Wednesday, December 17, 2025

‘চারণ কবি ব্রেখট’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

” উঠে দাঁড়াও , পার্টির বিপদের দিনে ।

জানি তুমি রোগগ্রস্ত ,
কিন্তু পার্টি মুমূর্ষু ,
জানি তুমি দুর্বল , তবু তোমারই সাহায্য চাই ।
উঠে দাঁড়াও , পার্টির বিপদের দিনে ।
জানি তুমি নানা দ্বিধায়
দোদুল্যমান , কিন্তু আজ নেই কোনো দ্বিধার অবকাশ ,
আমরা উপনীত চরম সীমায় ।
জানি দিয়েছো পার্টিকে
বহু অভিশাপ , আজ আর নেই মান অভিমানের সময় ,
পার্টি আজ আক্রান্ত ।
উঠে দাঁড়াও , পার্টির বিপদের দিনে । উঠে দাঁড়াও এক্ষুনি ।
জানি তুমি অসুস্থ , কিন্তু তোমায় দরকার । মরার অনেক সময় পাবে পরে ,
এখন চাই তোমার সাহায্য ।
থেকো না দূরে দূরে ,
লড়াইয়ে যাচ্ছি আমরা ,
উঠে দাঁড়াও পার্টির বিপদের দিনে , উঠে দাঁড়াও । ”

( বের্টোল্ট ব্রেখটের লেখা নাটকের গান ।
নাটক : ডী মুটার , ম্যাক্সিম গোর্কির লেখা ‘ মাদার ‘ নাটকের ছায়ায় রচিত । বিপ্লবী পাভেলের মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন তাঁর মা , আর তাঁর উদ্দেশে শ্রমিকদের দল গানটি গাইছেন কোরাসে )

উত্তর ঘুমিয়ে পড়ে । কিন্তু প্রশ্ন জেগে থাকে । জাগিয়ে রাখে পরিপার্শ্বকে । উত্তর নশ্বর , কিন্তু প্রশ্ন অনির্বাণ , অবিনশ্বর। সঙ্কটের কল্পনাতে ম্রিয়মান হয়ে থাকা সময়কে প্রশ্ন । সমকালকে প্রশ্ন । প্রশ্ন বৈষম্যের বিশ্বব্যবস্থাকে । প্রশ্ন ক্রমশ বিলীয়মান মনুষ্যত্বকে ।

মানুষের অস্তিত্বের সঙ্গে প্রশ্নকে গেঁথে দিতে হলে মাধ্যম হিসেবে চাই সুস্থ বিনোদন , যা দিতে পারে থিয়েটার । অসীম এই তিলোত্তমা শিল্পের ক্ষমতা। কবি ও নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখট তাই তাঁর বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে বেছে নিলেন নাটক । নাচ , গান , স্লোগান , কবিতাকে অভিনয়ের সঙ্গে এতটাই নিপুণভাবে মিশিয়ে দিলেন যে , বিশ্বনাট্যের ধারায় যুক্ত হলো একটি সম্পূর্ণ নতুন নাট্যশৈলী , যা এককথায় অভিনব । তাঁর ‘ এপিক থিয়েটার ‘ বিশ্ববিশ্রুত , বিশ্ববন্দিত ।

মনোরঞ্জন অবশ্যই থাকবে , তবে সেই মনোরঞ্জনের মূল উদ্দেশ্য হবে প্রশ্ন তুলে দেওয়া এবং দেশ , কাল ও সমাজের প্রকৃত ছবি দর্শকদের সামনে নিয়ে আসা । পরিপার্শ্ব নিয়ে মানুষকে ভাবতে বাধ্য করার দায় কাঁধে তুলে নিলেন ব্রেখট। তিনি একাধারে কবি , ঔপন্যাসিক , নাট্যকার , গীতিকার ও সুরকার ।

ব্রেখট বিশ্বাস করতেন যে , একজন অভিনেতার যেকোনো চরিত্রকে এমনভাবে উপস্থাপন করা উচিত যা ছদ্মবেশী নয় , বরং চরিত্রের ক্রিয়াকলাপের বর্ণনা । তিনি মহাকাব্যিক থিয়েটার তৈরি করে ইতিহাসকে প্রভাবিত করার প্রয়াস করেন , যা দর্শকবৃন্দ শুধু বিশ্বাস নয় , উপলব্ধি করবেন । তিনি বলতেন , তত্ত্ব ও প্রয়োগের ভারসাম্য আসে নন্দনতত্ত্বের সঠিক ব্যবহারে ।

কবি বেখট অননুকরণীয় । শম্ভু মিত্রের অনুবাদে ব্রেখটের এই কবিতাটি অবিস্মরণীয় :
” তোমরা যারা এই বন্যার মধ্য থেকে জেগে উঠে দাঁড়াবে —
যে বন্যাতে আমরা সবাই তলিয়ে গেলাম ,
সেই তোমরা যখন আমাদের ত্রুটিগুলোর কথা বলবে
তখন এটুকুও ভেবো
যে কোন্ এক অন্ধকার যুগে আমরা বেঁচেছি
যে অন্ধকার থেকে
তোমরা বেঁচে গেছো । ”

ইউজিন বার্থহোল্ড ফ্রেডরিখ ব্রেখট ( ১৮৯৮ — ১৯৫৬ ) বিশ্ববিশ্রুত জার্মান নাট্যকার , নির্দেশক । তাঁর নাটকে মানবতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের জয়গানের পাশাপাশি যুদ্ধ , বৈষম্য ও শোষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে বারবার । নাট্যকার ডেভিড এডগার ব্রেখট সম্পর্কে বলেছেন , ‘ আমরা যে বাতাসে শ্বাস নিই , ব্রেখট তারই এক অংশ । ‘

রাষ্ট্র চিরদিন যাঁকে সন্দেহের চোখে দেখে , তিনি কি যেমন তেমন মানুষ ? কবিতায় , গানে , নাটকে তাঁর নিশানা যুগ-যুগান্তরের মানুষখেকো ব্যবস্থা । তাঁর প্রেম , তাঁর দ্রোহ সবই বিশ্ব-মানবতার স্বার্থে ।

১৯৩৩ সালে নাৎসিদের অত্যাচারে দেশ ছাড়ার পর বাকি জীবনটা প্রায় ভবঘুরের মতো এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন ব্রেখট। তাঁর নিজের দেশ বলে কিছু ছিল না । হলিউড কালচার তাঁর পছন্দ হয় নি ।
বহু পথ , বহু দেশ ঘুরে তিনি পূর্ব বার্লিনে আসেন ১৯৪৯ সালে । এখানে তিনি গড়ে তোলেন ‘ বার্লিনার এনসেম্বল’ । ১৯৫৬ সালের ১৪ আগস্ট এখানেই তিনি মারা যান । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তিনি ছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে , সেখানে তাঁকে সন্দেহ করা হতো সাম্যবাদী হিসেবে এবং এফ বি আইয়ের নজরদারিতে তাঁকে থাকতে হয় ।

১৯১৪ সালে তিনি রচনা করেন তাঁর প্রথম নাটিকা ‘ দ্য বাইবেল’ । ১৯২০ সালে লেখেন পূর্ণ দৈর্ঘ্যের নাটক ‘ বল ‘ ।১৯২২-এ লেখেন ‘ ম্যান ইকুয়ালস ম্যান ‘ । ‘ দ্য বেগার্স অপেরা ‘ অবলম্বনে তাঁর নাটক ‘ দ্য থ্রি পেনি অপেরা ‘ সারা বিশ্বে আলোড়ন তোলে । নাৎসিদের বর্বর অত্যাচার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা তাঁর জীবনে ও রচনায় গভীর প্রভাব ফেলে ।

ড্রামস ইন দ্য নাইট , দ্য বেগার , আ রেসপেক্টেবল ওয়েডিং , লিটল মাহাগনি , সেন্ট জোন অফ স্টকিয়ার্ডস, লাইফ অফ গ্যালিলিও , দ্য ট্রায়াল অফ লুকুলাস , দ্য ডেজ অফ দি কমিউন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য নাটকগুলো ব্রেখট তৈরি করেন ১৯১৮ সাল থেকে ১৯৫৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে।

আরও পড়ুন- জাতীয় মঞ্চে পর্দাফাঁস হবে আনন্দ বোসের! স্পীকার সম্মেলনে যোগ বিমানের

মাত্র ৫৮ বছরের আয়ুষ্কালে তিনি বিশ্ব-নাটকের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ অন্য খাতে , অন্য ধারায় বইয়ে দিয়ে গেছেন । কবিতা ছিল যাঁর প্রথম প্রেম , কবিতাতেই যিনি খুঁজে পেয়েছিলেন প্রথম আলো , বিপ্লবের সেই চারণকবি ব্রেখটের একটি কবিতাংশের অনুবাদ পাঠ করা যাক এ নিবন্ধের উপসংহারে : ” জানি , তোমরা সবাই চাও যে আমি চলে যাই

তোমাদের পক্ষে একটু বেশিই দেখে ফেলি আমি , ঢের বেশি খাই , বুঝতে পারছি আমার মতো লোকের সঙ্গে চলার রীতিনীতি তোমাদের জানা নেই । কিন্তু মশাইরা , সহজে আমি যাচ্ছি না । সাফসাফ বলছি সবাইকে , ভাগের মাংস সব দিয়ে দাও আমায় । পায়ে-পায়ে তোমাদের অনুসরণ করেছি সর্বদা ।আগেই জানিয়েছি যে চলে যেতে হবে কিন্তু তোমাদেরই , তোমাদের ভাষা আমি মিছিমিছি শিখিনি বাবা ।

 

spot_img

Related articles

NCRT-র সিলেবাসে বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ইতিহাস রাখার দাবি ঋতব্রতের

এনসিইআরটি-র পাঠ্যবইয়ে বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের (Bengali Freedom Fighters) ইতিহাস অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানালেন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ ঋতব্রত...

অস্কার নমিনেশনে শর্টলিস্টেড ‘হোমবাউন্ড’! উচ্ছ্বসিত করণ শুভেচ্ছা জানালেন টিমকে

অ্যাকাডেমি পুরস্কার জেতার স্বপ্ন দেখছে ভারতীয় বিনোদন জগত (Indian Entertainment Industry)। মঙ্গলবার ৯৮তম অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডসে সেরা আন্তর্জাতিক ফিচার...

সুপ্রিম নির্দেশে সরলো আর জি কর ধর্ষণ-খুন মামলা: শুনানি এবার কলকাতা হাই কোর্টে

আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে (R G Kar Medical College And Hospital) চিকিৎসক-পড়ুয়ার ধর্ষণ-খুনের মামলার এবার নতুন মোড়।...

টাকার দামে পতন অব্যাহত! আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি ঘিরে ধোঁয়াশা বাড়ছে

ভারতীয় টাকার দামে (Indian Rupee Rate) আবারও বড় পতন দেখা গেল। বুধবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ ডলার প্রতি টাকার...