
” লোকে টিকিট কেটে মাঠে এসেছে আমার ফুটবল দেখতে , আপনার রেফারিং দেখতে নয় ” , এমন কথা কলিনাকে বলার সাহস কোনো ফুটবলার কখনও দেখান নি । দেখাবেনই বা কী করে ! বিশ্ব ফুটবলের সমস্ত মারকুটে খেলোয়াড়দের হাড় হিম হয়ে যেতো বাঁশি মুখে কলিনাকে দেখলে । তাঁর চেহারা শ্যামের মতো না হলেও তাঁর বাঁশির সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল অসীম । রোগা পাতলা , ইন্দ্রলুপ্ত কলিনার ছিল নজরকাড়া একজোড়া আশ্চর্য চোখ । সে চোখে চোখ রাখা মুশকিল । তাই চোরাগোপ্তা ফাউল করার প্ল্যান নিয়ে যে সব ফুটবলার মাঠে নামতেন তাঁরা বাঁশি মুখে পিয়েরলুইগি কলিনাকে দেখে একেবারে হকচকিয়ে যেতেন এবং সব প্ল্যান মুলতুবি রেখে মাঠে শান্তশিষ্ট আচরণ করতেন বাধ্য হয়ে ।

চুলহীন মাথা এবং আগুনের ভাটার মতো একজোড়া বিস্ফারিত চোখ সাধারণ চেহারার কলিনার মধ্যে এমন এক চুম্বক ব্যক্তিত্ব এনে দিয়েছিল যা থেকে চোখ ফেরানো যেতো না । ফুটবল মাঠের চালু কথা , যিনি যত কম বাঁশি বাজিয়ে ম্যাচ খেলাতে পারেন তিনি তত বড়ো রেফারি । কলিনা সেই বিরল প্রজাতির রেফারি , যিনি যথাসম্ভব কম বাঁশি বাজিয়ে নিজের অসামান্য ব্যক্তিত্ব ও চূড়ান্ত ফিটনেসের সাহায্যে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের যে কোনো ম্যাচ , এমনকি বিশ্বকাপ ফাইনাল পর্যন্ত সফলভাবে সম্পন্ন করে গেছেন । লোকে ড্রিবলিং , পাসিং , হেডিং , সেভিং , থ্রু-পাস , কর্নার কিক , ব্যক্তিগত মুন্সিয়ানা তথা দলগত ফুটবল দেখতে মাঠে ভিড় জমান । দেখতে যান নয়নাভিরাম গোল ও অসাধারণ সব সেভ । দেখতে যান দুর্দান্ত সব সেটপিস মুভ।

কিন্তু রেফারিংয়ের মধ্যে দেখার কি আছে ? আজ্ঞে হ্যাঁ , দেখার আছে অনেককিছুই । দেখার আছে নিখুঁত ম্যাচ পরিচালনা , চূড়ান্ত নিরপেক্ষতা এবং রেফারিংয়ের সর্বোচ্চ মানের উৎকর্ষতা যা ফুটবল ম্যাচের আনন্দ ও উত্তেজনাকে সফল ও সার্থক করে তোলে । রেফারিং নিয়ে কেউ যেন কোনো প্রশ্ন তুলতে না পারেন সেটার প্রতি লক্ষ্য রাখাও একজন উৎকৃষ্ট মানের রেফারির অন্যতম প্রধান কাজ । বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনাল ম্যাচে ম্যাচ পরিচালক হিসেবে কলিনাকে দেখতে পাওয়াটা ছিল দর্শকদের কাছে এক বিরল প্রাপ্তি । তাঁর হিমশীতল দৃষ্টিকে উপেক্ষা করা একপ্রকার অসম্ভব ।

১৯৬০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কলিনার জন্ম উত্তর ইতালির বোলোনিয়া শহরে । শৈশব থেকেই পাগলের মতো ফুটবল খেলতেন বন্ধুদের সঙ্গে । সঙ্গে বাস্কেটবল । ১৭ বছর বয়সে পৌঁছে কলিনা বুঝতে পারেন পেশাদার ফুটবলার হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব রয়েছে তাঁর । এটা বুঝে যাওয়ার পর স্থানীয় রেফারি সংঘ আয়োজিত রেফারিং কোর্সে ভর্তি হয়ে যান তিনি ।

এরপর কয়েক বছরের মধ্যেই দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে বাধ্যতামূলকভাবে সামরিক দায়িত্ব পালনের জন্য তাঁকে যেতে হয় মিলিটারিতে । ম্যাচ পরিচালনার মতো একটি কঠিন কাজে কলিনার সহজাত দক্ষতা প্রকাশ পায় সেনাবাহিনী থেকে ফিরে আসার পর । বলের কাছাকাছি থাকতে হয় রেফারিদের । চূড়ান্ত শারীরিক সক্ষমতার কারণে কলিনা তাঁর সমগ্র রেফারি- জীবনে বলের সবচেয়ে কাছাকাছি থেকেছেন । বিশ্ব ফুটবলের সর্বকালের অন্যতম সেরা রেফারি হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ হিসেবে কলিনার কাঁধে এসে পড়ে ইতালিয়ান ফুটবল লিগের তৃতীয় ডিভিশনের ম্যাচ পরিচালনার গুরুদায়িত্ব । টানা তিন বছর সফলভাবে এই দায়িত্ব পালনের পর তিনি দ্বিতীয় বিভাগে উন্নিত হন এবং তারপর সিরি-আ অর্থাৎ প্রথম ডিভিশনের ম্যাচ খেলাতে শুরু করেন । এই সময়েই কলিনা আক্রান্ত হন অ্যালোপেশিয়া রোগে । এই রোগের কারণেই তাঁর মাথার সব চুল পড়ে যায় এবং চেহারার আশ্চর্য রকম পরিবর্তন হয় । তাঁর বিস্ফারিত চোখ দেখে ফুটবলারদের হার্টবিট বেড়ে যেতো । তাঁকে সম্ভ্রম করতে বাধ্য হতেন খেলোয়াড়রা । ১৯৯৫ সালে তিনি ফিফা রেফারির স্বীকৃতি পান । ১৯৯৬ অলিম্পিকের পাঁচটি আন্তর্জাতিক ম্যাচে রেফারিং করেন । আর্জেন্টিনা ও নাইজেরিয়ার মধ্যে হওয়া ফাইনাল ম্যাচটিও তিনিই পরিচালনা করেন । ১৯৯৮ সালের ফ্রান্স বিশ্বকাপে দুটি ম্যাচ পরিচালনা করেন তিনি।
এরপর ২০০২ সালে এশিয়ায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে জার্মানি ও ব্রাজিলের মধ্যে হওয়া ফাইনালের রেফারিং করেন কলিনা । নিজের রেফারিং জীবনে মোট ১১ টি ফাইনাল ম্যাচ পরিচালনা করেছেন এই অসামান্য ইতালিয়ান । তাঁর শেষ ম্যাচ ছিল ২০০৫ সালের ২৪ আগস্ট । এই ম্যাচে একটি ন্যায্য গোল বাতিল করে প্রচণ্ড বিতর্কের মুখে পড়েন কলিনা । বুঝতে পারেন এবার বাঁশি তুলে রাখার সময় হয়েছে । কঠোর ও কোমলের সার্থক সমাহার পিয়েরলুইগি কলিনার কাছে ফুটবলাররা ছিলেন সন্তানসম । তাঁর মতো সংবেদনশীল রেফারি খুব বেশি দেখেনি ফুটবলবিশ্ব ।

আরও পড়ুন- সোমের বৈঠকে আসুন অনশন তুলে: জুনিয়র ডাক্তারদের ইমেলে আবেদন মুখ্যসচিবের
