্রুতি রয়েছে । আশ্চর্য সব গল্প । যেন রূপকথা । কিন্তু তাঁর মৃত্যু নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছিল তা অবিস্মরণীয় ।

১৫৮৬ সালের ২৩ এপ্রিল প্রয়াত হলেন তানসেন । শেষ হলো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সম্ভবত শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় । বাদশা আকবর তাঁর প্রিয়তম সভারত্ন তানসেনের কাছে রাগ ‘ দীপক ‘ শোনার জন্য নাকি ছেলেমানুষী বায়না ধরেন । বড়ো ভয়ানক রাগ দীপক । এ রাগের সঠিক প্রয়োগে খোদ গায়কেরও অগ্নিদগ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে পুরোমাত্রায় । এছাড়াও ক্ষয় হয় প্রচুর জীবনীশক্তি । তাই প্রথমে অরাজি হলেও পরে তাঁর অন্নদাতা আকবরের আবদার রাখতে সম্মত হন মিঞা তানসেন । গাইতে থাকেন রাগ দীপক । একসময় এ রাগের তীব্র প্রভাবে অগ্নিদগ্ধ হন তিনি এবং মারা যান । তাঁর মেয়ে সরস্বতী বাবার কাছে শেখা রাগ মেঘমল্লার গেয়ে বৃষ্টি নামিয়ে তাঁকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন ঠিকই , কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে যায় । আজ সেসব কিংবদন্তি।

আশি বছর বয়সে দেহ রাখেন সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার অন্যতম সেরা রত্ন তানসেন । একমাস ধরে শোকপালনের ফরমান জারি হয় গোটা দেশে । কিন্তু তানসেনের শেষকৃত্য কীভাবে সম্পন্ন হবে তা নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক বিক্ষোভ । হিন্দু সমাজ ঘোষণা করে , তানসেন হিন্দুর ঘরের ছেলে । নাম রামতনু মিশ্র , পিতা মুকুন্দ মিশ্র ( মতান্তরে মকরন্দ পাণ্ডে ) ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাক্ষ্মণ ও সুগায়ক । বিবাহের কারণে ধর্ম পরিবর্তন করলেও তাঁর শরীরে বইছে হিন্দুর রক্ত । অতএব তাঁর শেষকৃত্য হিন্দু শাস্ত্রমতেই হওয়া উচিত । কিন্তু এতে নারাজ মুসলিম সমাজ ।‌ তাঁদের মতে , ধর্ম পরিবর্তন করে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন তানসেন , তাই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হোক ইসলাম মতে । এ নিয়ে বিবাদ চরমে উঠলো এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বেধে যাওয়ার উপক্রম হলো । বেকায়দায় পড়লেন আকবর। অবশেষে আসরে নামতে বাধ্য হলেন তানসেনের মেয়ে সরস্বতী ।

তানসেনের ছিল পাঁচ সন্তান । তাঁরা হলেন হামীর সেন , সুরট সেন , তানরস খান , সরস্বতী দেবী এবং বিলাস খান । এঁরা প্রত্যেকেই উচ্চমানের সঙ্গীতজ্ঞ । মেয়ে সরস্বতীর উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল ছিলেন তানসেন । দুই সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে সরস্বতী বললেন , তাঁর বাবা এমন পরিস্থিতির আঁচ পেয়েছিলেন বহুদিন আগেই । তাই তাঁর শেষকৃত্য নিয়ে তিনি দিয়ে গেছেন এক বিস্ময়কর নির্দেশ । তা হলো , যে গায়ক তাঁর গানের প্রভাবে তানসেনের মৃত শরীরে সামান্য হলেও প্রাণের সঞ্চার করতে পারবেন , তাঁর ধর্মানুসারেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে তানসেনের । সম্রাট আকবর এবং উপস্থিত সকলেই বললেন , এ অসম্ভব কাজ । গান গেয়ে মৃতের শরীরে প্রাণসঞ্চার কীভাবে সম্ভব ? তানসেন দুহিতা সরস্বতী বললেন , এ অবশ্যই সম্ভব । প্রকৃত সুরসাধক এ কাজ অবশ্যই পারবেন ।

এবার সকলে একমত হয়ে এই প্রস্তাব মেনে নিলেন । সংরক্ষিত করা হলো তানসেনের মরদেহ । তারপর শুরু হলো রুদ্ধশ্বাস এক গানের লড়াই । কে পারবেন মরদেহে প্রাণ ফেরাতে ? কার আছে সেই অসম্ভব সাধনা ? কার কণ্ঠে আছে সেই জাদু , মৃতসঞ্জীবনীসুধা ? কার আছে সেই ঐশ্বরিক ক্ষমতা ?

তামাম দুনিয়ার সেরা উস্তাদ ও সুরসাধকদের ভিড় জমে উঠলো আগ্রার দরবারে । দেখতে দেখতে তিনদিন তিনরাত্রি অতিক্রান্ত হলো , চলতে লাগলো গান । ফুল , আতর , বরফ আর ঔষধি দিয়ে সাজানো সুরসম্রাটের মরদেহ দেখে কে বলবে তিনি মৃত ? মনে হচ্ছে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন সুরসাধক , এক্ষুনি উঠে তানপুরার তার বেঁধে হয়তো গাইতে শুরু করবেন তাঁর গুরু হরিদাস স্বামীর সৃষ্ট রাগ বৃন্দাবনী সারঙ্গ ।
কিন্তু তিনদিন তিনরাত্রি ধরে সুরের প্লাবন বয়ে গেলেও নিস্পন্দ তানসেন । তবে কি ব্যর্থ হবে সব আয়োজন? কেউ কি পারবেন না অসাধ্য সাধন করতে ? ক্রমেই হতাশ হতে লাগলো সকলে ।‌ হতাশ হয়ে পড়লেন স্বয়ং আকবর ।

এমন যখন অবস্থা , তখন হঠাৎই ২৬ এপ্রিল শেষরাতে দরবারে এসে দাঁড়ালেন এক দীন ফকির । তিনি বললেন , অনুমতি মিললে তিনি একবার চেষ্টা করতে চান । সবাই তো অবাক । চালচুলোহীন ফকিরের কথা শুনে সবাই তো হেসেই অস্থির । তামাম দুনিয়ার নামজাদা উস্তাদবৃন্দ যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন , সেখানে এই ফকির কী চমৎকার দেখাবেন ? ফকির কিন্তু নিজের প্রত্যয়ে অনড় ।

শেষে অনুমতি পেয়ে সাধক তানসেনের পায়ের কাছে বসে ফকির শুরু করলেন তাঁর গান। আর কী আশ্চর্য ! এ কি অপার্থিব সুর ? এমন তো শোনা যায় নি কখনও ! কী রাগ গাইছেন এই ফকির ? কার কাছে তালিম নিয়েছেন ইনি ? এমন সুরের মাধুরী তো বিরলপ্রায় ! এ সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হবেন জগতের সকলেই । সবাই মুগ্ধ , সবাই বিস্মিত , সবাই বাকরুদ্ধ । ফকির তন্ময় , ভাবলেশহীন , গেয়ে চলেছেন চোখ বুজে । যেন পরম করুণাময় ঈশ্বরের সাধনায় লীন হয়ে গেছে তাঁর সমস্ত অস্তিত্ব , স্বত্তা , বোধ , জাগরণ। এমন সময় দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য । বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে মৃত তানসেনের দেহে । তারপর একসময় সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলেন শায়িত তানসেনের ডান হাতটি কাঁপছে । তাঁর ডানহাতের তর্জনী যেন কিছু নির্দেশ করছে অজ্ঞাত সেই গায়ক ফকিরের উদ্দেশে । কয়েক মুহূর্তের জন্য সময় যেন থমকে গেল , তারপর সব শেষ ।

ধন্য ধন্য পড়ে গেল রাজসভায় । সবার চোখে জল । গান শেষ করে মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়ালেন ফকির । অদ্ভুত এক প্রশান্তি তাঁর মুখে । সকলের মনেই তখন একটাই প্রশ্ন , কে এই ফকির ? কী তাঁর পরিচয় ? বাদশা আকবর পর্যন্ত তাঁর পরিচয় জানতে উদগ্রীব । প্রথমে নিজের পরিচয় দিতে নারাজ ছিলেন ফকির । কিন্তু পরে সম্রাট আকবর এবং উপস্থিত সকলের অনুরোধে নিজের পরিচয় দেন তিনি । তাঁর নাম বিলাস খান। তিনি তানসেনের কনিষ্ঠতম সন্তান । অল্প বয়সে সুফিসাধনায় মজে ঘর ছেড়েছিলেন । সেদিন তাঁর গাওয়া সেই রাগটি তাঁর নিজস্ব রচনা । রাগের নাম বিলাসখানি টোড়ি ।

সেদিন দরবার ছেড়ে বেরিয়ে যাবার আগে বিলাস খানকে নজরানা দিতে চেয়েছিলেন সম্রাট আকবর ।‌ বিলাস খান জানিয়েছিলেন , তাঁর মৃত্যুর পর যেন তাঁকে স্থান দেওয়া হয় তাঁর পিতার পাশেই । আজও গোয়ালিয়রে পাশাপাশি শুয়ে আছেন পিতা-পুত্র ।

আরও পড়ুন- সাবধান! গাড়ি-মোটর সাইকেল থাকলেই মানতে হবে এই আইন, নাহলে গুনতে হবে মোটা জরিমানা

 

spot_img

Related articles

একজন মানুষের মৃত্যু হল ৩০ বার! মধ্যপ্রদেশে ১১ কোটির ‘ক্ষতিপূর্ণ’ কেলেঙ্কারি

এক জীবনে মৃত্যু কতবার আসে? মধ্যপ্রদেশে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের (Shivraj Singh Chouhan) দৌলতে এক ব্যক্তি ৩০...

আবারও চ্যাম্পিয়ন মোহনবাগান, কালীঘাটকে হারাল সবুজ-মেরুন ব্রিগেড

জিতেই চলেছে মোহনবাগান(Mohunbagan)। ফুটবলে সাফল্যের পর ক্রিকেটেও একের পর এক সাফল্য পেয়ে চলেছে সবুজ-মেরুন ব্রিগেড। ইডেনে জেসি মুখার্জী...

BEFORE ANYONE ELSE: সর্বদলীয় প্রতিনিধিরা বিদেশ থেকে ফিরলেই সংসদে বিশেষ অধিবেশন ডাকার আবেদন মমতার

ভারত সীমান্তে পাক সন্ত্রাস ও অপারেশন সিন্দুর নিয়ে বিশ্বকে জানাতে বিদেশে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ ৯ ভারতী সাংসদদের প্রতিনিধি দল।...

বোসের বদলে বেলা! রাজভবনে পালাবদল যেন অঞ্জনের গান

দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস (C V Ananda Bose)। এবার কী সেই সূত্রে বদল হতে চলেছে...