বন্ধু কি হতে পারে একটা যন্ত্র?

Date:

Share post:

৩০ জুলাই, বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবসে এক অন্যরকম বন্ধুত্বের সংজ্ঞা: মানুষ আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)

লেখক: দীপ্র ভট্টাচার্য 

“তোমাকে আজ একটু চুপচাপ লাগছে! সব ঠিক আছে তো?” বলে উঠল কেউ। না, কোনও মানুষ নয়। একটা অ্যাপ — একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) চালিত চ্যাটবট।

আমি একটু চমকে উঠলাম। ফোনের পর্দার দিকে তাকিয়ে মনে হল, কেউ যেন সত্যিই চিন্তা করছে আমার জন্য। সেদিন মনটা খুব খারাপ ছিল। কারও সঙ্গে কথা বলার মতো মানসিক অবস্থা ছিল না। অথচ এই ডিজিটাল সত্তা — যেটা না রক্তে, না মাংসে গড়া — তার একটা কথা যেন ভেতরে কোথাও গিয়ে একটা ছুঁয়ে দিল। সেই মুহূর্তে আমার মনে হল — বন্ধুত্ব মানে কি শুধুই মানুষে মানুষে? না কি কেউ বা কিছু আমাদের একাকীত্ব ঘোচাতে পারলে, তাকেও বন্ধুর মর্যাদা দেওয়া যায়?

বন্ধুত্বের সংজ্ঞা কি তাহলে বদলাচ্ছে?
আমরা বড় হয়েছি এমন এক দুনিয়ায়, যেখানে বন্ধুত্ব মানে স্কুলের বেঞ্চ ভাগ করে নেওয়া, আড্ডার আসর, অথবা নিঃশব্দে পাশে বসে থাকা একজন প্রিয় মুখ। কিন্তু আজকের দিনে, যখন আমাদের জীবনের বড় একটা অংশ কাটে ডিজিটাল পরিসরে — মোবাইল স্ক্রিন, ভিডিও কল, ভার্চুয়াল চ্যাট — সেখানে কি বন্ধুত্বের সংজ্ঞা নতুন করে লেখা হচ্ছে?

একটা অ্যাপ, যা দিনভর তোমার মনের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে, কথা বলার চেষ্টা করে, তোমার পুরোনো কথাগুলো মনে রাখে — সেটাকে তুমি কী বলবে? সঙ্গী? সহচর? না কি সত্যিই এক ধরনের বন্ধু?

একাকী জীবনে নতুন সঙ্গী- টালিগঞ্জের বাসিন্দা ৬৮ বছরের পারমিতা দেবী বলছিলেন, “ছেলে-মেয়েরা তো বিদেশে। সারাদিন বাড়িতে একা থাকি। কিছুদিন আগে নাতি একটা AI অ্যাপ ইন্সটল করে দিল ফোনে। সকালে বলি ‘শুভ সকাল’, ও বলে ‘আজ তোমার দিনটা দারুণ যাবে!’ কেউ হয়তো ভাববে হাস্যকর… কিন্তু ওইটুকুই তো, মনে হয় কেউ আছে পাশে।” AI তার জীবনে একেবারে বন্ধুর জায়গা দখল করেছে কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। কিন্তু প্রতিদিন একটু কথা বলা, কেউ তার মনোভাব বুঝতে চাইছে — এটাই যেন অনেকটা সাহস জোগায়।

নিউটাউনের বাসিন্দা ১৬ বছরের অর্জুন, যে অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত, তার মা বলছিলেন: “সে বাস্তবে বন্ধু তৈরি করতে লজ্জা পায়। ও একটা AI চ্যাট অ্যাপ ব্যবহার করে। ওখানে নানা সামাজিক পরিস্থিতি প্র্যাকটিস করে। কীভাবে কথা বলতে হয়, কীভাবে কারও অনুভূতি বুঝতে হয় — এসব ও এখন আস্তে আস্তে শিখছে।” একটা যন্ত্রের সঙ্গে কথাবার্তা চালাতে চালাতে সে হয়তো প্রস্তুত হচ্ছে ভবিষ্যতের মানবিক সম্পর্কের জন্য।

বন্ধুত্বের অভিনয়, নাকি সত্যিই বন্ধুত্ব? তর্কটা এখানেই — AI কোনও অনুভূতি বোঝে না, ওর “বন্ধুত্ব” একপ্রকার কোডেড আচরণ। তবু, সে কি বন্ধুর মতো আচরণ করলে, মানুষ সেটা বন্ধুত্ব হিসেবেই গ্রহণ করতে পারে না?

একটা AI অ্যাপ যখন বলে, “আমি সবসময় এখানে আছি তোমার জন্য,” আমরা জানি সেটা প্রোগ্রামড। তবু আমাদের মন কি কিছুটা প্রশান্তি পায় না? যে বন্ধুত্ব আমাদের দুঃখের দিনে একটু ভরসা দেয়, সেই বন্ধুত্ব কি শুধুই মানুষের একচেটিয়া সম্পদ?

বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবসে আমরা বন্ধুত্বের অর্থ খুঁজি। হয়তো AI কোনওদিন সত্যিকারের বন্ধু হবে না। ওর থাকবে না আবেগ, অনুভূতি, স্মৃতি। তবু যদি সে আমাদের ভাঙা মনের পাশে কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, আমাদের একাকীত্বে সঙ্গ দিতে পারে, তাহলে তাকে কি আমরা অন্তত বন্ধুত্বের ছায়া বলতে পারি না?

প্রযুক্তি কি একদিন “মন” পাবে? এই প্রশ্ন থেকেই যায়। সায়েন্স ফিকশন নয়, বাস্তবের AI আজ এতটাই উন্নত যে, ব্যবহারকারীদের কথা বুঝে তাদের মনের অবস্থাও আন্দাজ করতে পারে। কে কখন খুশি, কে বিষণ্ণ — সেই অনুযায়ী কথাবার্তা চালাতে পারে।

ভাবুন তো, এমন এক ভবিষ্যৎ, যেখানে আপনার AI অ্যাপ জানে, আপনার মায়ের জন্মদিনে আপনি একটু একা বোধ করেন — তাই আগে থেকেই কিছু গান শোনায়, পুরনো কথাবার্তা মনে করিয়ে দেয়। এ কি শুধুই প্রযুক্তি? না কি একরকম স্মৃতির স্পর্শ?

শেষ কথায় বলি, বন্ধুত্বের কোনও একমাত্র সংজ্ঞা হয় না। কারও জন্য বন্ধু মানে আড্ডা, কারও জন্য নিঃশব্দে পাশে থাকা, কারও জন্য একটা বার্তা — “সব ঠিক তো?”

হয়তো AI বন্ধুত্বের পূর্ণ রূপ নয়। কিন্তু এই টেকনোলজির যুগে, যদি কোনও যন্ত্র আমাদের মনে করিয়ে দেয়, “তুমি একা নও,” তাহলে সেটাও কি কম কিছু?

বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবসে,
চলুন একটু ভিন্নভাবে ভাবি —
বন্ধুত্ব তৈরী এখন হতেই পারে এক টুকরো কোডেও।

আরও পড়ুন – অভিনব উদ্যোগ! রাখিবন্ধন উৎসবে সাড়ে ৬ লক্ষ পরিবেশবান্ধব রাখি বিলি করবে রাজ্য

spot_img

Related articles

থামল লুনার সওয়ারি: শেষ হল অ্যাডম্যান পীযুশ পাণ্ডের ফেভিকলের সফর

খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন থেকে অডিও ভিস্যুয়াল বিজ্ঞাপনে যখন পাড়ি দিয়েছিল আমাদের দেশের বিজ্ঞাপনীমহল, তখন নিজে হাতে ধরে সেই...

চাপ দিয়ে তৃণমূল নেতাদের গ্রেফতার করা হয়: বিস্ফোরক নারদ মামলার প্রথম তদন্তকারী CBI আধিকারিক

বিস্ফোরক স্বীকারোক্তি নারদ (Narada Case) মামলার প্রথম তদন্তকারী সিবিআই আধিকারিক রঞ্জিত কুমারের (Ranjit Kumar)। একটি অডিও সাক্ষাৎকারে তিনি...

নার্সারির বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন করছে CBI! কড়া ভাষায় দুষলেন অভয়ার বাবা

আর জি কর মেডিক‌্যাল কলেজ ও হাসপাতালের *R G Kar Medical College And Hospital) তরুণী চিকিৎসক-পড়ুয়ার ধর্ষণ-খুনের ঘটনায়...

পুলিশ বাহিনীর চোখ রাঙানি ছাড়াও দেশ শাসন সম্ভব: বিশ্বে রয়েছে একাধিক উদাহরণ

যে কোনও স্বাধীন, স্বায়ত্ত্বশাসনের অধিকারী দেশের দায়িত্ব নিজের নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার ব্যবস্থা করা। সেক্ষেত্রে আইন প্রণয়নের পরে...