‘গোল্ডেন গোল্ডিং’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

” মেয়েরা বোকা বলেই তারা পুরুষের সমকক্ষ হতে চায় । কারণ মেয়েরা জানেই না যে তারা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য । মেয়েদের আপনি যাই দেন না কেন , তারা সেটাকে আরও উচ্চতর কিছু বানিয়ে দেবে । আপনি তাকে একটা ছোট্ট ঘর দিলে সে সেটাকে একটা বড় বাড়ি বানিয়ে দেবে । আপনি বাজার করে আনলে সে রান্না করে আপনাকে সুস্বাদু খাবার খাওয়াবে । আপনি শুক্রাণু দিলে সে আপনাকে সন্তান দেবে । আপনি হেসে কথা বললে সে নিজের হৃদয় দিয়ে দেবে । আপনি যা দেবেন সেটার কয়েকগুণ বেশি সে ফেরত দেবে । কিন্তু মনে রাখবেন , তাকে যন্ত্রণা দিলে সে আপনার জীবনটাও নরক করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে । ”

বিখ্যাত ‘ লর্ড অফ দ্যা ফ্লাইস ‘ – এর লেখক উইলিয়াম গোল্ডিং ( ১৯ সেপ্টেম্বর , ১৯১১ — ১৯ জুন , ১৯৯৩ ) একজন বৃটিশ ঔপন্যাসিক । ডার্কনেস ভিজিবল , দ্য স্পাইয়ার , দ্য পিরামিড ইত্যাদি উপন্যাসও তাঁরই সৃষ্টি। উইলিয়াম জেরাল্ড গোল্ডিং খুব বেশি লেখেন নি , কিন্তু যা লিখেছেন তা দিয়েই তিনি ইংরেজি তথা বিশ্বসাহিত্যে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন । ১৯৮৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান । মানুষের আসল প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি , জীবনবোধের বাস্তবতা , সভ্যতার মেকি মুখোশ , আর ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থা বুঝতে আজও ইউরোপের কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের তালিকাভুক্ত হয়ে রয়েছে এই মরমী লেখকের গ্রন্থসমূহ । জনবসতিহীন দ্বীপে আটকে পড়া কিশোর প্রজন্ম কিভাবে সভ্যতার মুখোশ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে নিজেদের আদিমতম বর্বররূপে , শেখানো শৃঙ্খলা ও নীতিবোধ ছেড়ে মানবপ্রবৃত্তি কত সহজেই ঝুঁকে পড়ে ক্ষমতার লোভ ও প্রতিপত্তির আকাঙ্খায় , সেটাই দেখানো হয়েছে গোল্ডিংয়ের বিখ্যাত ‘ লর্ড অফ দ্যা ফ্লাইস ‘ উপন্যাসে ।

‘ পিচার মার্টিন ‘ – এ লেখক বলেছেন পাপাচারী এক নাবিকের জীবন , তার হতাশা , সমুদ্রযাত্রা আর তার যন্ত্রণাময় মৃত্যুর কাহিনী । ‘ ফ্রি ফল ‘ দেখায় মানুষ তথা মানবপ্রজন্মটা যেন মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কুচক্রী শয়তান , যেন সু্যোগ পেলেই হামলে পড়বে নিরীহ- নিষ্পাপ প্রাণের ওপর , আর খুবলে খাবে দুর্বলদের । মৌমাছির সহজাত স্বভাব বৈশিষ্ট্য যেমন মধু বানানো , ঠিক তেমনি মানুষের সহজাত ঝোঁক পাপের দিকে । উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের এই মনস্তাত্ত্বিক বীক্ষণ তাঁর লেখার অন্যতম চালিকাশক্তি । মূল্যবোধ , সমস্ত সৎ গুণাগুণ , সততা , শৃঙ্খলা , আত্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি মানুষকে শেখাতে হয় । কিন্তু না শেখালেও সে চুরি , রাহাজানি , মিথ্যা , প্রতারণা , হত্যা , এসবই জেনে নেয় নিজের প্রবৃত্তি থেকেই । ছলে-বলে-কৌশলে , যে কোনো উপায়ে নিজের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার প্রবৃত্তি এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া এসবই মানুষের সহজাত । ভালো ও মন্দের নিত্য যুদ্ধ , আলো ও অন্ধকারের প্রতি মুহূর্তের দ্বন্দ্ব , মানবতার লুকোনো বর্বরতা ইত্যাদির অন্বেষণ থেকে নিজেকে কখনও সরিয়ে রাখতে পারেন নি গোল্ডিং । মানুষের অন্ধকার দিকের প্রতি লেখকের এই ঝোঁক শুধু সাহিত্যিক ভান ছিল না । জীবিত থাকাকালীন একজন নিবিড়ভাবে ব্যক্তিগত মানুষের মৃত্যুর পরে তাঁর অপ্রকাশিত লেখাপত্রগুলি ঘেঁটেও বোঝা যায় যে মানুষের অন্তর্লীন অন্ধকার আবেগগুলির সঙ্গে কী কঠিন লড়াই তাঁকে করতে হয়েছে জীবনভর ।

মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলো প্রকৃতপক্ষে ঘুমিয়ে থাকে শীতঘুমে কুণ্ডলিপাকানো সাপের মতো । শিক্ষা ও সংস্কৃতির ওষুধ প্রয়োগ করে প্রবৃত্তিগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় । নৈতিকতার পাঠ , ঈশ্বরের অপার মহিমা , আধ্যাত্মিকতা , ঈশ্বরচিন্তা ইত্যাদি দিয়ে মানুষের মনের গোপন অন্ধকার ঢেকে রাখার প্রয়াস চলতেই থাকে । কিন্তু সার কথা হলো , মানুষের মনের মধ্যে অন্ধকার বেশি , আলো কম । তাই পাশব প্রবৃত্তি , স্বার্থপরতা , ঘৃণা , প্রভুত্বকামীতা , ব্যাভিচার ও বর্বরতা , নৃশংসতা , যুদ্ধ ও ধ্বংসপ্রবণতা আজও মানবসভ্যতার সঙ্কটকে জিইয়ে রেখেছে । মানব মনস্তত্ত্বের গড় বিশ্লেষণ বলছে , এ থেকে সম্পূর্ণ পরিত্রাণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। হাজার হাজার বছরের মানবসভ্যতা এই আলোআঁধারির মধ্যে দিয়েই দীর্ঘ একটা পথ পেরিয়েছে বটে , কিন্তু তার মনের মূল নিয়ন্ত্রক এখনও অন্ধকার ।

এই যে বিশ্বজুড়ে চূড়ান্ত বৈষম্যের সমাজব্যবস্থা , দেশে দেশে অনির্বচনীয় হুণ্ডি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে , ধনীদের আরও ধনী আর গরীবের আরও গরীব হওয়া , এসবের শেষ কোথায় ? মানব মনের অতলে প্রবৃত্তিজনিত জৈবিক অন্ধকার তো আছেই , তার সঙ্গে যোগ হয় সমাজব্যবস্থার নৃশংসতা , যা অন্ধকারকে আরও ঘণীভূত করে । তাহলে এ আঁধার থেকে ফেরার পথ সত্যিই কি নেই ? কোন পথে আসবে মানুষের ক্রমমুক্তি ? কবে ? আরও কতটা পথ পার হতে হবে ? নাকি এমনই চলবে অনন্তকাল ?

লেখার মাধ্যমে সত্যের দরজা হাট করে খুলে দিয়ে উইলিয়াম গোল্ডিং সম্ভবত এসবেরই উত্তর খুঁজেছেন । আমাদের ঘুমন্ত চেতনার ঝুঁটি ধরে নাড়া দেওয়ার প্রয়াস করেছেন । হয়তো বা বলতে চেয়েছেন , তাঁর লেখা একটা সময় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেই পৃথিবীর মঙ্গল , সরে যাক অন্ধকার , আসুক আলো , প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠুক মানুষের মিলেমিশে বেঁচে থাকা ।

আরও পড়ুন- UPS: নয়া পেনশন প্রকল্প চালু করল কেন্দ্র! কী কী সুবিধে পাবেন কর্মচারীরা?

 

Previous articleUPS: নয়া পেনশন প্রকল্প চালু করল কেন্দ্র! কী কী সুবিধে পাবেন কর্মচারীরা?
Next articleBreakfast Sports : ব্রেকফাস্ট স্পোর্টস