Monday, November 3, 2025

‘পাবলো নেরুদার মৃত্যু’, উৎপল সিনহার কলম 

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

কয়েক হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন যিনি , তাঁর নিজের মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা আজও কাটে নি ।

১৯৭৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে ভর্তি হন পাবলো নেরুদা । হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ২৩ সেপ্টেম্বর রাতে বাড়িতে মারা যান। দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। তাঁর হার্টের অবস্থাও ভালো ছিল না। তারপরও কেন বলা হয় যে , তৎকালীন শাসকদের হাতে খুন হয়েছিলেন তিনি ? কেন বলা হয়, বিষপ্রয়োগে তাঁর মৃত্যু হয়? জেনারেল পিনোশের সামরিক সরকার নেরুদার শরীরে বিষ প্রয়োগ করার নির্দেশ দিয়েছিল সেই হাসপাতালের চিকিৎসককে। হাসপাতালে ভর্তি পাবলো নেরুদাকে হত্যা করার জন্য ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁর তলপেটে

একটা ইনজেকশন দেওয়া হয়। তাতে বিষ ছিল। পিনোশের সামরিক একনায়কতন্ত্র শেষ হওয়ার ১১ বছর এবং নেরুদার মৃত্যুর ৩৮ বছর পর নেরুদার গাড়িচালক তথা ব্যক্তিগত সহকারী ম্যানুয়েল আরাইয়া ওসোরিও মেক্সিকোর প্রোসেসো ম্যাগাজিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব তথ্য জানান।

যে রাতে তিনি মারা যান, সেদিন সকালে দেশত্যাগের প্রস্তুতি হিসেবে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গোছগাছ করার জন্য নেরুদার নির্দেশে বাড়িতে গিয়েছিলেন কবিপত্নী উরুতিয়া এবং ম্যানুয়েল আরাইয়া। কেননা পরদিনই তাঁদের মেক্সিকোর দিকে রওনা হওয়ার কথা। কিন্তু দুপুরের পর আতঙ্কিত নেরুদা জরুরি ভিত্তিতে তাঁদের হাসপাতালে চলে আসার জন্য ফোন করেন। কারণ তাঁর পেটে ইনজেকশন দেওয়ার পর থেকেই তিনি ভীষণ অসুস্থ বোধ করছিলেন।

আরাইয়া বলেন, ‘ মৃত্যুর আগে বিশ্বকে একটা সত্য আমি জানিয়ে যেতে চাই যে, পাবলো নেরুদাকে খুন করা হয়েছিল’।

তবে তাঁর মৃত্যুর তদন্ত রিপোর্টে বলা হয় ক্যান্সারে মৃত্যু হয়েছে কবির। কিন্তু ২০১৭ সালে বিশেষজ্ঞদের আরেকটা কমিটি কবির ক্যান্সারে মৃত্যুর ধারণাকে নাকচ করে দিয়ে জানায় যে, নেরুদার মৃত্যু হয়েছে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে, এটি শরীরের বাইরে থেকেও ঢুকতে পারে।

আরেকটি নিবিড় পর্যবেক্ষণে জানা যায় তাঁর শরীরে প্রয়োগ করা হয়েছিল মানব দেহের জন্য মারাত্মক প্রচুর পরিমাণ ক্লোরিস্ট্রিডিয়াম বটুলিয়াম নামের টক্সিন, যা স্নায়ুকে অবশ করে মৃত্যু ঘটায়।

প্রসঙ্গত, একনায়ক পিনোশের শাসনকালে ৪০ হাজারের বেশি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের এবং সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের অসহ্য নির্যাতন ও নানা কৌশলে খুন করা হয়। টক্সিন প্রয়োগে স্নায়ু অবশ করে হত্যার ব্যাপারটি সেই কৌশলগুলোর অন্যতম।

৬৯ বছর বয়সী প্রচণ্ড অসুস্থ পাবলো নেরুদাকে খুন করা হয়েছিল কেন? এর উত্তর একটাই। তাঁর কবিতা, তাঁর ভীষণ জনপ্রিয়তা এবং তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে ভয় পেতো একনায়কতন্ত্রের পূজারী পিনোশে সরকার। নেরুদা ছিলেন তাদের পথের প্রধান কাঁটা। জনমানসে নেরুদার মারাত্মক প্রভাব ভয় ধরিয়েছিল শাসকদের বুকে।

সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ তথা মানুষের সার্বিক মুক্তিতে বিশ্বাসী পাবলো নেরুদা ( ১৯০৪ — ১৯৭৩ ) ছিলেন চিলির অন্যতম প্রধান কবি, যাঁর ব্যাপ্তি ও জনপ্রিয়তা ছিল বিশ্বময়। ১৯৭১ সালে পান নোবেল পুরস্কার। কূটনীতিক ও রাজনীতিক হিসেবেও তাঁর ছিল ব্যাপক পরিচিতি। বুর্জোয়া তথা ফ্যাসিস্ট ও একনায়কতন্ত্রীরা তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছে বারবার। নিষিদ্ধ করেছে তাঁর কবিতা ও অন্যান্য লেখা। তাঁর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছে। তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরার চেষ্টা করেছে বহুবার। কিন্তু শাসকদের তোয়াক্কা করেন নি অকুতোভয় এই কবি । কলম্বিয়ান ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ পাবলো নেরুদাকে ‘ বিংশ শতাব্দীর যে কোনো ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ কবি ‘ হিসেবে অভিহিত করেন। এটা মানতেই হয় যে, পাবলো নেরুদা ছিলেন পশ্চিমা ঐতিহ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা লেখকদের একজন, যিনি  মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য নিজের জীবন সমর্পণ করেছিলেন।

তিনি লিখেছেন : ” আজ রাতে আমি সবচেয়ে দুঃখজনক পংক্তি লিখতে পারি ” । লিখেছেন: ” প্রেম এত ছোট, ভুলে যাওয়া এত দীর্ঘ ” ।

মানবিক, তুমুল সংবেদনশীল, অথচ চরম বস্তুবাদী নেরুদা কোনোদিন কোনো মানুষের জন্যই আকাশের ওপারে কোনো প্রতিশ্রুত স্বর্গে বিশ্বাস করেন নি। তিনি এমন এক স্বর্গে বিশ্বাস করতেন যেখানে তিনি নিজে কোনোদিন যাবেন না। অন্যদের স্বর্গলাভে তাঁর কোনো আপত্তি ছিল না। এই পৃথিবীটাকেই স্বর্গ হিসেবে গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষায় আমৃত্যু তিনি ছুটে বেড়িয়েছেন বিশ্বময়।

আরও পড়ুন – রবিবাসরীয় বিহার ভোট প্রচার জমজমাট: পুকুরে সাঁতরে নজরে রাহুল

spot_img

Related articles

ঝুলনকে নিয়েই সাফল্যের উদযাপন স্মৃতিদের, বাঙালির গর্ব বিশ্বকাপজয়ী রিচা

পঙ্কজ রায় থেকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বা ঝুলন গোস্বামী, ক্রিকেট বিশ্বের দরবারে বাংলার মুখ অনেকেই। কিন্তু সৌরভ-ঝুলনদের পাশে ছিল...

মায়ানগরীতেই স্বপ্নপূরণ, এক নজরে ব্যাটে বলে ধামাকাদার ম্যাচের স্কোর বোর্ড

মুম্বইকে বলা হয় মায়ানগরী। কত স্বপ্ন এখানে সফল হয়। এই মুম্বইয়ের ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ২০১১ সালে ২ এপ্রিল ওয়ানডে...

ক্রিকেটে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারতের মেয়েরা: শুভেচ্ছা প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর ও ক্রীড়ামন্ত্রীর

রবিবারের মধ্যরাতে রচিত হল নতুন ইতিহাস। প্রথমবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারতের মহিলা ক্রিকেট ব্রিগেড। ইতিহাস রচনা হওয়ার রাতে ভারতীয়...

দীপ্তি-শেফালিদের হাত ধরেই বিশ্ব জয়ের তৃপ্তি, ইতিহাস সৃষ্টি হরমনপ্রীতদের

বিশ্বসেরা ভারত(India)। মহিলাদের একদিনের বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন টিম ইন্ডিয়া। মুম্বই ইতিহাস সৃষ্টি ভারতীয় মহিলা দলের। প্রোটিয়াদের ...