‘বিলাসখানি টোড়ি’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

তুমি যে সুরের আগুন
লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে
এ আগুন ছড়িয়ে গেল
সব খানে
যত সব মরা গাছের
ডালে ডালে নাচে আগুন
তালে তালে রে …

গান গেয়ে আগুন জ্বালানো কি মুখের কথা ? তবু আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলতে পারেন কেউ কেউ । যিনি গান গেয়ে আগুন জ্বালাতে পারেন , তিনি নিশ্চয়ই সে আগুন নেভানোর মন্ত্রও জানেন ।
সুরসম্রাট তানসেন রাগ দীপক গেয়ে আগুন জ্বালাতেন , আর সে আগুন নেভাতেন রাগ মেঘমল্লার গেয়ে । তিনি ছিলেন প্রকৃতই কিংবদন্তি । তাঁকে নিয়ে অজস্র জনশ্রুতি রয়েছে । আশ্চর্য সব গল্প । যেন রূপকথা । কিন্তু তাঁর মৃত্যু নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছিল তা অবিস্মরণীয় ।

১৫৮৬ সালের ২৩ এপ্রিল প্রয়াত হলেন তানসেন । শেষ হলো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সম্ভবত শ্রেষ্ঠতম অধ্যায় । বাদশা আকবর তাঁর প্রিয়তম সভারত্ন তানসেনের কাছে রাগ ‘ দীপক ‘ শোনার জন্য নাকি ছেলেমানুষী বায়না ধরেন । বড়ো ভয়ানক রাগ দীপক । এ রাগের সঠিক প্রয়োগে খোদ গায়কেরও অগ্নিদগ্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে পুরোমাত্রায় । এছাড়াও ক্ষয় হয় প্রচুর জীবনীশক্তি । তাই প্রথমে অরাজি হলেও পরে তাঁর অন্নদাতা আকবরের আবদার রাখতে সম্মত হন মিঞা তানসেন । গাইতে থাকেন রাগ দীপক । একসময় এ রাগের তীব্র প্রভাবে অগ্নিদগ্ধ হন তিনি এবং মারা যান । তাঁর মেয়ে সরস্বতী বাবার কাছে শেখা রাগ মেঘমল্লার গেয়ে বৃষ্টি নামিয়ে তাঁকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলেন ঠিকই , কিন্তু ততক্ষণে অনেকটা দেরি হয়ে যায় । আজ সেসব কিংবদন্তি।

আশি বছর বয়সে দেহ রাখেন সম্রাট আকবরের নবরত্ন সভার অন্যতম সেরা রত্ন তানসেন । একমাস ধরে শোকপালনের ফরমান জারি হয় গোটা দেশে । কিন্তু তানসেনের শেষকৃত্য কীভাবে সম্পন্ন হবে তা নিয়ে শুরু হয় ব্যাপক বিক্ষোভ । হিন্দু সমাজ ঘোষণা করে , তানসেন হিন্দুর ঘরের ছেলে । নাম রামতনু মিশ্র , পিতা মুকুন্দ মিশ্র ( মতান্তরে মকরন্দ পাণ্ডে ) ছিলেন নিষ্ঠাবান ব্রাক্ষ্মণ ও সুগায়ক । বিবাহের কারণে ধর্ম পরিবর্তন করলেও তাঁর শরীরে বইছে হিন্দুর রক্ত । অতএব তাঁর শেষকৃত্য হিন্দু শাস্ত্রমতেই হওয়া উচিত । কিন্তু এতে নারাজ মুসলিম সমাজ ।‌ তাঁদের মতে , ধর্ম পরিবর্তন করে ইসলামে দীক্ষিত হয়েছিলেন তানসেন , তাই তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হোক ইসলাম মতে । এ নিয়ে বিবাদ চরমে উঠলো এবং দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে দাঙ্গা বেধে যাওয়ার উপক্রম হলো । বেকায়দায় পড়লেন আকবর। অবশেষে আসরে নামতে বাধ্য হলেন তানসেনের মেয়ে সরস্বতী ।

তানসেনের ছিল পাঁচ সন্তান । তাঁরা হলেন হামীর সেন , সুরট সেন , তানরস খান , সরস্বতী দেবী এবং বিলাস খান । এঁরা প্রত্যেকেই উচ্চমানের সঙ্গীতজ্ঞ । মেয়ে সরস্বতীর উপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল ছিলেন তানসেন । দুই সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে সরস্বতী বললেন , তাঁর বাবা এমন পরিস্থিতির আঁচ পেয়েছিলেন বহুদিন আগেই । তাই তাঁর শেষকৃত্য নিয়ে তিনি দিয়ে গেছেন এক বিস্ময়কর নির্দেশ । তা হলো , যে গায়ক তাঁর গানের প্রভাবে তানসেনের মৃত শরীরে সামান্য হলেও প্রাণের সঞ্চার করতে পারবেন , তাঁর ধর্মানুসারেই শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে তানসেনের । সম্রাট আকবর এবং উপস্থিত সকলেই বললেন , এ অসম্ভব কাজ । গান গেয়ে মৃতের শরীরে প্রাণসঞ্চার কীভাবে সম্ভব ? তানসেন দুহিতা সরস্বতী বললেন , এ অবশ্যই সম্ভব । প্রকৃত সুরসাধক এ কাজ অবশ্যই পারবেন ।

এবার সকলে একমত হয়ে এই প্রস্তাব মেনে নিলেন । সংরক্ষিত করা হলো তানসেনের মরদেহ । তারপর শুরু হলো রুদ্ধশ্বাস এক গানের লড়াই । কে পারবেন মরদেহে প্রাণ ফেরাতে ? কার আছে সেই অসম্ভব সাধনা ? কার কণ্ঠে আছে সেই জাদু , মৃতসঞ্জীবনীসুধা ? কার আছে সেই ঐশ্বরিক ক্ষমতা ?

তামাম দুনিয়ার সেরা উস্তাদ ও সুরসাধকদের ভিড় জমে উঠলো আগ্রার দরবারে । দেখতে দেখতে তিনদিন তিনরাত্রি অতিক্রান্ত হলো , চলতে লাগলো গান । ফুল , আতর , বরফ আর ঔষধি দিয়ে সাজানো সুরসম্রাটের মরদেহ দেখে কে বলবে তিনি মৃত ? মনে হচ্ছে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছেন সুরসাধক , এক্ষুনি উঠে তানপুরার তার বেঁধে হয়তো গাইতে শুরু করবেন তাঁর গুরু হরিদাস স্বামীর সৃষ্ট রাগ বৃন্দাবনী সারঙ্গ ।
কিন্তু তিনদিন তিনরাত্রি ধরে সুরের প্লাবন বয়ে গেলেও নিস্পন্দ তানসেন । তবে কি ব্যর্থ হবে সব আয়োজন? কেউ কি পারবেন না অসাধ্য সাধন করতে ? ক্রমেই হতাশ হতে লাগলো সকলে ।‌ হতাশ হয়ে পড়লেন স্বয়ং আকবর ।

এমন যখন অবস্থা , তখন হঠাৎই ২৬ এপ্রিল শেষরাতে দরবারে এসে দাঁড়ালেন এক দীন ফকির । তিনি বললেন , অনুমতি মিললে তিনি একবার চেষ্টা করতে চান । সবাই তো অবাক । চালচুলোহীন ফকিরের কথা শুনে সবাই তো হেসেই অস্থির । তামাম দুনিয়ার নামজাদা উস্তাদবৃন্দ যেখানে ব্যর্থ হয়েছেন , সেখানে এই ফকির কী চমৎকার দেখাবেন ? ফকির কিন্তু নিজের প্রত্যয়ে অনড় ।

শেষে অনুমতি পেয়ে সাধক তানসেনের পায়ের কাছে বসে ফকির শুরু করলেন তাঁর গান। আর কী আশ্চর্য ! এ কি অপার্থিব সুর ? এমন তো শোনা যায় নি কখনও ! কী রাগ গাইছেন এই ফকির ? কার কাছে তালিম নিয়েছেন ইনি ? এমন সুরের মাধুরী তো বিরলপ্রায় ! এ সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হবেন জগতের সকলেই । সবাই মুগ্ধ , সবাই বিস্মিত , সবাই বাকরুদ্ধ । ফকির তন্ময় , ভাবলেশহীন , গেয়ে চলেছেন চোখ বুজে । যেন পরম করুণাময় ঈশ্বরের সাধনায় লীন হয়ে গেছে তাঁর সমস্ত অস্তিত্ব , স্বত্তা , বোধ , জাগরণ। এমন সময় দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য । বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে মৃত তানসেনের দেহে । তারপর একসময় সকলে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলেন শায়িত তানসেনের ডান হাতটি কাঁপছে । তাঁর ডানহাতের তর্জনী যেন কিছু নির্দেশ করছে অজ্ঞাত সেই গায়ক ফকিরের উদ্দেশে । কয়েক মুহূর্তের জন্য সময় যেন থমকে গেল , তারপর সব শেষ ।

ধন্য ধন্য পড়ে গেল রাজসভায় । সবার চোখে জল । গান শেষ করে মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়ালেন ফকির । অদ্ভুত এক প্রশান্তি তাঁর মুখে । সকলের মনেই তখন একটাই প্রশ্ন , কে এই ফকির ? কী তাঁর পরিচয় ? বাদশা আকবর পর্যন্ত তাঁর পরিচয় জানতে উদগ্রীব । প্রথমে নিজের পরিচয় দিতে নারাজ ছিলেন ফকির । কিন্তু পরে সম্রাট আকবর এবং উপস্থিত সকলের অনুরোধে নিজের পরিচয় দেন তিনি । তাঁর নাম বিলাস খান। তিনি তানসেনের কনিষ্ঠতম সন্তান । অল্প বয়সে সুফিসাধনায় মজে ঘর ছেড়েছিলেন । সেদিন তাঁর গাওয়া সেই রাগটি তাঁর নিজস্ব রচনা । রাগের নাম বিলাসখানি টোড়ি ।

সেদিন দরবার ছেড়ে বেরিয়ে যাবার আগে বিলাস খানকে নজরানা দিতে চেয়েছিলেন সম্রাট আকবর ।‌ বিলাস খান জানিয়েছিলেন , তাঁর মৃত্যুর পর যেন তাঁকে স্থান দেওয়া হয় তাঁর পিতার পাশেই । আজও গোয়ালিয়রে পাশাপাশি শুয়ে আছেন পিতা-পুত্র ।

আরও পড়ুন- সাবধান! গাড়ি-মোটর সাইকেল থাকলেই মানতে হবে এই আইন, নাহলে গুনতে হবে মোটা জরিমানা

 

Previous articleBreakfast news: ব্রেকফাস্ট নিউজ
Next articleবৃষ্টি বিপর্যস্ত দিল্লি, জলমগ্ন কোচিং সেন্টারে মৃত ৩ পড়ুয়া!