Monday, August 25, 2025

‘তোমার মতো গভীর’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

‘ন্যাংটো ছেলে আকাশে
হাত বাড়ায়
যদিও তার খিদেয় পুড়ছে গা
ফুটপাতে আজ লেগেছে জোছনা ;
চাঁদ হেসে তার কপালে
চুমু খায় ।
লুকিয়ে মোছেন চোখের জল
মা । ‘
লেখাটি আদৌ কবিতা হয়ে উঠলো কিনা অথবা কবিতাটি আদৌ শিল্প হয়ে উঠলো কিনা তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা কোনোদিনই ছিল না কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের । কবিতার ছলে তিনি দিতেন বার্তা । সময়ের বার্তা । দেশ-কাল-সমাজের বার্তা । আসলে তো সবই রাজনৈতিক বার্তা । ছদ্মবেশ কিংবা নিরপেক্ষতার ভান বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় পাওয়া যাবে না । তিনি অকপট , তিনি অকৃত্রিম ।
একটা ছবির কথা বলা যাক ।

প্রবাসে নিঃসঙ্গ অবস্থায় পথে প’ড়ে থাকা এক চরম দরিদ্র মজুরের ছবি, যার পায়ের গোড়ালি একেবারে ফুটিফাটা । সেই দগদগে ক্ষতগুলোর ওপরে পড়েছে চাঁদের আলো । সোনালী আলোয় দেখে মনে হয় সোনায় মোড়ানো মজুরের পা ! দারিদ্র ও বিপন্নতা এখানে শিল্প হয়ে উঠলো অবশ্যই । তবে তার চেয়েও বড়ো হয়ে জেগে রইলো একটা বার্তা । একটা সময় ।

সেই অন্ধকার সময়ের গায়ে লেখা রইলো ঘরছাড়া মজুরদের ভয়াবহ অসহায়তা । বিনা চিকিৎসায় ধুঁকতে থাকা অবস্থা । এও তো একরকম ‘প্রবাসে, দৈবের বশে ‘ প্রাণ নিয়ে টানাটানি ।

বাংলাদেশের প্রখ্যাত আলোকচিত্রী শাহিদুল আলম তুলেছিলেন ছবিটি । ফাটা পায়ে আলো প’ড়ে অদ্ভুত এক মেজাজ সৃষ্টি করে । মনে হয় খুব সাধারণ জিনিসের মধ্যে সৌন্দর্য দেখাই তো শিল্পীর কাজ । আর চূড়ান্ত শিল্পবোধে জারিত বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা প’ড়ে দীক্ষিত পাঠকের মনে হয় শিল্পী হওয়ার চেয়েও কবির অনেক বেশি মনোনিবেশ ছিল মানুষ হয়ে ওঠার প্রতি । মানুষের জন্য লেখা কবিতায় যদি মনুষ্যত্বে উত্তোরণ ও মানবিক আলোর দেখাই না পাওয়া যায় তবে কবিতা লিখে কী লাভ ?
‘ যারা কথা বলছে তারা বোবা
যারা শুনছে সকলেই
জন্ম থেকে বধির । অথচ সভায় মিছিলে তিলধারণের ঠাঁই নেই ।

যারা উপস্থিত তারা
বহুদিন মৃত
কিন্তু সকলেই হাততালি দিচ্ছে
কী জন্য এবং কাকে
একজনও জানে না । ‘
এই কবিতায় রাজনৈতিক
হিমযুগের ছবি পাওয়া যায় ।
যখন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠ
জনগণ স্বার্থসর্বস্ব ও চরম সুবিধাবাদী হয়ে ওঠে তখন এই ছবি ছাড়া অন্য কী-ই বা আঁকবেন কবি ? কেবল চাঁদ , ফুল আর জোছনার গান গেয়ে কীভাবে কাটতে পারে একটা দীর্ঘ কবিজীবন ? অবশ্যই এর উত্তর জানেন নিরপেক্ষ কবিগণ । কিন্তু , বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় , যিনি লিখে গেছেন , ‘ আশ্চর্য ভাতের গন্ধ রাত্রির আকাশে ‘, যিনি লেখেন , ‘ কারা যেন আজও ভাত রাঁধে , ভাত খায় ‘, তিনি তথাকথিত ‘ অরাজনৈতিক ‘ থাকার ভণ্ডামি কখনোই করবেন না এতো জানা কথা । তিনিই তো অবধারিত লিখবেন :
‘ রূপসী তুই রাজনীতি , দিস
ছেলে-ছোকরার মাথা ঘুরিয়ে ;
কিন্তু বুড়ো-শয়তানদের সঙ্গে
থাকিস রাত্রে শুয়ে । ‘

‘ কলম কখন চাবুক হয়ে উঠবে কখন হবে তুলি , আর কখন হবে স্টেনগান সেটা ভালোভাবে জানতে হলে আপনারা বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছে যান । ‘

কবির সমসাময়িক আরেক কবির ভাষ্য এটি । অসামান্য মূল্যায়ণ । ‘ তিন পাহাড়ের স্বপ্ন ‘ দেখা এই মরমী কবি লেখেন , ‘ রুটি পেলে দিই প্রিয়ার চোখের মণি ‘ । লেখেন , ‘ এ এক মন্ত্র ! রুটি দাও , রুটি দাও ; বদলে বন্ধু যা ইচ্ছে নিয়ে যাও । ‘

সারা পৃথিবীর ক্ষুধাতুর জনতার জন্য নিজের কলমটি উৎসর্গ করেছিলেন বীরেন্দ্র কবি । তা ব’লে হৃদয়ের কথা কিন্তু ভুলে যান নি । লিখেছেন :
আমি অনেক হৃদয় দেখলাম
তোমার মতো গভীর কেউ না
আমি অনেক কবিতা জানলাম
তোমার পলিমাটির মতো না ।

কবি লিখে গেছেন :
মানুষের আশা অবিনাশী ।
চারদিকের নরকের মধ্যেও মানুষ তাই স্বপ্ন দেখে । তখন ,
স্বয়ং মৃত্যু এসেও যদি তার সামনে দাঁড়ায় — সে তাকে সহজে পথ ছেড়ে দেয় না —
প্রশ্ন করে । প্রশ্নের উত্তর দেওয়া নয় , প্রশ্ন করাটাই হয়তো কবির ধর্ম ।

এই যুগন্ধর কবির কবিতা পরিক্রমার আর একটি গূঢ় অন্বেষণও এখানে উল্লেখ্য , আর , তা হলো , শেষ পর্যন্ত পায়ের নিচের মাটি কি খুঁজে পায় মানুষ ? না পেলে তো সভ্যতার সুদীর্ঘ পথযাত্রার পরিশ্রম একেবারেই বৃথা ।
‘ একটা পৃথিবী চাই
মায়ের আঁচলের মতো
আর যেন ঐ আঁচল জুড়ে
গান থাকে
যখন শিশুদের ঘুম পায় । ‘
মায়ের আঁচলঘেরা এই আলো – পৃথিবীর সন্ধানেই বোধহয় প্রতিটি মানুষের অবশ্যপাঠ্য হওয়া উচিত
‘ জন্মভূমির বর্ণপরিচয় ‘ :
মানুষ রে তুই সমস্ত
রাত জেগে
নতুন ক’রে পড় ,
জন্মভূমির বর্ণপরিচয় ।
আর হ্যাঁ , কেউ মানুক না মানুক সত্য অবিনশ্বর :
‘ চোখ রাঙালে
না হয় গ্যালিলিও
লিখে দিতেন ,
‘ পৃথিবী ঘুরছে না। ‘
পৃথিবী তবুও ঘুরছে ,
ঘুরবেও ;
যতই তাকে চোখ
রাঙাও না । ‘
অবিস্মরণীয় এই কবির পার্থিব প্রস্থানের পরে জনৈক অনুজ কবির শ্রদ্ধাজ্ঞাপন :
এতদিন যাঁর বুকে
ছিল আগুন
আজ তিনি আগুনের বুকে
এতদিন যাঁর বুকে
ছিল মানুষ
আজ তিনি মানুষের বুকে ।

আরও পড়ুন- উদ্দীপনার ঢেউয়ে সাগরসঙ্গমে শুরু হল মকরস্নান

 

spot_img

Related articles

আদিবাসী উন্নয়ন আরও সুদূর প্রসারি করার বার্তা মুখ্যমন্ত্রীর, সৌজন্য উড়িয়ে বৈঠকে অনুপস্থিত বিজেপি

আদিবাসী উন্নয়ন নয়, রাজনীতিই যে তাদের লক্ষ্য তা আরও একবার প্রমাণ করল বিজেপি (BJP)। আমন্ত্রণ পেয়েও সৌজন্যের জবাব...

DHFC-র হারের পরই ক্লাব থেকে কর্তাদের ছোট করার চেষ্টা, জবাব দিলেন মানস

ডুরান্ড কাপের(Durand Cup) ফাইনালে পৌঁছে সকলকে চমকে দিয়েছিল ডায়মন্ডহারবার এফসি(DHFC)। বাংলার ফুটবলকে যে দল নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছে, তাদের...

আধারের অভাবে রেশন বঞ্চনা নয়, কড়া নির্দেশ খাদ্য দফতরের 

আধার কার্ড না–থাকা বা বায়োমেট্রিক যাচাই না–হওয়ার কারণে আর কোনও বৈধ রেশন গ্রাহককে খাদ্যসাথী প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত...

হাওড়ায় বৃদ্ধ খুনের নেপথ্যে সমকামী সম্পর্ক-ব্ল্যাকমেইল! তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য

হাওড়ায় বৃদ্ধ খুনের নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর তথ্য। হাওড়ার গোলাবাড়ি থানার সালকিয়ার অরবিন্দ রোডের বাসিন্দা অসীম দে (Asim de) খুন...