Friday, November 7, 2025

প্রখর তপন তাপে, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

গ্রীষ্মঋতু বর্ষার ভূমিকা। আর, কে না জানে ভূমিকা খুব বড়ো না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। তাই বোধহয় রবি ঠাকুরের গ্রীষ্মের গান সংখ্যায় যথেষ্ট কম। আর বর্ষার গান প্রচুর। আসলে গ্রীষ্মের কামনা বর্ষার বৃষ্টি হয়ে আসে। তবে ওই কয়েকটি গ্রীষ্মের গানেই কবি দহনকালের যে অসাধারণ ছবি এঁকে গেছেন তা রসিকজনের কাছে আজও বিস্ময়। গীতাঞ্ছলির ইংরেজি অনুবাদ ক’রে কবি নোবেল পেয়েছিলেন। অর্থাৎ, গানের বাণী লিখে তিনি সাহিত্যের সর্বোচ্চ সম্মান লাভ করেন। কিন্তু, সুরকার রবীন্দ্রনাথ? স্বয়ং বাবা আলাউদ্দিন খান বলে গেছেন, ‘ রবি ঠাকুর গানের রাজা ‘। অতো বিশাল মাপের বিশ্ববন্দিত সঙ্গীতাচার্য যাঁকে গানের রাজা বলেছেন তিনি কি শুধুমাত্র গীতিকার রবীন্দ্রনাথে মুগ্ধ হয়ে এতবড়ো প্রশংসাবাণী উচ্চারণ করে গেছেন? সম্ভবত না। সুর ও বাণীর অসামান্য মেলবন্ধন তো আছেই, তবে বাবা আলাউদ্দিনের মতো সুরের পূজারীকে নিশ্চয়ই মুগ্ধ করেছিল রবীন্দ্রনাথের অবিস্মরণীয় সব সুর এবং বিপুল বৈচিত্র্যময় সেইসব সুরগুলির জীবন-মরণের সীমানা ছাড়িয়ে ব্রক্ষ্মান্ডব‍্যাপী অনন্ত বিচরণ। কত বড়ো সুরকার ছিলেন রবীন্দ্রনাথ তার মূল‍্যায়ণ করবে ভাবীকাল। কিন্তু, আমরা তাঁর সুরে আবিষ্ট হয়ে থাকি কেন সেই বিশ্লেষণে যদি যাই, তাঁর গানের সুর কোথায় আর পাঁচরকম গানের চেয়ে স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট তার অন্বেষণে যদি আমরা নিবিষ্ট হই, কোন্ বিরল বৈশিষ্ট্যের জন‍্য সুরকার রবি ঠাকুর অনন‍্য তার হদিশ যদি আমরা করতে চাই, তাহলে তাঁর অজস্র গানের যে কোনো একটি বেছে নিয়ে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।

প্রতিটি শব্দের এক ও একাধিক অর্থ থাকে। কন্ঠ ও যথাযথ উচ্চারণের দ্বারা প্রতিটি শব্দের ছবি আঁকা যায়। প্রত‍্যেকটি শব্দের অভিঘাত আলাদা। অন্ধকার, অসীম, পারাবার, দারুণ, এমনকি কাছে অথবা দূরে ঠিকঠাক উচ্চারণে মূর্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু, সুরের ওঠাপড়া দিয়ে বিভিন্ন সপ্তকের অসামান্য ব‍্যবহারে শব্দের ও বাক্যবন্ধের যে একেবারে ছবির মতো দৃশ্যায়ণ করা যায় তা সম্ভবত গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে গেছেন আমাদের রবি ঠাকুর।
এবার সরাসরি একটি রবীন্দ্রগানের দ্বারস্থ হওয়া যাক।
প্রখর তপন তাপে
আকাশ তৃষায় কাঁপে,
বায়ু করে হাহাকার।
দীর্ঘ পথের শেষে
ডাকি মন্দিরে এসে,
‘ খোলো খোলো খোলো দ্বার।। ‘

এই গানের রচনাকাল ১৯২২-এর গ্রীষ্মকাল। গানটি প্রকৃতি পর্যায়ের এবং গ্রীষ্মের অন্তর্গত। রাগ ভীমপলশ্রী ও মূলতানের যুগ্ম প্রয়োগে নির্মিত এই গানের সঞ্চারীতে রাগ ভৈরবীর ব‍্যবহারও অপূর্ব। রাগ ‘ মূলতান যেন রৌদ্রতপ্ত দিনান্তের ক্লান্তিনিঃশ্বাস ‘, একথা কবি স্বয়ং লিখে গেছেন। ভীমপলশ্রীও অপরাহ্নের রাগ।
তবে গ্রীষ্মই গানটির উদ্দেশ্য নয়। ঋতুর পরিবেশ এখানে উদ্দীপন বিভাবের কাজ করেছে। অর্থাৎ, প্রখর গ্রীষ্মতাপে ক্লান্ত পথিকের যাত্রা — কোনো লক্ষ্যের দিকে, কোনো উদ্দিষ্টের দিকে। গ্রীষ্মদহনে ক্লান্ত পথযাত্রী উদ্দিষ্টের দ্বারে এসে বলছে — ‘ খোলো খোলো খোলো দ্বার ‘।

আরও পড়ুন- Andrew Symonds:  ক্রিকেট জীবনে জড়িয়েছেন একাধিকবার বিতর্কে, একনজরে সাইমন্ডসের নানা বিতর্ক

সুরের মাধ‍্যমে শব্দের ও বাক্যবন্ধের দৃশ্যায়ণ দিয়ে এ গানের দ্বার খোলার প্রয়াস হোক এবার।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর অজস্র গানে মন্দ্র, মধ‍্য ও তার,এই তিনটি সপ্তককে এতটাই দক্ষতার সঙ্গে ব‍্যবহার করে গেছেন যা সঙ্গীত শিক্ষার্থীদের কাছে তো বটেই, যাঁরা গান বাঁধেন তাঁদের কাছেও অবশ্যই শিক্ষণীয়। তাঁর সৃজনশীলতা বিস্ময়কর। তাঁর গানকে নির্দ্বিধায় উত্তর আধুনিক বলা যেতে পারে। প্রেম, পূজা, প্রকৃতি, দেশাত্মবোধ, জীবন সংগ্রাম, বিশ্ববীক্ষা, ঈশ্বর এবং মানবজীবনের প্রতিটি অনুভব ও উপলব্ধি যেভাবে তাঁর গানে মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে তার তুলনা খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

প্রখর তপন তাপে… গানটি শুরু হচ্ছে মধ‍্যম ও কোমল গান্ধার স্পর্শ ক’রে।
‘ তপনতাপে ‘ শব্দটি যে স্বরসমূহ দিয়ে তিনি বেঁধেছেন তাতে মধ‍্যগগনের সূর্যতাপ স্পষ্ট এবং ‘ আকাশ তৃষায় কাঁপে ‘ অংশে কড়ি ও কোমলের এমন সুনিপুন ব‍্যবহার উনি মধ‍্যসপ্তকে করে গেছেন যে গায়ক-গায়ীকারা শুধুমাত্র স্পষ্ট উচ্চারণ ও সুরে গাইলেই যথেষ্ট, শব্দ ও বাক্যবন্ধের ছবির মতো দৃশ্যায়ণ সুরকার স্বয়ং করে রেখেছেন গানগুলিতে।

এরপরে, ‘ বায়ু করে হাহাকার ‘ অংশের স্বরসমূহ গাইলেই একেবারে স্পষ্টরূপে প্রতীয়মান হয় বাতাসের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে হাহাকারের উথালপাতাল এবং’ দীর্ঘ পথের শেষে ডাকি মন্দিরে এসে খোলো খোলো খোলো দ্বার ‘ গাইতে গিয়ে আমাদের যুগপৎ বিস্মিত ও মুগ্ধ হতে হয় এই ভেবে যে কী অসাধারণ সৃজনশীলতার রূপায়ণে তিনি তাঁর গানের প্রতিটি শব্দের যথাযথ ছবি এঁকে গেছেন স্বর ও সুরের সমন্বয়ে। শুদ্ধ, কড়ি ও কোমল সুরগুলিকে কখনো পাশাপাশি, কখনও বা কিছুটা দূরত্বে রেখে, কখনও বা তাদের মিলিয়ে মিশিয়ে প্রতিটি চরণকে অর্থবহ ও সার্থক ক’রে গেছেন কী অসামান্য দক্ষতায় ভাবলে শিহরিত হতে হয়।

‘ দীর্ঘপথের ‘ শেষে মন্দিরে এসে দাঁড়ানোর ছবিটি স্পষ্ট দেখা যায় এবং মন্দিরের দ্বার খোলানোর আকুল মিনতি যেন আর্তজনের হাহাকারের মতো ধ্বনিত হতে থাকে।
এরপরে দেখা যায় প্রথম অন্তরায় ‘ মলিন ‘ শব্দটি ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে একরাশ বিমর্ষতা নিয়ে। ভাবা যায়? এমনি সুরের ইন্দ্রজাল!
এবার একটু গাওয়া যাক এই গানের সঞ্চারীটি।
বুকে বাজে আশাহীনা
ক্ষীণমর্মর বীণা,
জানি না কে আছে কিনা,
সাড়া তো না পাই তার…
‘ আশাহীনা ক্ষীণমর্মর বীণা ‘ রবি ঠাকুরের শিল্পীত ও অনবদ্য স্বরপ্রয়োগে আর বিমূর্ত থাকে না, নিরাকার থাকে না, স্বরসমষ্টি ক্রমেই নিম্নগামী হ’তে হ’তে যেন নৈরাশ‍্যের অতল আঁধারে বিলীন হয়ে যায়, সংখ্যাগরিষ্ঠ
মানুষের দৈনন্দিন অভিষ্ট লক্ষ্যে না পৌঁছতে পারার বেদনাজাত হতাশার ক্ষীণ সুর যেন সকলের বুকেই বেজে ওঠে। কোনো অচেনা সাহায্যকারীর সাড়াও পাওয়া যায় না যে এই নিরাশার অন্ধকারে একটুখানি আলোর জোগান দেবে।

কিন্তু তারপরেই যেন হঠাৎই আশার আলো জ্বলে ওঠে আভোগ তথা দ্বিতীয় অন্তরায় এসে। সেখানে কবি বলছেন :
আজি সারাদিন ধ’রে
প্রাণে সুর ওঠে ভরে,
একেলা কেমন ক’রে
বহিব গানের ভার।।

দুর্মর আশায় প্লাবিত প্রাণে সহসা সুরের ভান্ডার যেন উপচে পড়ে। গানের এই ভার তখন পথিকের দুর্বহ মনে হতে থাকে। সে সকলের সঙ্গে তা ভাগ করে নিতে চায়।
‘ একেলা কেমন ক’রে বহিব গানের ভার ‘ গাইতে গিয়ে আমাদের প্রথমে কিছুটা নিচে নেমে এসে পরক্ষণেই আবার স্বরের সিঁড়ি বেয়ে উঠে দ্বার খোলার আর্তি জানাতে হয়।

এই যে দোলাচল, এই যে আলো ছায়ার আশ্চর্য খেলা,
এই যে স্বর ও সুরের হাত ধ’রে নাগরদোলার মতো শব্দগুচ্ছের ওঠানামা, একটা স্পষ্ট ও সুচারু দৃশ্যমানতার অপূর্ব আয়োজন সুরকার রবি ঠাকুর তাঁর গানের শ্রোতা ও শিল্পীদের জন‍্য ক’রে গেছেন এর তুলনা সঙ্গীতভুবনে আর কোথায়?

 

 

 

spot_img

Related articles

একটি কঙ্কালের অসম্পূর্ণ প্রেমকাহিনি

জয়িতা মৌলিক ১২৯৮ বঙ্গাব্দের ফাল্গুন মাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (Rabindranath Tagore) লেখা 'কঙ্কাল' ছোটগল্পটির মঞ্চনাট্যরূপ দেখলাম ১৪৩২ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে,...

KIFF: চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম দিনেই সত্যজিৎ স্মরণ, নন্দনে শ্রদ্ধার্ঘ্য ঋত্বিক ঘটককে

মহানগরীতে সিনে উৎসবের মেজাজ, শুরু হয়ে গেল ৩১-তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (31st Kolkata International Film Festival)। বৃহস্পতিবার...

রাজারহাটে যাত্রীবোঝাই বাস উল্টে দুর্ঘটনা, আহত বহু

শুক্রবার সাত সকালে রাজারহাটের হাড়োয়া খালি উল্টে গেল যাত্রীবোঝাই বাস (Bus Accident in Rajarhat)। বেড়াচাঁপার দিক থেকে করুণাময়ীর...

আজ স্কুল সার্ভিস কমিশনের একাদশ-দ্বাদশের শিক্ষক নিয়োগের ফলপ্রকাশ

সুপ্রিম রায়ে চাকরি হারানো থেকে এসএসসির (School Service Commission) নতুন করে পরীক্ষার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এবার রেজাল্টের...