রাজ্যে পুরভোটের দামামা বেজেই গিয়েছে৷ এপ্রিলে
সম্ভবত ৩ দফায় রাজ্যের ১১০টি পুরসভার নির্বাচন হতে পারে৷ এপ্রিলের মাঝামাঝি হতে পারে কলকাতা ও হাওড়া পুরসভার নির্বাচন৷
তৃণমূল ইতিমধ্যেই ভোট করতে নেমে পড়েছে৷
কিন্তু ভোট- ময়দানে বিজেপি কোথায় ? রাজ্যের মিনি-সাধারন নির্বাচনে লড়তে বঙ্গ-বিজেপি কতখানি তৈরি ? তেমন জবরদস্ত প্রস্তুতি থাকলে বঙ্গ-বিজেপি ভোট নিয়ে ঝাঁপানোর পরিবর্তে ভোট পিছিয়ে দেওয়ার দাবি নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দ্বারস্থ হতো না৷
বঙ্গ-বিজেপি যেভাবে পুরভোট পিছিয়ে দেওয়ার দাবি তুলছে, রাজ্যে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যেই পড়েছে৷ পরীক্ষার সময়ে পুরভোট না করার আর্জি নিয়ে বিজেপি রাজ্য নির্বাচন কমিশনে দরবার করেছে৷ এই দাবির সমর্থনে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের প্রতিলিপিও জমা দিয়েছে৷ বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের বক্তব্য, বলেন, ‘‘পরীক্ষার মরসুমে ভোট হলে কোনও দলই মাইকে প্রচারের সুযোগ পাবে না। তাই আমরা চাই, পরীক্ষার মরসুম শেষ হলে পুরভোট করা হোক।’’ বিজেপি যতই এই দাবি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চালাক, রাজ্যজুড়ে অন্য বার্তা যাচ্ছে৷ রাজনৈতিক মহল বলছে, বিজেপি পুরভোটে লড়ার জন্য তৈরিই নয়। তাই পরীক্ষার অজুহাত তুলে ভোট পিছিয়ে দিতে চাইছে।
লোকসভা নির্বাচনে বাংলা থেকে ১৮ আসন পায় বিজেপি৷ ১৮ আসনের মৌতাত আজ পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারেনি বঙ্গ-বিজেপি৷ এর মাঝে ৩ বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে পর্যুদস্ত হয়েছে তারা৷ জেতা আসন খড়্গপুর এবং লোকসভা ভোটে বিপুল ভোটে এগিয়ে থাকা কালিয়াগঞ্জেও লজ্জাজনকভাবে হেরেছে৷ আসলে লোকসভা ভোট ছিলো নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী করার ভোট৷ ওই ভোটে স্রেফ মোদিজির মুখকে মূলধন করেই বঙ্গ-বিজেপি এই সাফল্য পেয়েছে৷ বঙ্গ-নেতারা এই সত্যিটা মানতে কিছুটা নারাজ৷ তাদের ধারনা, রাজ্য নেতাদের কৃতিত্বেই এই সাফল্য এসেছে৷ ‘মোদিজিকে প্রধানমন্ত্রী করার ভোট’ আর ‘মোদিজির ছবি দেখিয়ে অন্য কাউকে ভোট’ দেওয়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক রয়েছে৷ বঙ্গ-বিজেপি এটা সম্ভবত ধরতে পারছে না৷ তাই এতখানি গয়ং-গচ্ছ ভাব, এতটা শ্লথগতি৷
দ্বিতীয়বারের জন্য রাজ্য সভাপতি হয়েছেন দিলীপ ঘোষ অনেকদিন আগেই৷ পুরসভার নির্বাচন ঘাড়ে শ্বাস ফেলছে৷ একুশের ভোটে বাংলার ক্ষমতা দখল করতে গেলে পুরসভা ভোটে ভালো ফল করতেই হবে। অথচ এখনও পর্যন্ত এই দল পূর্ণাঙ্গ রাজ্য বা জেলা কমিটি গঠন করতেই ব্যর্থ হচ্ছে৷ দেহ-হীন ঢিলেঢালা বিজেপি ভোটে নেমেই চমক দেখিয়ে দেবে, এটা আশা করা নিঃসন্দেহেই বাড়াবাড়ি৷ রাজ্য বা জেলা কমিটি না থাকার অর্থ, হয় বিজেপি উপযুক্ত লোক খুঁজে পাচ্ছেনা, অথবা কমিটি ঘোষনা করলেই দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল প্রকাশ্যে চলে আসবে ঢাক-ঢোল পিটিয়েই৷ এতেই স্পষ্ট হচ্ছে, বঙ্গ-বিজেপির সংগঠন এখনও পাকাপোক্ত হয়নি৷ তাহলে, কীভাবে বঙ্গ-বিজেপি পুর- নির্বাচনে সাফল্য পাবে, তা নিয়ে উঠে আসছে প্রশ্ন। জানুয়ারির শেষে বঙ্গ বিজেপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার কথা ছিল। কিন্তু নানা কারণে তা পরের পর স্থগিত হয়েই চলেছে৷ এই দল ভোটে তুল্যমূল্য লড়বে কাদের ভরসায় ? ওই হাতে গোনা ৮-১০ জন প্রচার-সর্বস্ব, ফেসবুক-নির্ভর, সংগঠনহীন রাজ্যনেতা তৃণমূলকে হারিয়ে দেবে? ৫৭ সদস্যের একটি ইলেকশন-ম্যানেজমেন্ট কমিটি বিজেপি ঘোষনা করেছে৷ এই কমিটির আহ্বায়ক মুকুল রায়৷ ভোট বোঝা বা ভোট করানোর অভিজ্ঞতা বঙ্গ-বিজেপির যে কোনও নেতার থেকে মুকুল রায়ের
বেশি, সন্দেহ নেই৷ কিন্তু তিনি একা কী করবেন? তৃণমূল থেকে যে সব বিধায়ক বিজেপিতে গিয়েছেন, তাঁদেরই কিছুটা ভোটে জেতার অভিজ্ঞতা আছে৷ বিজেপির আদি নেতাদের তো ভোটে ‘হারা’-র অভিজ্ঞতাই স্ট্রং৷ কাদের নিয়ে ঘুঁটি সাজাবেন মুকুল রায় ? এই কমিটি বিজেপিকে কোন সাফল্য এনে দেবে ?
তৃণমূল ইতিমধ্যেই পুরভোটে নেমে পড়েছে। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দলের তকমা পাওয়া বিজেপি শিবিরে পুরভোট নিয়ে কোনও সাড়াশব্দই নেই। গেরুয়া-শিবিরের এক ‘রাজ্য নেতা’ দিনদুয়েক আগে অবশ্য দাবি করেছেন, কলকাতা পুরভোটের জন্য বিজেপির প্রার্থী তালিকা না’কি তৈরি হয়ে গিয়েছে৷ জানা নেই, কোন উন্মাদ এ কথা বিশ্বাস করছেন!
বাস্তব চিত্র তো খুবই হতাশজনক৷ কলকাতায় বিজেপি’র সদস্য সংগ্রহ অভিযান কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে৷ সদস্য সংগ্রহ এতটাই কম যে কলকাতা পুরসভা ভোট শেষ হয়ে গেলেও বিজেপি শহরের চারটি সাংগঠনিক জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষনাই করতে পারবে না৷ এখনও কলকাতার চার সাংগঠনিক জেলার
সভাপতিই ঠিক করতে পারেনি বিজেপি৷ তাই, পরীক্ষার অছিলায় পুরভোট পিছিয়ে দেওয়ার দাবি তোলা ছাড়া বিকল্প কোনও পথই তাদের সামনে খোলা নেই৷ এর পাশাপাশি গেরুয়া-অন্দরে পুরোদস্তুর বহাল আছে আদি-নব লড়াই৷ মুকুল রায় প্রথমদিকে সক্রিয় থাকলেও, মাসকয়েক যাবৎ তাঁকে যে গ্যারাজ করা হয়েছে, তা বাইরে থেকেও বোঝা যাচ্ছে৷ গোষ্ঠীকোন্দল চরমে উঠেছে এক নব্য বিজেপিকে উত্তর কলকাতার সভাপতি করার প্রস্তাব নিয়ে৷ এই জেলা কলকাতার ৬০টি ওয়ার্ডে পুরভোট নিয়ন্ত্রণ করে৷ এই মুহুর্তে যা অবস্থা এই ৬০ ওয়ার্ডে যতজন বিজেপি কর্মী দলীয় প্রার্থীকে জেতাতে নামবেন, ঠিক ততজনই নামবেন দলের প্রার্থীকে হারাতে৷ ২০১৯- এর লোকসভা ভোটের ফল বিশ্লেষনে ধরা পড়েছে কলকাতা পুরসভার ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৩টিতে এগিয়ে ছিল বিজেপি। লোকসভা ভোটের হিসেব অবশ্য পুরভোটে মেলে না। তার ওপর সদ্য দিল্লিতে গো-হারা হেরেছে বিজেপি৷ বঙ্গ-বিজেপির কেউই আশাবাদী নন যে এই ৫৩ ওয়ার্ডের সিংহভাগ বিজেপি পুরভোটে দখল করবে৷ এই মুহুর্তে রাজনৈতিক মহলের ধারনা, সব মিলিয়ে কলকাতার ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে বিজেপি যদি ২০-২৫টা দখল করতে পারে, তবে সেটাই হবে বিজেপির চরম সাফল্য ৷
সংগঠনহীন, কমিটিহীন বিজেপি স্রেফ মোদির ছবি দেখিয়ে এবং ‘জয় শ্রীরাম’ আর ‘হিন্দু-মুসলমান’ স্লোগান তুলে সাফল্য পেয়ে যাবে, এমন যারা ভাবছেন, তারা আর যাই হোক, বিজেপি’র শুভাকাঙ্খী যে নন, তা স্পষ্টই বলে দেওয়া যায়৷