
প্রথমে সিমেন্টের রাস্তায়
লোহার ঠেলাগাড়ির আওয়াজ
তারপর চিৎকার ,
‘ ময়লা আছে? ‘
ছুটে যাই । উপুড় করে দিই
ডাস্টবিন।

ভাবি যদি সব ময়লা উজাড় করে দিতে পারতাম ! পারি না। কিছুটা ময়লা থেকেই যায় একোণে – ওকোণে , মনে ।

চরম রোমান্টিক, অথচ রোমান্টিকতায় ভেসে যায় না যাঁর পংক্তিমালা, বরং ধাক্কা খেয়ে গূঢ় সত্যের মুখোমুখি বারবার দাঁড়ায় অকপট, অকুতোভয়, তিনিই কবি অরণি বসু।

সত্তরের অগ্রগণ্য কবি। দীর্ঘ চার দশক ধরে সম্পাদনা করে চলেছেন সাহিত্য পত্রিকা ‘ উলুখড় ‘ । এ যাবৎ প্রকাশিত তাঁর চারটি কবিতার বই, ‘ লঘু মুহূর্ত ‘ , ‘ শুভেচ্ছা সফর ‘ , ‘ ভাঙা অক্ষরে রামধনু ‘ এবং ‘ খেলা চলে ‘ ।

আমাদের টেলিফোন নেই, ফ্রিজ নেই, জলতরঙ্গ আছে।আমাদের গ্রীষ্মকালীন দার্জিলিং নেই , গাড়িবারান্দা নেই , জলতরঙ্গ আছে। ছেলের জন্মদিনে মাত্র সাড়ে সাত টাকায় কেনা যে জলতরঙ্গ ছেলেকে উপহার দিয়েছিলেন কবি , তা কিভাবে বাড়ির সকলের রাগ কমানোর যন্ত্র হয়ে ওঠে তার মধুর বিবরণ পাওয়া যায় ‘ জলতরঙ্গ ‘ নামের এই আশ্চর্য কবিতায় ।

কবির ঘরে টেলিফোন নেই , ফ্রিজ নেই , কবির কোনো ফিক্সড ডিপোজিট নেই , তবুও সেই ছোট্ট জলতরঙ্গটি আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ হয়ে বাঁচিয়ে রাখে কবির লাল নীল সংসার।

অবিস্মরণীয় সব এলিজি লিখেছেন এই অনন্য কবি। স্বতন্ত্র , অসামান্য , অপূর্ব তাঁর কাব্যভাষা। কবিবন্ধু সমরেন্দ্র দাস একান্ত এক অনুরোধ রেখেছেন কবির কাছে :’ আমার মৃত্যুর পর আমাকে নিয়ে একটা এলিজি লিখবি অরণি ? ‘ ‘ নদী পার হয়ে তুমি চলে গেছো একা। অস্তায়মান সূর্য , হাওয়া আর পাতাঝরার শব্দ। ঝুপ করে নেমে এল অন্ধকার। গান থেমে গেছে অবশেষে… ‘

অন্য এক এলিজিতে লিখেছেন,’ … তোমার ছবিতে মালা পরাতে পরাতে আজ, মা, তোমার শান্ত লাবণ্য আর ছেলেমানুষি মাখা চোখের দিকে তাকিয়ে সহসা বুঝতে পারলুম আমার জীবনে তুমি চিরায়মানা এক নিভৃত মোমবাতি । ‘

এলিজির বিষন্নতা থেকে একটু সরে এসে এবার দাঁড়ানো যাক এক টুকরো নৈসর্গিক আলোয়। ‘ সকলেই কবি তারা, সকলেই , শুধু সোফা নয়,

কাক-কবি , বুড়ো-কবি , আহা, সেই ফড়িংও তো কবি। আমি যে তাদেরই বন্ধু, খর্বকায় কৃকলাস আমিও কি কবি নই ? যত কবি রণজিৎ দাশ ? ‘অরণি বসুকে চমৎকার ধরেছেন ডঃ পুরুষোত্তম সিংহ তাঁর ‘ অরণি বসু সরণিতে কিছুক্ষণ ‘ প্রবন্ধে।
সভ্যতার গোলকধাঁধা, তার কপটতা ও প্রতারণার সরাসরি মোকাবিলা করতে চান কবি। ইঙ্গিত ও সঙ্কেতের মুখোশ এড়িয়ে , রূপক ও হেঁয়ালির হাত ছাড়িয়ে, অলংকার সজ্জাকে অতিক্রম করে একেবারে আটপৌরে শব্দবিন্যাসে সত্যের মুখোমুখি হতে চান তিনি।
‘ কেউ কারো বন্ধু নয় , শুধু নখ আর দাঁতের চর্চা, কেউ আত্মীয় নয় কারো , শুধু ভয় আর স্বার্থপরতা, বাজনা বলতে পেটের ওপর চাপড় , শিল্প বলতে বাবুদের উঠোনে সম্মিলিত
শিকল – পরা – নাচ । ‘
আবার ইনিই লেখেন:
‘ টুসকি মেরে উড়িয়ে দাও হতাশার দীর্ঘশ্বাস। ‘
এইভাবেই আক্রমণ করতে চান হতাশা, নৈরাজ্য আর সমস্ত নঞর্থক বোধগুলোকে। অরণি বসুর কবিতায় প্রধান হয়ে ওঠে বোধচর্চা। স্পষ্ট বোঝা যায় বাংলা কবিতার প্রচণ্ড ভিড়ে কীভাবে আড়াল খুঁজে স্বতন্ত্র স্বর ঘোষণা করা যায় সেই জরুরি প্রয়াসে তিনি প্রথম থেকেই অগ্রসরমান। প্রান্ত ও কেন্দ্রকে সামনে রেখে ভিন্ন এক বোধ জাগিয়ে তিনি বিশল্যকরণীর সন্ধান করে চলেন। সোজা নয়, জীবনের উল্টোপিঠের কবি অরণি বসু। যে জীবন অন্ধকারের, ভাঙনের, প্রবাহহীনতার, অভিমানের , যে জীবনে প্রাপ্য বলতে শুধুই শূন্যতা বোঝায়, অরণির নায়কেরা সেই পরিসরে বাঁচে। স্বপ্ন দেখে। অদম্য কামনা নিয়ে, অন্ধকারকে সঙ্গী করে ব্যর্থতার অপমানে পৌঁছে যায় নতুন ভোরে । তারপর আবার অন্ধকার, আবার আলো। এই চলতে থাকে। আসলে এই আশ্চর্য জার্নিটাই জীবনের সারসত্য।
ঘনান্ধকারে আমি তাকিয়ে ছিলুম তোমার দিকে, তুমি লক্ষ্য কর নি। কে কবিতা পড়ছিল তখন? কবিদের ঘরোয়া সভায় হঠাৎ ঝুপ ক’রে নেমে এসেছিল লোড-শেডিং ।
তখনই ফস করে দেশলাই জ্বেলেছিল কেউ কেউ, অন্ধকারের মধ্যে, গুঞ্জরণের মধ্যে দেবার্চনার মতো হাতে হাতে ঘুরছিলো সেইসব আলোকশিখা। ম্লান আলোর ভিতর দিয়েও আমি নির্নিমেষ তাকিয়ে ছিলাম তোমার দিকে , তুমি লক্ষ্য কর নি।
আরও পড়ুন – KIFF: রবিবাসরীয় ফিল্মোৎসবে হলিউড ক্লাসিক ‘ব্লু ভেলভেট’ দেখার সুযোগ, দুপুরে ফেলুদার নস্টালজিয়া!

