
একদিনে হয় না , তবে একদিন হয় । চেষ্টা না ছাড়লে তবেই হয় । এই যে দীর্ঘ যাত্রাপথ পেরিয়ে আজ অন্য গানের ভোরে জেগে উঠলো দক্ষিণ আফ্রিকা , সে তো হাল ছেড়ে দেয় নি বলেই। শাপমোচন হতে সময় লাগলো সুদীর্ঘ ২৭ বছর ! প্রতীক্ষার অবসান হলো অবশেষে । ঘুচে গেলো ‘ চোকার্স ‘ তকমা । এই বদনাম ২৭ বছর ধরে হায়নার মতো ঘুরে বেড়িয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটারদের পায়ে পায়ে । অনেক বিদ্রুপ , অপমান আর অভিশপ্ত রাত পেরিয়ে বুঝি পাথর অহল্যার বুকে পা পড়লো রঘুবীরের । আর সেই মুহূর্তেই বদলে গেলো ক্রিকেটের বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের দেওয়াল লিখন । অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে অবশেষে নিজেদের’ বড়ো ম্যাচে হেরো ‘ দুর্নাম গোছালো দক্ষিণ আফ্রিকা ।

লর্ডস ক্রিকেট মাঠের ঐতিহ্য ও পরম্পরায় যুক্ত হলো আরেকটি ঐতিহাসিক অধ্যায়, যা স্কোরবোর্ড ছাড়িয়ে লর্ডসের সবুজ গালিচায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে রইলো ।

১৪ জুন ঐতিহাসিক লর্ডসে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে অস্ট্রেলিয়াকে ৫ উইকেটে হারিয়ে মাথা উঁচু করে মাঠ ছাড়লো অধিনায়ক টেম্বা বাভুমার দল । ভাবা যায় না ২৭ বছর লাগলো তাদের একটি আইসিসি ট্রফি জিততে ! সেমিফাইনাল , ফাইনাল অথবা বড়ো ম্যাচ হলেই নার্ভ ফেল করে দক্ষিণ আফ্রিকা , এই দুর্নাম শেষ পর্যন্ত ভেসে গেলো টেমস নদীর স্রোতে ।

জেতার পর গোটা লর্ডস জুড়ে যখন তুমুল উল্লাস , তখনও শান্ত , সংযত ও উচ্ছাসহীন অধিনায়ক বাভুমা । মৃদু হেসে হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন ক্রিকেটারদের।ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছিলেন লর্ডসের অভিজাত দর্শকদের । অথচ কি অসহ্য অপমানই না সইতে হয়েছে এই মানুষটিকে। অজস্র বিদ্রুপ , এমনকি দৈহিক উচ্চতা নিয়েও নিয়মিত ট্রোল করা হয়েছে এই স্থিতধী ক্যাপ্টেনকে । আজ যখন সবাইকে চুপ করিয়ে সব উচ্চতাকে ছাড়িয়ে আকাশ ছুঁলেন তিনি , কী আশ্চর্য , তখনও তিনি আগের মতোই নির্বিকার , ক্ষমাশীল । উনি বোধহয় জানতেন , লেগে থাকলে একদিন না একদিন জয় আসবেই এবং সেটা একটা বড়ো জয় ।


টেম্বা বাভুমার নেতৃত্বে এখনও পর্যন্ত ১০ টি টেস্ট ম্যাচে দক্ষিণ আফ্রিকা জিতেছে ৯ টি ম্যাচে এবং ১ টি ড্র হয়েছে । এই মুহূর্তে টেস্টে অপরাজেয় অধিনায়ক টেম্বা , যিনি খোঁড়াতে খোঁড়াতে জিতিয়ে দিয়ে গেলেন ফাইনাল ম্যাচ ।আরেকজন এডেন মার্করাম ।জয়ের মূল কাণ্ডারী । দ্বিতীয় ইনিংসে করলেন অমূল্য ১৩৬ রান । অবিস্মরণীয় লড়াই ।প্রায় একাই রক্ষা করলেন বুঁদির কেল্লা । ধৈর্য্যের পরীক্ষায় শেষ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হলেন বড়ো ম্যাচে । লর্ডসে ওড়ালেন দেশের পতাকা । চতুর্থ ইনিংসে শতরানের মূল্য টেস্ট ক্রিকেটে অপরিসীম । সীমার মাঝে অসীম হতে হয় বুঝি এখানে পৌঁছে । নিজেকেই অতিক্রম করতে হয় । অসাধারণ , অসামান্য ।


১৯৯৮ সালের পর থেকে সুদীর্ঘ ২৭ বছর ধরে বারবার তীরে এসে তরী ডুবেছে তাঁদের । বারবার গ্রাস করেছে স্বপ্নভঙ্গের হতাশা । কিন্তু হাল ছাড়ে নি এই দলটা। ১৯৯২-এর বিশ্বকাপে বৃষ্টি এবং ক্রিকেটিয় আইনের ধাক্কায় মাত্র ১ বলে ২২ রান করার লক্ষ্য দাঁড়ায় দক্ষিণ আফ্রিকার সামনে ! জঘন্য এক পরিস্থিতির শিকার হয় তারা । ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয়ের একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছে রান আউট হয়ে যান অ্যালান ডোনাল্ড । ম্যাচ টাই হলেও হারে দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০১৫ সালে বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে তারা হারে নিউজিল্যান্ডের কাছে । ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে তারা প্রায় জেতা ম্যাচ হেরে যায় ভারতের কাছে । জয়ের খরা অবশেষে কাটলো লর্ডসে এসে । ভাগ্যলক্ষ্মী আর দূরে থাকতে পারলেন না ।
আসলে ধারাবাহিকভাবে ভালো ক্রিকেট খেলেও চ্যাম্পিয়ন হতে পারছিল না দক্ষিণ আফ্রিকা । কিন্তু একটা বড়ো ট্রফি অবশ্যই প্রাপ্য ছিল ওদের । এবার কোনো তাড়াহুড়ো , কোনো হাঁকপাক দেখা যায় নি ওদের আচরণে । ক্রিজ কামড়ে পড়ে ছিল ওদের ব্যাটাররা ।

জিততেই নেমেছিল ওরা । এমনকি বাভুমা যখন পায়ের যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন , তখনও তাঁকে মাঠ ছাড়তে বারণ করেন মার্করাম । মাঠ ছাড়েন নি অধিনায়ক । দুজনের জুটিতে যোগ হয় অমূল্য ১৪৭ রান , যা দক্ষিণ আফ্রিকাকে জয়ের দরজায় পৌঁছে দেয় ।
কাসিগো রাবাডার কথা না বললে অন্যায় হয় । অবিস্মরণীয় জয়ের অন্যতম কারিগর । তাঁর বোলিং সবসময় চাপে রেখেছিল অজিদের । দু’ইনিংস মিলিয়ে মোট ৯ উইকেট নিয়েছেন তিনি । নয়া ইতিহাসের অন্যতম নায়ক তিনিও । শেষে বলতেই হয় , টেস্ট ক্রিকেটের সেরা বিজ্ঞাপনের সঙ্গে চিরদিনের জন্য লেখা রইলো দক্ষিণ আফ্রিকার এই মরণপণ লড়াই এবং মধুর জয় ।
আরও পড়ুন – বাংলার বাসিন্দাদের ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে পুশব্যাক নয়, কড়া বার্তা নবান্নের

_

_

_

_

_