Friday, May 23, 2025

‘গোল্ডেন গোল্ডিং’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

” মেয়েরা বোকা বলেই তারা পুরুষের সমকক্ষ হতে চায় । কারণ মেয়েরা জানেই না যে তারা পুরুষের চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য । মেয়েদের আপনি যাই দেন না কেন , তারা সেটাকে আরও উচ্চতর কিছু বানিয়ে দেবে । আপনি তাকে একটা ছোট্ট ঘর দিলে সে সেটাকে একটা বড় বাড়ি বানিয়ে দেবে । আপনি বাজার করে আনলে সে রান্না করে আপনাকে সুস্বাদু খাবার খাওয়াবে । আপনি শুক্রাণু দিলে সে আপনাকে সন্তান দেবে । আপনি হেসে কথা বললে সে নিজের হৃদয় দিয়ে দেবে । আপনি যা দেবেন সেটার কয়েকগুণ বেশি সে ফেরত দেবে । কিন্তু মনে রাখবেন , তাকে যন্ত্রণা দিলে সে আপনার জীবনটাও নরক করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে । ”

বিখ্যাত ‘ লর্ড অফ দ্যা ফ্লাইস ‘ – এর লেখক উইলিয়াম গোল্ডিং ( ১৯ সেপ্টেম্বর , ১৯১১ — ১৯ জুন , ১৯৯৩ ) একজন বৃটিশ ঔপন্যাসিক । ডার্কনেস ভিজিবল , দ্য স্পাইয়ার , দ্য পিরামিড ইত্যাদি উপন্যাসও তাঁরই সৃষ্টি। উইলিয়াম জেরাল্ড গোল্ডিং খুব বেশি লেখেন নি , কিন্তু যা লিখেছেন তা দিয়েই তিনি ইংরেজি তথা বিশ্বসাহিত্যে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিয়েছেন । ১৯৮৩ সালে তিনি নোবেল পুরস্কার পান । মানুষের আসল প্রকৃতি ও প্রবৃত্তি , জীবনবোধের বাস্তবতা , সভ্যতার মেকি মুখোশ , আর ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থা বুঝতে আজও ইউরোপের কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমের তালিকাভুক্ত হয়ে রয়েছে এই মরমী লেখকের গ্রন্থসমূহ । জনবসতিহীন দ্বীপে আটকে পড়া কিশোর প্রজন্ম কিভাবে সভ্যতার মুখোশ ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে নিজেদের আদিমতম বর্বররূপে , শেখানো শৃঙ্খলা ও নীতিবোধ ছেড়ে মানবপ্রবৃত্তি কত সহজেই ঝুঁকে পড়ে ক্ষমতার লোভ ও প্রতিপত্তির আকাঙ্খায় , সেটাই দেখানো হয়েছে গোল্ডিংয়ের বিখ্যাত ‘ লর্ড অফ দ্যা ফ্লাইস ‘ উপন্যাসে ।

‘ পিচার মার্টিন ‘ – এ লেখক বলেছেন পাপাচারী এক নাবিকের জীবন , তার হতাশা , সমুদ্রযাত্রা আর তার যন্ত্রণাময় মৃত্যুর কাহিনী । ‘ ফ্রি ফল ‘ দেখায় মানুষ তথা মানবপ্রজন্মটা যেন মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা কুচক্রী শয়তান , যেন সু্যোগ পেলেই হামলে পড়বে নিরীহ- নিষ্পাপ প্রাণের ওপর , আর খুবলে খাবে দুর্বলদের । মৌমাছির সহজাত স্বভাব বৈশিষ্ট্য যেমন মধু বানানো , ঠিক তেমনি মানুষের সহজাত ঝোঁক পাপের দিকে । উইলিয়াম গোল্ডিংয়ের এই মনস্তাত্ত্বিক বীক্ষণ তাঁর লেখার অন্যতম চালিকাশক্তি । মূল্যবোধ , সমস্ত সৎ গুণাগুণ , সততা , শৃঙ্খলা , আত্মনিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি মানুষকে শেখাতে হয় । কিন্তু না শেখালেও সে চুরি , রাহাজানি , মিথ্যা , প্রতারণা , হত্যা , এসবই জেনে নেয় নিজের প্রবৃত্তি থেকেই । ছলে-বলে-কৌশলে , যে কোনো উপায়ে নিজের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ করার প্রবৃত্তি এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া এসবই মানুষের সহজাত । ভালো ও মন্দের নিত্য যুদ্ধ , আলো ও অন্ধকারের প্রতি মুহূর্তের দ্বন্দ্ব , মানবতার লুকোনো বর্বরতা ইত্যাদির অন্বেষণ থেকে নিজেকে কখনও সরিয়ে রাখতে পারেন নি গোল্ডিং । মানুষের অন্ধকার দিকের প্রতি লেখকের এই ঝোঁক শুধু সাহিত্যিক ভান ছিল না । জীবিত থাকাকালীন একজন নিবিড়ভাবে ব্যক্তিগত মানুষের মৃত্যুর পরে তাঁর অপ্রকাশিত লেখাপত্রগুলি ঘেঁটেও বোঝা যায় যে মানুষের অন্তর্লীন অন্ধকার আবেগগুলির সঙ্গে কী কঠিন লড়াই তাঁকে করতে হয়েছে জীবনভর ।

মানুষের আদিম প্রবৃত্তিগুলো প্রকৃতপক্ষে ঘুমিয়ে থাকে শীতঘুমে কুণ্ডলিপাকানো সাপের মতো । শিক্ষা ও সংস্কৃতির ওষুধ প্রয়োগ করে প্রবৃত্তিগুলোকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয় । নৈতিকতার পাঠ , ঈশ্বরের অপার মহিমা , আধ্যাত্মিকতা , ঈশ্বরচিন্তা ইত্যাদি দিয়ে মানুষের মনের গোপন অন্ধকার ঢেকে রাখার প্রয়াস চলতেই থাকে । কিন্তু সার কথা হলো , মানুষের মনের মধ্যে অন্ধকার বেশি , আলো কম । তাই পাশব প্রবৃত্তি , স্বার্থপরতা , ঘৃণা , প্রভুত্বকামীতা , ব্যাভিচার ও বর্বরতা , নৃশংসতা , যুদ্ধ ও ধ্বংসপ্রবণতা আজও মানবসভ্যতার সঙ্কটকে জিইয়ে রেখেছে । মানব মনস্তত্ত্বের গড় বিশ্লেষণ বলছে , এ থেকে সম্পূর্ণ পরিত্রাণ পাওয়া প্রায় অসম্ভব। হাজার হাজার বছরের মানবসভ্যতা এই আলোআঁধারির মধ্যে দিয়েই দীর্ঘ একটা পথ পেরিয়েছে বটে , কিন্তু তার মনের মূল নিয়ন্ত্রক এখনও অন্ধকার ।

এই যে বিশ্বজুড়ে চূড়ান্ত বৈষম্যের সমাজব্যবস্থা , দেশে দেশে অনির্বচনীয় হুণ্ডি মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে , ধনীদের আরও ধনী আর গরীবের আরও গরীব হওয়া , এসবের শেষ কোথায় ? মানব মনের অতলে প্রবৃত্তিজনিত জৈবিক অন্ধকার তো আছেই , তার সঙ্গে যোগ হয় সমাজব্যবস্থার নৃশংসতা , যা অন্ধকারকে আরও ঘণীভূত করে । তাহলে এ আঁধার থেকে ফেরার পথ সত্যিই কি নেই ? কোন পথে আসবে মানুষের ক্রমমুক্তি ? কবে ? আরও কতটা পথ পার হতে হবে ? নাকি এমনই চলবে অনন্তকাল ?

লেখার মাধ্যমে সত্যের দরজা হাট করে খুলে দিয়ে উইলিয়াম গোল্ডিং সম্ভবত এসবেরই উত্তর খুঁজেছেন । আমাদের ঘুমন্ত চেতনার ঝুঁটি ধরে নাড়া দেওয়ার প্রয়াস করেছেন । হয়তো বা বলতে চেয়েছেন , তাঁর লেখা একটা সময় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলেই পৃথিবীর মঙ্গল , সরে যাক অন্ধকার , আসুক আলো , প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠুক মানুষের মিলেমিশে বেঁচে থাকা ।

আরও পড়ুন- UPS: নয়া পেনশন প্রকল্প চালু করল কেন্দ্র! কী কী সুবিধে পাবেন কর্মচারীরা?

 

spot_img

Related articles

বোসের বদলে বেলা! রাজভবনে পালাবদল যেন অঞ্জনের গান

দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস (C V Ananda Bose)। এবার কী সেই সূত্রে বদল হতে চলেছে...

উত্তরপ্রদেশে ঝড়বৃষ্টি-বজ্রপাতে মৃত ৪৫, জারি সতর্কতা

মর্মান্তিক! প্রাকৃতিক দুর্যোগ বহু মানুষের প্রাণ কাড়ল উত্তরপ্রদেশে(Uttar Pradesh)। ঝড়বৃষ্টি এবং বজ্রপাতে(Thunderstorm) ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হল ৪৫ জনের।...

ইংল্যান্ড সফরের আগে বোর্ডকে নিজের সিদ্ধান্ত জানালেন জসপ্রীত বুমরাহ

ইংল্যান্ড সিরিজের দল ঘোষণার আগেই জসপ্রীত বুমরাকে(Jasprit Bumrah) নিয়ে দুঃসংবাদ ভারতীয় শিবিরে। ইংল্যান্ডের(England) বিরুদ্ধে সবকটি ম্যাচে খেলতে পারবেন...

মস্কোর আকাশে ইউক্রেনের ড্রোন হামলা! বিপাকে ভারতের প্রতিনিধি দল

নিজের দেশের উপর জঙ্গি কার্যকলাপ থামাতে গিয়ে অন্য দেশের নিরন্তর অশান্তির মুখে ভারতের সর্বদলীয় প্রতিনিধি দল। যুদ্ধবিধ্বস্ত রাশিয়ায়...