
বিজেপির(BJP) সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডার(JP Nadda) বিনা অনুমতিতে জন বার্লা আলাদা উত্তরবঙ্গ রাজ্যের দাবিতে প্রকাশ্যে সরব হয়েছেন!

আর যিনিই বিশ্বাস করুন, আমি করি না। জন্মসূত্রে উত্তরবঙ্গের ভূমিপুত্র হওয়ার সুবাদে জানি, কোথায়, কীভাবে উত্তরবঙ্গের বঞ্চনা, ক্ষোভ, আবেগের সেন্টিমেন্ট নিয়ে রাত-বিরেতে বৈঠক হয়। এটাও জানি সেই বৈঠকের আলোচ্য সূচি নিয়ে মত বিনিময় হয় প্রায় সব দলের কমবেশি ছোটবড় অনেক নেতার সঙ্গেই। চমৎকারি বিষয় হল, উত্তরবঙ্গের বঞ্চনা-ক্ষোভ-আবেগ নিয়ে খেলাধূলা করতে চান প্রায় সব দলের নেতাদের অনেকেই।
এই জায়গাটা ধরে ফেলেছেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। সদ্য সমাপ্ত পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ভোটে যিনি নিজেকে বাঙালির জামাই হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন। তাতে লাভের লাভ কিছু হয়নি। কিন্তু, জেপি নাড্ডাজি উত্তরবঙ্গকে হাতের তালুর মতো চিনে ফেলেছেন এটা জানেন নি! আমি জানি।

প্রায় দু-দশক ধরে উত্তরবঙ্গে সাংবাদিকতার সূত্রে জানি, বাম আমলে তো বটেই, তৃণমূল জমানায় প্রতি বছর নাড্ডাজি কতবার উত্তরবঙ্গে যাতায়াত করেছেন তার হিসেব দলের নেতারাও কর গুনে বলতে পারেন না। নাড্ডাজি কখনও বিমানে এসে হেলিকপ্টারে ঘুরেছেন। আবার কখনও ট্রেনেও যাতায়াত করেছেন। অবশ্য সে সময়ে নাড্ডাজি দলের সর্বভারতীয় সভাপতি ছিলেন না। ফলে, তাঁর সফর ঘিরে রাজ্যে গোয়েন্দাদের তেমন মাথাব্যাথা ছিল না।

সেই সফরগুলিতেই জন বার্লার সঙ্গে অনেক দিন ঘুরেছেন নাড্ডাজি। অনেক রাত গল্প করতে করতে প্রায় ভোর করে দিয়েছেন তিনি। জন বার্লা(John Barla) তাঁকে জানিয়েছেন, উত্তরবঙ্গের চা বলয়ের ক্ষোভ-দুঃখ-বঞ্চনা, আবেগের কথা। সেই সময়েই উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং জেলার তৎকালীন বিজেপি সভাপতি রথীন বসুর কাছ থেকে বোঝার চেষ্টা করেন পাহাড়-সমতলের কে বা কারা কতটা কাছাকাছি, কতটা দূরত্ব, কেন ইত্যাদি।

আরও পড়ুন:জুতো ভেজাতে নারাজ, মৎস্যজীবীর কোলে চড়ে ডাঙায় উঠলেন মৎস্যমন্ত্রী

বস্তুত, নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ উত্তরবঙ্গকে বোঝার নিরিখে জে পি নাড্ডার কাছে শিশুতুল্য বলে মনে করেন বিজেপির উত্তরবঙ্গের নেতাদের অনেকেই। ফলশ্রুতিতে, বাংলার মিডিয়ার কাছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে যাঁর নাম প্রায় ছিলই না, সেই জন বা্র্লা মন্ত্রী হয়েছেন। সৌজন্য, অবশ্যই জে পি নাড্ডা।
তা হলে! যিনি (জন বার্লা) জে পি নাড্ডার এত ঘনিষ্ঠ, তাঁর বিনা সম্মতিতে আলাদা উত্তরবঙ্গের দাবিতে জোরাল সওয়াল করেছেন বলে ভাবা যায়! এমন ভাবা বাতুলতা ছাড়া কিছু নয়।

ঘটনা হল, তৃণমূলের স্লোগান খেলা হবে- এর ধাঁচেই হাঁটছে বিজেপিও। বলা ভাল খেলছে। তাই আলাদা উত্তরবঙ্গ রাজ্য অথবা কেন্দ্রশাসিত উত্তরবঙ্গ রাজ্যের দাবিতে সরব হওয়ার পরে জন বার্লাকে পুরস্কৃত করা হল। এখানে দিলীপ ঘোষ, সায়ন্তন বসুরা যতই বাংলা ভাগ হতে দেব না বলে আওয়াজ তুলুন না কেন, আদতে সর্বভারতীয় কোনও তাবড় নেতার আশীর্বাদ না থাকলে জন বার্লার পক্ষে দিলীপবাবুর সঙ্গে টক্কর দেওয়া সম্ভব হতো না। তেমনই নিশীথ প্রামাণিককে পাশে নিয়ে জন বার্লার প্রেস কনফারেন্সেও কিন্তু বুঝিয়ে দিয়েছিল, দুজনেই কেন্দ্রীয় নেতাদের ছায়ায় চলছেন।

এখন তা হলে কী হতে পারে!
জন বার্লা আগামীতে খোলাখুলি আর আলাদা উত্তরবঙ্গের দাবিতে সওয়াল করবেন না। কিন্তু, যা শোনা যাচ্ছে, তিনি উত্তরবঙ্গের ফেরার পরে জন বার্লার কাছে আলাদা উত্তরবঙ্গ বা উত্তরবঙ্গকে কেন্দ্রশাসিত করার দাবিতে বহু সাক্ষর সম্বলিত স্মারকলিপি জমা পড়বে। সেই স্মারকলিপি জন বার্লার মাধ্যমে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে পৌঁছবে। চা বলয় তো বটেই, উত্তরবঙ্গের নানা এলাকার কোটিখানেক সাক্ষর সম্বলিত স্মারকলিপি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে গেলে সেখানকার ডেপুটি নিশীথ প্রামানিক তা নিয়ে অমিত শাহের কাছে দরবার কররার সুযোগ পাবেন।

এটাই হল গেম প্ল্যান। মামলা করে, আন্দোলন করে আলাদা উত্তরবঙ্গের দাবিদারদের দাবিয়ে রাখা যাবে না। বরং, তাঁরা আরও জোটবদ্ধ হবে। অন্তত, এই সোশাল মিডিয়ার যুগে। বরং, রাজ্য সরকারকে ভাবতে হবে, কেন উত্তরবঙ্গের ওপিনিয়ন মেকার হিসেবে পরিচিত যাঁরা, তাঁরা কেন আলাদা করে উত্তরবঙ্গ সাহিত্য অ্যাকাডেমি গড়েছেন, তেমনই বা আলাদা করে নর্থ বেঙ্গল টেবল টেনিস অ্যাকাডেমি হয়েছে! কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় দায়িত্বপ্রাপ্ত উত্তরবঙ্গের দুই প্রতিমন্ত্রী আরও নতুন কিছু তো করবেন তা বলাই যায়। কারণ, উত্তরবঙ্গকে আলাদা করে দিলে পশ্চিমবঙ্গের মোট সাংসদের ৮ জন কমে যাবে। সংসদে বাংলার জোর আরও কমবে।

এটা বিজেপির সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বলেই মত উত্তরের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের। যাঁরা কিনা আবার কলকাতা মানেই পশ্চিমবঙ্গ এ কথা মনেপ্রাণে মানতে চান না। ফলে, বিজেপি উত্তরের জনপদের কোনও দুর্বল অনুভূতিতে সামনে রেখে দীর্ঘমেয়াদি ফায়দা তুলতে আসরে নেমেছে সেটা তৃণমূল নেত্রীকে বুঝতে হবে। তাঁকে এটাও মাথায় রাখতে হবে, তাঁর দল তো বটেই, তাঁর উত্তরবঙ্গের শুভাকাঙ্খীদের একাংশও কলকাতার কিছু নেতার ফাইফরমাস খাটতে খাটতে হতাশ ও বিরক্ত।
