Friday, November 7, 2025

ফিরে দেখা শিক্ষক দিবসের মুহূর্ত

Date:

Share post:

ইদানীং ফেসবুকের দৌলতে স্কুলের সমকালীন বন্ধুদের মুখে জেনেছি আমাদের সময়ের শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই এখন আর ইহজগতে নেই। সেই প্রতিটি শিক্ষকদের কথা যখন কখনও কোনও বিশেষ কথাপ্রসঙ্গে মনে পড়ে যায়, গলার কাছে দলা পাকানো কষ্টটা এসে ধাক্কা মারে। কী কঠোর অনুশাসনে স্কুলজীবন কেটেছিল। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কড়া নিয়মনীতি মেনে চলতে হত। স্কুলের লোহার প্রধান ফটক যেন জেলখানার গারদ আর আমরা স্কুলভর্তি ছাত্ররা সেই স্কুল নামক জেলখানার ছয় ঘণ্টার কয়েদি। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে দশটার ঘরে পৌঁছানোর খানিক আগেই স্কুলের প্রার্থনাকক্ষে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সমস্ত স্কুল ইউনিফর্ম পড়া ছাত্ররা ও প্রধানশিক্ষক-সহ প্রতিটি সহ-শিক্ষকের উপস্থিতিতে সমবেত কণ্ঠে প্রার্থনা ও দেশবিদেশের মনীষীদের বাণী পাঠ। আমরা আমাদের শিক্ষকদের চোখ রাঙানিতে তটস্থ থাকতাম। ক্লাসে পড়ানোর ধরন এক একজন শিক্ষকের নিজস্বতা থাকত।

পরীক্ষার খাতায় হাতের লেখা ভাল করা থেকে বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরাজি গ্রামারের ভিত গড়ে দেওয়া, ইতিহাস ভুগোল বা জ্যামিতি প্রায় ছবির মতো বুঝিয়ে দেওয়া, অঙ্কের জটিল তত্ত্বগুলিকে ক্লাসের ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে ভেঙে ভেঙে বুঝিয়ে দেওয়া। রসায়ন ও পদার্থ বিজ্ঞানকে ভালবাসতে শেখানো। সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ও আমাদের মধ্যে সাহিত্যের বীজ বুনে দেওয়া—আমাদের  সোদপুর হাই   স্কুলের শিক্ষকরা ছিলেন ছাত্রদের জন্য নিবেদিত প্রাণ। বিদ্যালয়ে ফি বছর 5-6 বার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। এ ছাড়া প্রজাতন্ত্র দিবস ও স্বাধীনতা দিবসের নানান কুচকাওয়াজের অনুষ্ঠান প্যারেড এ সব তো হতই। শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে আমরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতাম। আর সেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি, গান,নাটকে, আমাদের শিক্ষকরাই নিজের হাতে যত্ন করে আমাদের সাজিয়ে দিতেন। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গ্রীনরুমের দায়িত্বটা শিক্ষকারাই সামলে দিতেন। সে সময়টায় সুন্দর বন্ধুর মতো মিশে যেতেন আমাদের সঙ্গে। অন্যসময় কী ভয়ঙ্কর ভয়টাই না পেতাম ওঁনাদের। ক্লাসে একটু অন্যমনস্ক হয়েছি, ওঁনাদের শ্যেন দৃষ্টির নজর এড়াতো না। ক্লাসে হোমওয়ার্ক অসমাপ্ত থাকলে বা অযথা বানান ভুল, টিউটোরিয়ালে কিছু কম নম্বর—এ সব কারণে মৃদু ধমকধামক। অথচ ভালবাসতেন সন্তানের মতো। পরে ভেবে দেখেছি, আপাত রাগী রাগী ইমেজটা ছিল ওঁনাদের মুখোশ মাত্র। অন্তরে সুনিবিড় স্নেহ-ছায়া। আমরাও স্কুলভর্তি সমস্ত শিক্ষক ও ছাত্ররা একটা স্বচ্ছ নিটোল পরিবার হয়ে যেতাম।

মনে পড়ে গেল স্কুল জীবনে অন্তিম দিনটির কথা। মঞ্চে প্রধান শিক্ষক আমাদের সবার উদ্দেশ্যে বিদায়ী ভাষণ দিচ্ছেন। তার আগেই এক ক্লাস নিচের স্টুডেন্টরা গেয়েছে, ‘‘জয়যাত্রায় যাও গো ওঠো ওঠো জয়রথে তব, জয়যাত্রায় যাও গো।’’ আমাদের প্রত্যেকের হাতে অভিজ্ঞানপত্র ও ফুলের তোড়া ও বিবেকানন্দের বই। সবই প্রধানশিক্ষক আমাদের হাতে একে একে তুলে দিয়েছেন। প্রধানশিক্ষকের বিদায়ী ভাষণ, এ দিকে আমাদের হাপুস নয়নে কান্না। সে কান্না আর থামতে চায় না। ও দিকে প্রধানশিক্ষক-সহ অন্যান্য প্রতিটি শিক্ষকের চোখের কোনায় জল।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমাদের নিজস্ব গণ্ডিটাও তো ক্রমশ পরিধি ব্যপ্ত হতে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টির প্রায় প্রতিটি স্যর ম্যামদের প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বের প্রগাঢ় ব্যক্তিত্বের কাছে তখন বাধ্য কুশীলব। তবে এখন যা অভ্যস্ত শিক্ষাব্যবস্থা ও কলেজ ছাত্রছাত্রীদের বচসা, তাণ্ডব মারদাঙ্গার পরিবেশ প্রতিদিন প্রায় কাগজে পড়ি বা টেলিভিশনের লাইভ টেলিকাস্ট বা ব্রেকিং নিউজে আখচার দেখি। আসলে দূষিত হয়ে যাচ্ছে স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির পরিবেশ। যারপরনাই অবাক হতে হয় দুই যুযুধান দলের সংঘর্ষ ও তাণ্ডবলীলা দেখে । অধ্যাপকদের বিরুদ্ধে বিষম বিরোধিতা দেখি। নির্বিঘ্নে পঠনপাঠনের সুস্থ পরিবেশ কলুষিত। ‘ছাত্রানং অধ্যয়ন্দং তপঃ’ এই প্রবাদটি আজ যেন অতীত। আবার কলেজে ছাত্র নিরাপত্তাহীনতা অসন্তোষ এ সবও লেজুর হয়ে জুড়ে আছে। আমরা অধ্যাপক অধ্যাপকদের যে সমীহ ও সম্মানের নজরে দেখতাম—সে আজ কোথায়?

প্রসঙ্গত আবারও ব্যক্তিকথনে ফিরে যাই, কিশোরবেলায় আবৃত্তির শিক্ষক , ছবি আঁকার স্যার, আমরা প্রতিটি গৃহশিক্ষক, অধ্যাপক—এ জীবনের সবার কাছেই কত যে ঋণ থেকে গেল। আরও পরে, আমি নিজেই যখন আমার স্নাতকোত্তর অভিজ্ঞতায় উঁচু ক্লাসের বেশ কিছু ছাত্রছাত্রীকে বাংলা পড়াতাম ও পাড়ার বাচ্চাদের আঁকা শেখানোর টিউশানি করেছি—মানে আমি নিজেও যখন কমবয়েসীদের কাছে ‘শিক্ষক’ পদবাচ্য—‘শিক্ষকদিবসের’ এই বিশেষ দিনটিতে খুদে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে দেদার উপহার পেয়েছি। কেউ বা একক ভাবে, পকেটমানি থেকে বা বাবা-মা-র কাছে আমার জন্য আব্দার করে গিফট কিনে এনেছে। আবার উঁচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের সমবায় ভাবে চাঁদা তুলে শিক্ষকদিবসে আমার জন্য উপহার এনেছে। তাদের সে উপহার দেওয়ার জন্য সম্মান ছিল, নির্ভরতা ছিল, ভালবাসা ছিল, ছেলেমানুষী ছিল আর ছিল টিচারের সঙ্গে মিষ্টি একটা সম্পর্ক। কত কী যে অমুক তমুক উপহার দিতে খুদেরা, বই পেন ফুল এ সব তো ছিলই।

এত দিন পর শিক্ষকদিবস নিয়ে লিখতে বসে আবেগতাড়িত হয়ে পড়ি।

সে যাই হোক। শিক্ষকদিবস আমাদের কাছে আজও একটা মহান দিবস হিসেবেই সূচিত হয়। প্রাচীন গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটল সেই কারণেই কবেই বলে গেছিলেন—‘‘যাঁরা শিশুদের শিক্ষাদানে ব্রতী তাঁরা অবিভাবকদের থেকেও অধিক সম্মাননীয়। পিতামাতা আমাদের জীবনদান করেন ঠিকই। শিক্ষকরা সেই জীবনকে সুন্দর ভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেন।

আরও পড়ুন-কেন 5 সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস জানেন? চলুন দেখে নিই

spot_img

Related articles

চিংড়িঘাটা মোড়ে যানজট কমাতে নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ কেএমডিএ-র

ইএম বাইপাসের চিংড়িঘাটা মোড়ে দীর্ঘদিনের যানজট সমস্যার সমাধানে বড় পদক্ষেপ নিতে চলেছে কেএমডিএ। শান্তিনগর খালের উপর বর্তমান সরু...

নামের বানানভুল থেকে ডিটেনশন আতঙ্ক! এসআইআর আতঙ্কে মানসিক চাপে সাঁইথিয়ায় মৃত্যু বৃদ্ধের

ইলামবাজারের ঘটনার পর ফের এসআইআর আতঙ্কে মৃত্যু বীরভূমে। হৃদরোগে প্রয়াত হলেন সাঁইথিয়া পুরসভার ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা বিমান...

বিহারে প্রথম দফায় অতিরিক্ত ভোটদানে নতুন সমীকরণ! চিন্তায় শাসক শিবির

বিহার বিধানসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় ভোটদানের হার নিয়ে রাজনৈতিক চর্চা তুঙ্গে। বৃহস্পতিবার ১২১টি আসনে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। নির্বাচনী...

JNU-তে ফের বাম জোটের জয়জয়কার, খাতা খুলতে পারল না ABVP

ফের দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ভোটে (JNU Students' Union Elections) খাতা খুলতে পারল না এবিভিপি। JNU ছাত্র...