আর জি করে তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়ার ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় উত্তাল গোটা রাজ্য। ঘটনার আঁচ লেগেছে দেশ-বিদেশ। প্রতিবাদ, বিচার চেয়ে পথে নামছে মানুষ। অন্যদিকে, রাজ্যের সরকারি হাসপাতালের একশ্রেণীর জুনিয়র ডাক্তারদের (Junior Doctor) লাগাতার কর্মবিরতি চলছে। সুপ্রিম কোর্ট বলার পরেও নিজেদের অবস্থানে অনড় জুনিয়র ডাক্তাররা। এরই মাঝে গতকাল, সোমবার কলকাতা পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের পদত্যাগের দাবিতে লালবাজার অভিযান কর্মসূচি নিয়েছিলেন জুনিয়র ডাক্তাররা। রাত পেরিয়ে এখনও চলছে সেই আন্দোলন। তবে আলদোলনের মাঝে বড় অসহায় গরিব মানুষ। সরকারি হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা থেকে তাঁর বঞ্চিত। রোগীর পরিবারের লোকেরাও তো বিচার চাইছে, তাহলে কেন তাঁরা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত? ধর্ষক-খুনির সাজা কেন ভোগ করতে হবে নিরপরাধ রোগী ও তাঁদের অসহায় পরিবারকে? এই ২৫ দিনে পরিষেবা না পেয়ে মৃত্যুর ঘটনা পর্জন্ত ঘটেছে।
জুনিয়র ডাক্তারদের (Junior Doctor) লাগাতার কর্মবিরতিতে পরিস্থিতি বদলায়নি। পথ দুর্ঘটনায় হাত ভেঙেছে, মাথা ফেটেছে। তবুও ভর্তি না করে ফিরিয়ে দিল আর জি কর হাসপাতাল। সামান্য চিকিৎসাটুকুও করা হয়নি বলে অভিযোগ পরিবারের। কাঁদতে কাঁদতে হাসপাতাল ছাড়লেন দুর্ঘটনাগ্রস্থের অসহায় বাড়ির লোকেরা। যা দেখে আতঙ্কে আর জি কর হাসপাতালে অপেক্ষারত অন্যান্য রোগী ও তাঁদের পরিজনরা।
এরকম ঘটনা একটি নয়। পায়ের অপারেশনের জন্য ভর্তি হওয়ার কথা ছিল এক রোগীর। তাঁকে ভর্তি নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ উঠল। আর জি কর শুধু নয়। একই ছবি দেখা গেল রাজ্যের সবচেয়ে বড় সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল এসএসকেএমেও। পেটে জল জমেছে এক রোগীর। তাঁকে নিয়ে ইমারজেন্সিতে এসেছিলেন পরিজনরা। এই রোগীকে সোজা রেফার করা হল অন্য হাসপাতালে। পাশাপাশি শ্বাসকষ্টের জটিল রোগ নিয়ে আসা রোগীকেও রেফার করা হল অন্য হাসপাতালে। সবমিলিয়ে চিকিৎসা না পেয়ে আতঙ্কগ্রস্ত রোগীদের অসহায় অবস্থা চোখে পড়ল সর্বত্র।
ভাঙরের বাসিন্দা এক বাসিন্দাকে নিউটাউনের সাপুরজি এলাকায় একটি গাড়ি সজোরে ধাক্কা মারে। স্থানীয়রা উদ্ধার করে প্রথমে এলাকারই একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁকে আর জি কর হাসপাতালে নিয়ে আসেন আত্মীয়রা। তাঁদের অভিযোগ, ইমারজেন্সিতে কোনও চিকিৎসক তাঁকে দেখেনি। হাত ভাঙা, মাথা ফাটা অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও রেফার করে দেন।
এখানেই শেষ নয়। বিরাটির বাসিন্দা এক মহিলা পায়ের অপারেশন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অপারেশনের দিন বারবার পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁকেও আর জি কর থেকে ভর্তি না হয়ে ফিরতে হয়েছে। ওই মহিলার কথায়, “গত মাসে অপারেশন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই ঝামেলার মধ্যে তা হয়নি। এই মাসে আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এদিনও হাসপাতাল জানাল, আপাতত কোনও অপারেশন হবে না। তাই ভর্তিও করা হবে না।”
এসএসকেএমেও ভোগান্তির ছবিটা বদলায়নি। অভিযোগ, ভবানীপুরের এক বাসিন্দাকে প্রায় দু’ঘণ্টা ইমারজেন্সির সামনে অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে থাকতে হয়েছে। পাশে বসে তাঁর স্ত্রী বলেন, “ওঁর পেটে জল জমে যাচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। কিন্তু খরচ টানতে না পেরে এখানে নিয়ে এসেছি। কিন্তু এতক্ষণ শুইয়ে রাখার পর জানাল, বেড নেই। ভর্তি নেওয়া হবে না। অন্যত্র নিয়ে যেতে বলল। আর কত দিন এই অবস্থা চলবে জানি না। একজনের বিচার চাইতে গিয়ে অন্যদের শাস্তি দেওয়া হচ্ছে।”
হাওড়ার মন্দিরতলার বসিন্দা এক মহিলা বলেন, “সকালে মাকে নিয়ে এসেছি। ইমারজেন্সিতে ঢুকিয়ে রেখে দিয়েছে। মায়ের শ্বাসকষ্টের জটিল অসুখ রয়েছে। কোনওভাবেই অক্সিজেন খোলা যায় না। এই অবস্থায় এখন রেফার করে দিয়েছে। পিজিতেই যদি এই অবস্থা হয়, তাহলে অন্য জায়গায় কী হবে বলুন তো! চিকিৎসা ব্যবস্থার হাল দেখে আশঙ্কা হচ্ছে, বিনা চিকিৎসায় মা মারা যেতে পারেন।” বলতে বলতে চোখে জল ওই মহিলার।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজেও দুর্ভোগের ছবি একইরকম। দীর্ঘক্ষণ লাইন দিয়ে আউটডোরে পৌঁছে চিকিৎসককে দেখাতে হয়েছে। রোগীদের কথায়, “ভিতরে ডাক্তার কম। তাই রোগী দেখতে দেরি হচ্ছে। ফলে লম্বা লাইন। দেড় ঘণ্টা লাইনের দাঁড়ানোর পর চেকআপ করাতে পারলাম।” অন্যান্য রোগীদের বক্তব্য, “জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলন করছেন। হাসপাতালে রোগী না দেখে রাস্তায় ক্যাম্প করছেন। সরকারি হাসপাতালে দিনে হাজার হাজার রোগী আউটডোরে আসেন। তাঁদের অধিকাংশের কাছে স্মার্টফোন থাকে না। টেলিমেডিসিনের সাহায্যে ক’জন চিকিৎসা নিতে পারেন? গরিব মানুষের কথা কেউই ভাবে না। এভাবেই গরিব মানুষকে বিনা চিকিৎসায় মরতে হবে।”
আরও পড়ুন: আজ বিধানসভায় ‘অপরাজিতা উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড’ বিল পেশ রাজ্যের