বিক্ষোভে ইভেন্ট প্রমোটার এখন কিছু টিভি চ্যানেল

অরাজনীতির পোশাক পরিয়ে মিছিলে লোক পাঠাচ্ছে। আবার প্রয়োজনে পার্টি অফিসও খুলে দিচ্ছে। এ দৃশ্য অস্বীকার করবেন কোন মুখে?

অভিজিৎ ঘোষ

এই লেখার শুরুতেই বলে নেওয়া দরকার, আরজি করের ঘটনায় যে বা যারা দোষী তাদের শাস্তি হোক, কঠোর শাস্তি হোক। একজনও যেন রেহাই না পায়। তদন্ত করছে সিবিআই, মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে। তারাই সঠিক পথ দেখাক, আসল দোষীদের খুঁজে বের করুক। রাজ্য সরকারও মনেপ্রাণে সেটাই চাইছে।

কিন্তু এই আন্দোলন ঘিরে অশুভ এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তথাকথিত কয়েকটি বড় চ্যানেল আর গুটি কয়েক সংবাদপত্র অন্ধ সরকার বিরোধিতার খেলায় নেমেছে, হাতিয়ার জাস্টিস চাই আন্দোলন। এরাই এখন আন্দোলনকে প্রমোট করতে নেমেছে অনেকটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের ভূমিকায়। সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে এই অভিযোগই এখন আসতে শুরু করেছে।

অভিযোগটা কী? এই সংবাদমাধ্যমগুলি বিভিন্ন সংগঠনের কাছে গিয়ে বলছে, আপনারা মিছিল করুন, আমরা লাইভ দেখাব। কাদের বলছে? যাদের সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে কোনও অস্তিত্ব নেই। নেই কোনও জনভিত্তি, নেই কোনও সামাজিক কাজের দায় বা ইতিহাস। অথচ তারা পথে নামছে। কখনও কোনও ক্লাবের কাছে গিয়ে বলা হচ্ছে আপনারা নামুন। আবার কখনও কোনও রাজনৈতিক দলের সেই সব ফ্রন্টকে বলা হচ্ছে পথে নামুন যাদের দূরবীনেও খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তাদের গেঞ্জির রঙ, স্লোগান, ব্যানার সব তারাই ঠিক করে দিচ্ছে, প্রয়োজনে ছাপিয়েও দিচ্ছে! মিছিলের রুট বলে দিচ্ছে। শনি-রবিবার বেছে নেওয়ার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এ বি সি ডি বড় চ্যানেল যখন এই মিছিল দেখাচ্ছে, তখন অন্য সংবাদমাধ্যমও সেই পথের শরিক হচ্ছে, হতে বাধ্য হচ্ছে। কারণ, সেখানে তখন শুরু গিয়েছে টিআরপির খেলা। শুধু একা বা দোকা দেখিয়ে কেন টিআরপি তুলবে কতিপয় সংবাদমাধ্যম, আমরাও দেখাব, বড় ছবি দিয়ে কাগজে ছাপাব। কারণ, মানুষ এটা এখন নিচ্ছেন। যেসব তথাকথিত বিরোধী দলের সাধারণ নির্বাচনে জামানত জব্দ হয়, তাদের ভাতৃপ্রতিম সংগঠন এই সুযোগে মিছিলে নেমে পড়ছে। যে ক্লাব বা সংস্থাগুলোর মিটিং ডাকলে কোরাম হয় না তারাও মুখ দেখাতে নেমে পড়ছে।

সংবাদমাধ্যমের কারও কারও লক্ষ্যটাই হল রাজ্য সরকারের বিরোধিতা করা, অন্ধ বিরোধিতা করা। অরাজকতার ছবি তুলে ধরা। মানুষ ক্ষুব্ধ এমন দৃশ্য দেখাতে হবে। ফিল্মি দুনিয়ার কয়েকজনকে সামনে রাখ, আকর্ষণ বাড়বে। তাদের প্রচার দাও। তাহলে একদিন-দু’দিন-তিনিদিন… আসবেন। দরকারে ফোর-ক্যাম লাইভ। বৃষ্টির মধ্যেও মিছিল হবে। তাতে মানুষের সেন্টিমেন্টটা আরও তুলে ধরা যাবে। ন্যায়বিচার রইল পিছনে পড়ে, লক্ষ্য সর্বনিয়ন্তা হওয়া। রাজ্য সরকার তদন্ত করছে না, মামলা সুপ্রিম কোর্টে জেনেও আন্দোলনের মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। তাদের আসল বিরোধিতা অবশ্য অন্য জায়গায়। বাংলার সেই মিথ হয়ে যাওয়া প্রবাদটা এক্ষেত্রে যথাযথ, অর্থই অনর্থের কারণ। সেটা কেউ বুঝুক না বুঝুক, মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রির অনেকেই বোঝেন। সেই বিরোধিতা তো সরাসরি করা যায় না, তাই হাতিয়ার জাস্টিস আন্দোলন। পাশাপাশি এটাও বোঝানোর চেষ্টা, আমরাই আন্দোলন তৈরি করব, নিয়ন্ত্রণ করব। সুবিধা হল, মানুষ এখনও সংবাদ মাধ্যমের প্রচারে বিশ্বাস করেন, ছাপানো অক্ষরকে সত্য বলে মেনে নিয়ে তর্ক জোড়েন। কিন্তু সাধারণ মানুষ অভিজ্ঞতা দিয়ে ক্রমশ বুঝছেন, অনুভবও করছেন। যে আবেগটা ছিল মানুষের সেটা এখন হাত ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে মিডিয়া নামের আড়ালে এইসব প্রমোটারদের হাতে। তারাই এখন ইভেন্ট ম্যানেজারের ভূমিকায়। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কখনও আন্দোলনের মঞ্চে খাবার পরিবেশন করছে। কখনও আন্দোলনকারীদের পাখার হাওয়া দিচ্ছে। অরাজনীতির পোশাক পরিয়ে মিছিলে লোক পাঠাচ্ছে। আবার প্রয়োজনে পার্টি অফিসও খুলে দিচ্ছে। এ দৃশ্য অস্বীকার করবেন কোন মুখে?

অনেকে আবার এই আন্দোলনের সঙ্গে বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনের তুলনা টানছেন। কিন্তু তুলনার নামে এটা মানুষকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা। বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন আন্দোলন করছেন তখন ছিল না এতো চ্যানেল, সংবাদপত্র কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ারও কোনও অস্তিত্ব। সেই অবস্থাতেই তৎকালীন বিরোধী নেত্রীর আন্দোলন ছিল একদিকে যেমন সাংগঠনিক, অন্যদিকে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের একটা কোয়ালিশন তৈরি হয়েছিল সেই সময়। সঙ্গে ছিল না কোনও সংবাদমাধ্যম কিংবা সামাজিক মাধ্যমে ঘন ঘন আপডেট, ছবি, ভিডিও উঠে আসার সুযোগ ছিল না। আন্দোলনকে ভণ্ডুল করে দিতে তখনকার বাম সরকারের ছিল প্রতি মুহূর্তের চক্রান্ত। কিন্তু সেই চক্রান্ত জন-আন্দোলনেই ভেস্তে গিয়েছে। আর আজকের আন্দোলন তো স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীই সমর্থন করেন। আবেগকে পূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন। তাদের দাবির সঙ্গেও সহমত পোষণ করেন।

১৯৮৩ সালে ডাক্তারদের আন্দোলন ভাঙতে জ্যোতি বসুর বামফ্রন্ট সরকার হাসপাতালে-হাসপাতালে পুলিশ আর ক্যাডার বাহিনী নামিয়ে ঠেঙিয়ে ছিল। আর আজকে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী সটান চলে গিয়ে কথা বলছেন, আশ্বাস দিচ্ছেন, তাদের নিরাপত্তার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা করছেন। এ দৃশ্য কেউ ভাবতে পেরেছে? কোনও মুখ্যমন্ত্রীর রয়েছে এমন বুকের পাটা? বিজেপি মন্ত্রীর ছেলে তো আন্দোলনকারীদের উপর গাড়ি চালিয়ে চারজনকে খুন করেছে। এই তো সেদিনকার কথা। এতো সহজে ভুলে যাব! সুপ্রিম কোর্ট ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পরেও জুনিয়র ডাক্তারদের বিরুদ্ধে একটিও পদক্ষেপ করেনি রাজ্য সরকার। আর দিল্লিতে বিজেপি সরকার ধর্মঘটীদের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে। অভিভাবকের মতো বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, ওরা ছোট ছেলে। আবেগ আছে। দাবি আছে। মান্যতা দিই। আলোচনায় বসেই সমস্যা মিটবে। পার্থক্যটা স্পষ্ট।

তদন্ত করছে সিবিআই আর ঘেরাও হচ্ছে লালবাজার। কেন? মামলা চলছে সুপ্রিম কোর্টে, রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হচ্ছে চিঠি। কেন? মুখ্যমন্ত্রী আলোচনার দরজা খুলে বসে থাকছেন আর লাইভ স্ট্রিমিংয়ের অজুহাত তুলে বারবার তা ভেস্তে দেওয়া হচ্ছে। কাদের প্ররোচনায়? জুনিয়র ডাক্তারদের সব দাবি মেনে নেওয়ার পরেও বারবার নতুন নতুন দাবি তোলা হয়েছে। পিছনে কোন রাজনৈতিক দল? পিছনে কোন সংবাদমাধ্যমের প্ররোচনা? কারা চায় না সমস্যার সমাধান হোক কিংবা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হোক? ডাক্তারদের সামনে রেখে রাজনীতির খেলা। প্রায়শই শহর ব্যতিব্যস্ত। চিকিৎসা না পেয়ে ২৯ জনের মৃত্যু। এক মৃত্যুর বিচার চাইতে গিয়ে এতগুলো মৃত্যু! তার বিচার হবে না? ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট মিডিয়া নির্লজ্জের মতো তা না দেখিয়ে মিছিলের ছবি দেখাচ্ছে। এ কোন নৈতিকতার পাঠ শেখাচ্ছে মিডিয়া? প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে অনেক রোগী চলে যাচ্ছেন বেসরকারি হাসপাতালে। সর্বস্ব দিয়ে চিকিৎসা করাচ্ছেন। বেসরকারি হাসপাতালের বিল বেড়েছে ৪০ শতাংশ। যে চিকিৎসকরা আন্দোলনের শরিক, তারাই বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করছেন, পকেট ভরছেন। পুজোর মরশুমে ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ে ভাঁটা। রাতদখলের নামে জনজীবন ব্যতিব্যস্ত। তাহলে কাদের জন্য এই আন্দোলন? কোনও কিছু প্রমাণ হওয়ার আগেই কিংবা সিবিআই তথ্য জোগাড়ের আগেই মিডিয়া ট্রায়াল শুরু হয়ে যাচ্ছে। একটা ধারণা তৈরি করে দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা। সারাক্ষণ পর্দায় শুধু সেই ছবি আর বিতর্ক। তদন্তকারীদের সরাসরি প্রভাবিত করার প্রকাশ্য চেষ্টা। চ্যানেলের বিতর্কের প্যানেলে অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে যাদের নিয়ে আসা হচ্ছে তারা অধিকাংশই আগমার্কাযুক্ত রাজনৈতিক দলের সদস্য। কেউ সিপিএম, কেউ বিজেপি কেউবা অতিবাম কিংবা কেউ নি:শেষ হয়ে যাওয়া কংগ্রেস। বারবার নির্বাচনী লড়াইয়ে যাদের মানুষ ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা হল, লাইট-ক্যামেরা আর সাংবাদিকরা সামনে না থাকলে অনেক মিছিলই অঙ্কুরেই শেষ হয়ে যেত। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই বাস্তব।

মানুষ বুঝছেন। উপলব্ধি করছেন। অনুভব করছেন এই আন্দোলনের পিছনে অন্য এক খেলার ঐকান্তিক চেষ্টা। যে চেষ্টার অন্যতম অনুঘটক তথাকথিত কয়েকটি বড় চ্যানেল আর সংবাদপত্র। তারাই এখন বাংলার নতুন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রমোটার।

 

Previous articleExclusive: OC-র জেরায় অসংগতি খুঁজতে হিমশিম CBI
Next articleআরজি কর-কাণ্ডে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের ফের আলোচনায় বসার প্রস্তাব রাজ্য সরকারের