ঘর-বাড়ি, সহায় সম্বল সব গিয়েছে। কিন্তু ভিটে মাটি এমনভাবে চলে যাবে যেখানে চাইলেও আর নতুন করে বসতি গড়ে তোলা যাবে না, এটা বোধহয় স্বপ্নেও ভাবেননি উত্তরকাশির (Uttarkashi) এই এলাকার মানুষগুলো। পাহাড়ের ঢালে ঘর আর কী করেই বা বানাবেন। তাদের জমি চলে গিয়েছে আস্ত একটা হ্রদের গ্রাসে। থাকার জমি, জাতীয় সড়কের একটা অংশ, সেনা ছাউনির হেলিপ্যাড – সব গিলে নিয়েছে সেই হ্রদ (lake)। উত্তরকাশির হরশিল (Harshil) গ্রামের একাংশ জুড়ে তৈরি হওয়া এই হ্রদের কী নাম দেবেন, এখন ভাবছেন স্থানীয়রা।

মেঘ ভাঙা বৃষ্টি বা তার জেরে হড়পা বান উত্তরাখণ্ডের (Uttarakhand) মানুষের কাছে এখন নিত্তদিনের ঘটনা হয়ে গিয়েছে। ফলে বান আসার অশনি সংকেত পেলে পালানো রুটিন হয়ে গিয়েছে। কিন্তু ক্ষীরগঙ্গা (Kheer Ganga) নদীতে যে হড়পা বান (flash flood) এসেছিল ৫ অগাস্ট তা যে অন্য যে কোনও বানের থেকে আলাদা ছিল, তা সেই ভয়ঙ্কর ভিডিও থেকেই আশঙ্কা করা গিয়েছিল। এপর্যন্ত ৫ জনের মৃত্যুর খবর সামনে এলেও অন্তত ৬০ জনের নিখোঁজ থাকার খবর রয়েছে। যার মধ্যে সেনাবাহিনীর কর্মী থেকে নির্মাণ কর্মীও রয়েছে।

ভারতীয় সেনার হরশিলের যে ক্যাম্প ছিল তারই একটা অংশ ক্ষীরগঙ্গার হড়পা বানে ধুয়ে গিয়েছে। সেখানেই ভাগীরথীর ধার বরাবর ছিল সেনাবাহিনীর হেলিপ্যাড। সেই এলাকার কী অবস্থা দেখতে গিয়েই চক্ষুচড়কগাছ সেনার আধিকারিকদের। কোথায় হেলিপ্যাড, কোথায় বা তার আশেপাশের বসতি। গোটা এলাকা জুড়ে প্রায় ৪ কিমি লম্বা এক হ্রদ দাঁড়িয়ে রয়েছে এখন।

হড়পা বানে জলের তোড়ে সব ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া নতুন নয়। নদীর বয়ে আনা গাছপালা, মাটি-কাদায় (sediment) বিস্তীর্ণ অংশ ভরে যাওয়াও স্বাভাবিক। ঠিক সেভাবেই ধারালি ও হরশিল গ্রামের বহু মানুষ যে অনেকেরই চোখের সামনে কাদামাটির নিচে চাপা পড়ে গিয়েছেন, তা বাস্তব। তাঁদের অনুসন্ধান সেনাবাহিনী, সেনার প্রশিক্ষিত কুকুর, এনডিআরএফ চালালেও তাঁদের জীবিত খুঁজে পাওয়ার আশা বৃথা। কিন্তু কাদামাটির সঙ্গে নদী এত জল বয়ে আনবে যা কোথাও জমে আস্ত একটা হ্রদ হয়ে যাবে, ভূমিরূপে এমন পরিবর্তন খুবই বিরল।

সেখানেই প্রশ্ন, তবে এই হড়পা বানের পিছনে আসল কারণ কী? ইতিমধ্যেই ইসরো এই নিয়ে গবেষণায় সাহায্য শুরু করেছে তাদের স্যাটেলাইট ইমেজ দিয়ে। সেই ছবিতে ধরা পড়েছে কীভাবে ভাগীরথীর উপর ব-আকৃতির ধারালি গ্রাম একটা বিরাট দ্বীপের আকার নিয়েছে। যার ফলে ভাগীরথীর ধারাই সরু হয়ে গিয়েছে। হড়পা বানের (flash flood) এই মাটি (sediment) বয়ে নিয়ে আসা নতুন নয়। এত জল বয়ে আনারই কারণ খুঁজছেন ভূতত্ত্ববিদ ও আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা।

ইসরো-র স্যাটেলাইটের একটি ছবি তুলে ধরছে ধারালি গ্রামের ৭ কিমি উপরে হিমবাহের বড়সড় চিড় ধরার ঘটনা। এমনিতেই এই এলাকা ধস প্রবণ। ২০১৩ সালে একটি হড়পা বানে ধারালির উপর দিকে তেহরি এলাকায় হড়পা বান এসেছিল। তখন থেকেই কার্যত ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে হিমালয়ের এই অংশ। ফলে হিমবাহে চিড় ধরলে তাপমাত্রা খুব বেড়ে যাওয়ার কারণে বিপুল পরিমাণ জল হিমবাহ থেকে বয়ে আসা অসম্ভব নয়।

যদিও হ্রদ তৈরি নিয়ে আরও একটি তত্ত্ব সামনে এসেছে। দু্র্বল হলে তা নিয়ে ভাবছেন বিশেষজ্ঞরা। ভয়ঙ্কর জলীয় বাষ্পপূর্ণ মেঘ স্থানীয় নিচু পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি এমন চেহারা নিয়েছিল, যে গোটা মেঘের জল নতুন করে হড়পা বানের পলিমাটি জমা অংশে পড়েছিল। যার ফলে তৈরি হয় হরশিলের এই হ্রদ।

এখন, জলের তো রক্তের মতই রঙ, চরিত্র আলাদা করা সম্ভব নয়। ফলে হরশিলে (Harshil) তৈরি হ্রদের জল হিমবাহ (glacier) গলে এসেছিল, না মেঘ ভাঙা বৃষ্টির (cloud burst) জল – তা নিয়ে আরও গবেষণা করতে হবে বিজ্ঞানীদের, ইসরো-কে। সরকার বাহাদুরের মাথা ব্যথা হয়ে থাকবে কীভাবে সেনাবাহিনীকে অন্যত্র হেলিপ্যাড তৈরির জায়গা দেওয়া যায়। আর তার থেকেও বেশি চিন্তার, হ্রদের গর্ভে চলে যাওয়া গঙ্গোত্রী জাতীয় সড়ক নতুন করে কোথা দিয়ে বানানো হবে।