Sunday, August 24, 2025

মুসলিম ভোটের চেনা সুর এবার প্রশ্নের মুখে: কণাদ দাশগুপ্তর কলম

Date:

Share post:

কণাদ দাশগুপ্ত

‘মুসলিমরা বিজেপিকে পছন্দ করেনা, ভোটও দেয়না৷’

বাংলা-সহ বহু রাজ্যে এই ধারনাই চালু আছে৷ বিজেপি মুসলিম ভোট পায়না, এই ভোট ভাগ হয় বিজেপি-বিরোধী শিবিরে৷ বাংলার বিজেপি-বিরোধী দলগুলিও এটাই ভাবে৷ কিন্তু ২০২১-এর ভোটে এই ধারনা কতখানি বাস্তবসম্মত? বিজেপি- বিরোধী দলগুলির এই ‘নিশ্চিত বিশ্বাস’ এবার অগ্নিপরীক্ষার সামনে৷

দীর্ঘদিন চালু থাকা এই ‘মিথ’ রাজ্যে ভেঙ্গেছে ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে৷ এ রাজ্যে মুসলিম ভোটার বেশি, এমন কেন্দ্রগুলিতে বিজেপি প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোটসংখ্যা অনেকটাই প্রমান করেছে, মুসলিমরাও বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন৷ আর দিনকয়েক আগে মুসলিম অধ্যুষিত নিজামের শহর হায়দরাবাদে যে ফল করেছে বিজেপি, তাতে বোধহয় আরও স্পষ্ট হয়েছে এই ‘মিথ’-এ ভরসা করা আত্মঘাতী হবেই৷

হায়দরাবাদ পুরসভায় বিজেপি
৪ আসন নিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন ৪৮ আসন৷ গ্রেটার হায়দরাবাদ মিউনিসিপাল কর্পোরেশন বা GHMC ভোটের ফল দেখার পর এবং একুশের ভোটে যাওয়ার আগে বাংলার বিজেপি-বিরোধী দলগুলির নতুন করে অঙ্ক কষতে বসা উচিত, অবশ্যই নিজেদের স্বার্থে৷ ওই পুরভোটের ফল বলছে, মুসলিম মন জয়ে অনেকটাই সাফল্য পাচ্ছে গেরুয়া শিবির৷ অনেক কিছু প্রমান করার তাগিদ নিয়েই এবার হায়দরাবাদে ভোট করতে নেমেছিলো বিজেপি। একটি পুরসভার ভোট হওয়া সত্ত্বেও রাজ্য নেতাদের উপর আদৌ ভরসা করেনি দিল্লির বিজেপি৷ ঠিক যেমন বঙ্গ- বিজেপির নেতাদের উপর এখনও পর্যন্ত ন্যূনতম ভরসাও করছেন না শাহ-নাড্ডা৷ উত্তরপ্রদেশ থেকে যোগী আদিত্যনাথ-সহ একাধিক ভিনরাজ্যের নেতাকে হায়দরাবাদে ভোট করতে, প্রচার করতে পাঠানো হয়েছিলো৷ বিস্ময়ের বিষয়, নিজামের শহরে প্রচারে গিয়েও নিজস্ব স্টাইলেই হিন্দুত্বের ধ্বজা তুলেছিলেন যোগী। তবুও ফলাফলে দেখা যাচ্ছে মুসলিম ভোট যথেষ্টভাবেই কুড়িয়েছে বিজেপি৷ যোগী দাপটের সঙ্গে ওখানে বলেছেন, এবার নিজামের শহর হায়দরাবাদের নাম বদল করে ‘ভাগ্যনগর’ করা হবে৷ তবুও ভোট পেয়েছে বিজেপি৷ প্রচারে গিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও সরাসরি হিন্দুত্বের বার্তা দিয়েছেন৷ দক্ষিণ বেঙ্গালুরুর বিজেপি সাংসদ তেজস্বী সূর্য প্রচারে গিয়ে বলেছিলেন, ‘‘KCR হায়দরাবাদকে ইস্তানবুল করতে চাইছেন। AIMIM ভারতের হায়দরাবাদকে পাকিস্তানের হায়দরাবাদ করতে চায়। আর আমরা হায়দরাবাদকে ভাগ্যনগর বানাবো, ইস্তানবুল নয়।’’ প্রচারে এ সব বলার পরেও বিজেপি ৪৮ আসন পেয়েছে৷ বিজেপির পাওয়া ওই ৪৮ আসনের পিছনে মুসলিম ভোটের অবদান নিশ্চিতভাবেই
রয়েছে৷ ফলপ্রকাশের পর দেশের রাজনৈতিক মহল ভাবতে বসেছে, এভাবে হিন্দুত্বের জিগির তুলেও হায়দরাবাদে বিজেপি বেনজির এই ফল করেছে কোন রহস্যে ? এই ফল জাতীয় রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে বললে ভুল বলা হবে না৷

আগামী একুশে দেশের যে চার রাজ্যে ভোট হতে চলেছে, তার অন্যতম পশ্চিমবঙ্গ৷ ভোটের ফল কী হবে, সময় তা বলবে৷ কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে রাজ্যের শাসক দলকে এখন থেকেই কিছুটা চাপে রেখেছে বিজেপি৷ বিজেপি যথারীতি বাংলার ভোটে হিন্দু-কার্ডই খেলবে৷ তার মোকাবিলায় তৃণমূল-সহ রাজ্যের বিজেপি-বিরোধী দলগুলির অনেকখানি ভরসা ওই মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক৷ কারন, এই দলগুলি যে কোনও কারনেই হোক, আজও ভাবে এবং ভুল করেই ভাবে, মুসলিমরা কখনই বিজেপিকে ভোট দেবে না৷ এ রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাদের প্রতিই ‘কমিটেড’, এমনই মনে করে তৃৃণমূল কংগ্রেস৷ গত লোকসভা ভোটের পরেও তৃণমূল কেন এই ধারনা পোষণ করে, তা রহস্যাবৃত৷ এ রাজ্য এই প্রথমবার কোনও রাজনৈতিক দল, অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেস ভোট-ময়দানে নেমেছে এক পেশাদার ইলেকশন- স্ট্র্যাটেজিস্ট-এর অধিনায়কত্বে৷ স্ট্র্যাটেজিস্ট যখন আছে, তখন ধরেই নেওয়া যায়, দলটির হোমওয়ার্ক দুর্দান্ত৷ তেমন যদি হয়ে থাকে, তাহলে কোন তথ্যের ভিত্তিতে স্ট্র্যাটেজিস্ট ধারনা করছেন, রাজ্যের মুসলিম ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাঁর ক্লায়েন্ট- দলের বাক্সেই আসবে, তা বোঝা মুশকিল৷
২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের দু-একটি কেন্দ্রের ফলাফলের দিকে একবার নজর দেওয়া যেতে পারে৷
◾দক্ষিণ মালদহ লোকসভা কেন্দ্র :-
এই কেন্দ্রে ৬৪ শতাংশ ভোটার মুসলিম। কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছেন ৪,৪৪,২৭০ ভোট, (৩৪.৭৩%)৷ বিজেপি পেয়েছে ৪,৩৬,০৪৮, (৩৪.০৯%) এবং তৃণমূলের মুসলিম প্রার্থীর প্রাপ্তি ৩,৫১,৩৫৩, (২৭.৪৭%)৷

◾উত্তর মালদহ লোকসভা কেন্দ্র:- বিজেপির হিন্দু প্রার্থী
পেয়েছেন ৫,০৯,৫২৪ ভোট,(৩৭. ৬১%)৷ তৃণমূলের মুসলিম প্রার্থী পেয়েছেন ৪,২৫,২৩৬ ভোট, (৩১.৩৯%) এবং কংগ্রেসের মুসলিম প্রার্থী পেয়েছেন ৩,০৫,২৭০ ভোট, (২২. ৫৩%)৷

◾জঙ্গিপুর লোকসভা কেন্দ্র:-
তৃণমূলের মুসলিম প্রার্থী পেয়েছেন ৫,৬২,৮৩৮ ভোট, (৪৩.১৫%)৷ এখানে মুসলিম ভোটার ৮২% এবং বিজেপির মুসলিম প্রার্থী পেয়েছেন ৩,১৭,০৫৬ ভোট (২৪.৩%) এবং কংগ্রেসের হিন্দু প্রার্থী পেয়েছেন ২,৫৫,৮৩৬ ভোট, (১৯.৬১%)৷
এই তিন কেন্দ্র, যেখানে মুসলিম ভোটারই সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেখানে বিজেপি প্রার্থীরা এত বিপুল ভোট কোথা থেকে পেলেন? কারা দিলেন ? কেন পেলেন ? এই তিন কেন্দ্রে শুধু হিন্দুরাই বিজেপিকে প্রায় সাড়ে ১২ লক্ষ ভোট এনে দিলেন ? এমন হতে পারে ? সুতরাং ধরে নেওয়াই যায়, মুসলিম ভোটাররা জেনে বুঝে, সজ্ঞানে বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন৷ ফলে,তৃণমূল সংখ্যালঘু ভোট পেয়ে থাকে, আর বিজেপি হিন্দু ভোট পায়, এই থিওরি ভুলে যাওয়ার সময় এসেছে৷ এবং একইসঙ্গে মাথায় রাখতে হবে হায়দরাবাদ পুরভোটের ফল৷ একুশের বঙ্গভোটে যদি মিম প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করে, তাহলেও বিজেপি ১০ থেকে ১৫ শতাংশ মুসলিম ভোট পাবে। তেমন হলে অনেক হিসাব গুলিয়ে যাবে৷

২০১১-এর আগে প্রতিটি ভোটে দেখা গিয়েছে, মুসলিমরা বামফ্রন্ট বা সিপিএমকে ভোট দিয়েছে। মুসলিম ভোটের কিছু অংশ অবশ্য কংগ্রেসও পেয়েছে। ২০১১-র পর থেকে তৃণমূল ধারাবাহিকভাবেই দাবি করে আসছে, রাজ্যের সংখ্যালঘু ভোটের সিংহভাগ তাদের ঝুলিতে৷ তাই যদি হয়, তাহলে মালদার দুই আসনে তৃণমূল হারলো কেন ? ২০১৯- এর লোকসভা ভোটের ফল বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে, উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, মুর্শিদাবাদের সংখ্যালঘুরা এখন বিজেপিকে পছন্দ করছেন।
২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের মুসলিম ভোট কোন দল পাবে, কেন পাবে এবং ২০১৯-এ কেন তৃণমূল পেলো না, তা নিয়ে পুরোদস্তুর সমীক্ষা নিশ্চয়ই করেছে তৃণমূল৷ প্রার্থীর তথাকথিত যোগ্যতা, কারা প্রার্থী হতে পারেন, কাদের টিকিট দেওয়া হবে না,শুধুই সে সব দেখে বেড়ালে, কাজ অসম্পূর্ণ থাকবেই৷ বিস্তর গবেষণা করে ‘যোগ্যতম’ প্রার্থী না হয় বাছাই হলো, কিন্তু মুসলিম-প্রধান এলাকায় সেই সব প্রার্থীকে জিতিয়ে দেবেন কারা, তার সমীক্ষাও তো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ৷

আরও পড়ুন:‘স্বাস্থ্যসাথী’তে আবেদনের ঢল, কার্ডের বদলে বিমাপত্র দেওয়ার ভাবনা নবান্নের!

তৃণমূলকে এবং তৃনমূলের ভোট- বিশেষজ্ঞদের মাথায় রাখতে হবে, এবারের ভোটে মুসলিম ভোট ভয়ঙ্করভাবে কাটাকাটি হবে৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ভোট নিজেদের পক্ষে আনতে তৃণমূলকে লড়তে হবে কংগ্রেস, বাম, বিজেপি, AIMIM, আব্বাস সিদ্দিকির দলের সঙ্গে৷ চোখ-কান খোলা থাকলে বোঝা যায়, মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আব্বাস সিদ্দিকির জনপ্রিয়তা হু হু করে বাড়ছে৷ ফুরফুরার অন্যান্য পীরজাদাদের একশো হাত পিছনে ফেলে দিয়েছেন এই আব্বাস সিদ্দিকি, এটাই বাস্তব৷ আবার এই পাঁচ শিবিরের কেউ, অন্য কারো সঙ্গে জোট বেঁধে ফেললে, লড়াই কঠিনতম হবে৷ এই লড়াইয়ে তৃণমূলের সাফল্য পাওয়া অসম্ভব না হলেও খুবই কঠিন৷ কারন একটাই, তৃণমূলে গ্রহণযোগ্য মুসলিম নেতার অভাব রয়েছে৷ যে এক-আধজন আছেন, তাদের গত পাঁচ বছর শো-কেস-এ ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে৷ ফলে তাঁদের অতীত ভাবমূর্তির কিছুই আর অবশিষ্ট নেই৷ শূন্য থেকে তাদের শুরু করতে হবে৷ যে সব পীরজাদার ভরসা তৃণমূল করছে, তারা নিজেদের ঘরেই চ্যালেঞ্জের মুখে৷ তাছাড়া, ‘মিম – মিম’ প্রচার চালিয়ে শাসক দলই বাংলায় ওই দলকে একটা আকার দিয়ে দিয়েছে৷ ওয়াইসি সম্পর্কে সাধারণ মুসলিমদের একটা কৌতূহলও তৈরি হয়েছে৷ ওদিকে পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে যথেষ্ট পরিমান মুসলিম ভোট পেয়েছে বিজেপি৷ এবং সবার উপরে তৃণমূলের সর্বস্তরে একটা আত্ম- সন্তুষ্টি কাজ করেই চলেছে যে, ‘মুসলিমরা বিজেপিকে ভোট দেয়না’৷

এই ‘আত্ম-সন্তুষ্টি’ দীর্ঘজীবী হলে ব্যুমেরাং হওয়ার আশঙ্কা শতকরা একশো ভাগ৷

spot_img

Related articles

উড়ালপুল–সেতুর নীচে বেআইনি দখলদারি সরাতে ‘উচ্ছেদ অভিযান’! উদ্যোগী কেএমডিএ 

কলকাতার উড়ালপুল ও সেতুর নীচ থেকে বেআইনি দখলদারি সরাতে উদ্যোগী হল কলকাতা মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (কেএমডিএ)। ইতিমধ্যেই চারটি...

ফের জেলা সফরে মুখ্যমন্ত্রী, ২৬ অগাস্টে বর্ধমানে প্রশাসনিক বৈঠক 

চলতি সপ্তাহ থেকেই ফের শুরু হচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জেলা সফর। আগামী মঙ্গলবার, ২৬ অগাস্ট তিনি পৌঁছাবেন বর্ধমান।...

ঠাকুরবাড়ির স্বার্থের রাজনীতি ফাঁস: শান্তনুকে কাঠগড়ায় তুললেন মা-দাদা

বিজেপির মধ্যে ঝগড়া ও স্বার্থের লড়াই শুরু হয়েছে বনগাঁর ঠাকুরনগরে। মতুয়া (Matua) সমাজের প্রভূত উন্নয়ন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা...

মতুয়াদের নাগরিকত্ব দেওয়ার অধিকার কার: চরম দ্বন্দ্ব শান্তনু-সুব্রতর

কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শান্তনু ঠাকুরের বিরুদ্ধে এবার গোটা ঠাকুর পরিবার। মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষদের ঘটা করে যে নাগরিকত্ব দেওয়ার খেলায়...