ঘনঘোর বর্ষার দিনে থেমে গেল এক বিশিষ্ট সাহিত্য-স্রষ্টার কলম। প্রয়াত প্রখ্যাত সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়। বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ বাংলা সাহিত্যজগৎ।
এদিন তাঁর অকাল প্রয়াণে শোকপ্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়| নিজের সোশ্যাল হ্যান্ডেলে তিনি লেখেন “বর্ষীয়ান কথাসাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়ের মৃত্যুতে আমি গভীর শোক জ্ঞাপন করছি। প্রফুল্ল রায় জন্মেছিলেন পূর্ববঙ্গে এবং পরবর্তীকালে তাঁর নানা বিখ্যাত গ্রন্থে উদ্বাস্তু জীবনের যন্ত্রণা ফুটে উঠেছিল। ‘কেয়াপাতার নৌকো’ তাঁর কালজয়ী উপন্যাস। নানাসময়ে একাধিক সংবাদপত্র-পত্রিকা গোষ্ঠীর সঙ্গেও তিনি ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন এবং বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় স্থায়ী জায়গা পেয়েছেন। ২০১২ সালে আমরা তাঁকে একটি বিশেষ পুরস্কার দিতে পেরেছিলাম। আমি তাঁর পরিবার ও অগণিত পাঠকের প্রতি আমার সমবেদনা নিবেদন করছি।”
১৯৩৪ সালের ১১ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত ভারতের বিক্রমপুরে জন্মেছিলেন প্রফুল্ল রায়। দেশভাগের দগদগে ক্ষত বুকে নিয়ে ১৯৫০ সালে চলে আসেন স্বাধীন ভারতে। এরপর কলকাতাই হয়ে ওঠে তাঁর নতুন ঠিকানা। কিন্তু বিচ্ছেদের যন্ত্রণা, শিকড়ছেঁড়া মানুষের হাহাকার তাঁকে আজীবন তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। সেই যন্ত্রণাই কলমে তুলে ধরেছেন, তাঁর অমর সৃষ্টি ‘কেয়াপাতার নৌকো’-তে।
রাজদিয়া গ্রাম, তাঁর শৈশবের পটভূমি, আর সেই গ্রামকে কেন্দ্র করেই রচিত হয়েছে তাঁর এই কালজয়ী উপন্যাস। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে গড়া এই উপন্যাস আজও প্রাসঙ্গিক, স্পর্শ করে লক্ষ পাঠকের হৃদয়। তাঁর গল্প ও উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে ৪৫টিরও বেশি টেলিফিল্ম, ধারাবাহিক ও চলচ্চিত্র।
মনে পড়ে যায়—
• ‘পিঞ্জর’ (১৯৭১)
• ‘বাঘবন্দী খেলা’ (১৯৭৫)
• ‘মোহনার দিকে’ (১৯৮৪)
• ‘একান্ত আপন’ (১৯৮৭)
• ‘চরাচর’ (১৯৯৪)
• ‘টার্গেট’ (১৯৯৭)
• ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ (২০০৩)
• ‘ক্রান্তিকাল’ (২০০৫)
• এবং সর্বজনবিদিত ‘কেয়াপাতার নৌকো’
প্রফুল্ল রায়ের ঝুলিতে রয়েছে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার (২০০৩, ‘ক্রান্তিকাল’-এর জন্য), ‘শরৎস্মৃতি’ পুরস্কার সহ বহু স্বীকৃতি।
তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের তালিকায় রয়েছে—
• প্রতিধ্বনি
• আগুনের কাছাকাছি
• ভাতের গন্ধ
• উত্তাল সময়ের ইতিকথা
• রথযাত্রা
• পিতৃভূমি
আরও অগণিত কাহিনি, যেখানে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন প্রান্তিক মানুষের যন্ত্রণা, চেতনার দোলাচল, ও বাংলার মাটি-মানুষের অন্তর্গত টানাপোড়েন। তাঁর মৃত্যুতে বাংলা সাহিত্য হারাল এক নীরব অথচ তীক্ষ্ণ বিদ্রোহের ভাষ্যকারকে।
এ যেন সত্যিই ইন্দ্রপতন। সাহিত্যপ্রেমীরা বলছেন, “কেয়াপাতার নৌকো এবার আর ফিরবে না… কিন্তু আমরা সেই ঢেউ-এর শব্দ শুনে যাব আজীবন।” বিদায় প্রফুল্ল রায়। কলম থেমেছে, কিন্তু শব্দ থেকে যাবে ইতিহাসের পাতায়।
আরও পড়ুন – হাইব্রিড মাছ চাষে নিষেধাজ্ঞা, বিধানসভায় ঘোষণা মৎসমন্ত্রীর
_
_
_
_