
কী ব্যাপার স্যার ? আপনার মতো ধনী ব্যক্তির হাতে ভাঙা ফোন ?

সাংবাদিকদের বিস্মিত প্রশ্নের উত্তরে ধনী মানুষটি বলছেন ,
‘ ফোনটা সারিয়ে নেবো । এমন হাজারটা মোবাইল আমি কিনতে পারি । কিন্তু আমার ১০ টি ফেরারি , ২ টি জেট প্লেন এবং এবং ২০ টি হীরের ঘড়ির কী প্রয়োজন ? আমি দারিদ্র দেখেছি । এই কারণে আমি স্কুলে যেতে পারি নি । তাই আমি আমার দেশে স্কুল তৈরি করেছি যাতে বাচ্চারা পড়াশোনা করতে পারে , হাসপাতাল তৈরি করেছি যাতে গরীব মানুষ চিকিৎসা পায় , স্টেডিয়াম তৈরি করেছি যাতে ছোটবড় সকলেই খেলাধুলার সুযোগ পায় । আমার খেলার জুতো ছিল না , ভালো কাপড় ছিল না , খাওয়ার মতো খাবার ছিল না । আজ আমার সব আছে বলেই কি সেসব দেখাতে হবে ? প্রাচুর্যের প্রদর্শনী করতে হবে ? আমি আমার দেশের মানুষের সঙ্গে আমার উপার্জন ভাগ করে নিতে চাই । আমি আমার শিকড় ভুলি নি । কখনও ভুলবো না । ‘

খেলোয়াড় অনেক । মানুষ কম । কোটি কোটি টাকা রোজগার করা ক্রীড়াবিদের অভাব নেই পৃথিবীতে । কিন্তু সেই বিপুল রোজগারের কিছু অংশ মানবকল্যাণে ব্যয় করার মতো মন ক’জনের আছে ? তার জন্য যে মহৎ হৃদয় আর সীমাহীন ঔদার্য লাগে তা কি সবার থাকে ?

কে এই খেলোয়াড় যিনি তাঁর সারা বছরের উপার্জনের বিশাল একটা অংশ দান করেন মানবকল্যাণে ? তাঁর নাম সাদিও মানে । তিনি একজন বিখ্যাত ফুটবলার । তাঁর দেশ সেনেগাল । তাঁর জন্ম ১৯৯২ সালের ১০ এপ্রিল । তিনি পেশাদার খেলোয়াড় । বর্তমানে বায়ার্ন মিউনিখের হয়ে খেলছেন । সেনেগালের জাতীয় দলের এই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আফ্রিকার সর্বকালের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হিসেবে ইতিমধ্যেই স্বীকৃতি লাভ করেছেন । ড্রিবলিং , নিখুঁত পাসিং , হেডিং এবং বিদ্যুতগতির ফিনিশিং-এর জন্য এই ফরোয়ার্ড সারা বিশ্বের ডিফেন্ডারদের কাছে ত্রাসের অপর নাম । সাদিও মানে প্রকৃতই এক গোলমেশিন । মেস , রেড বুল জালৎসবুর্গ , সাউদাম্পটন , লিভারপুল ইত্যাদি দলের এক সময়ের জনপ্রিয় ফুটবলার এখন বুন্দেসলিগা খেলছেন জার্মানির বায়ার্ন মিউনিখ ক্লাবে । সেনেগালের ফুটবল ক্লাব জেনারেশন ফুটের যুব পর্যায়ের হয়ে খেলা দিয়ে তাঁর ফুটবল জীবন শুরু । ফ্রান্স , অস্ট্রিয়া ও ইংল্যান্ড হয়ে এখন তিনি জার্মানির ক্লাবে । সেনেগালের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে সাদিও এপর্যন্ত ৭০ টি ম্যাচে ২০ টি গোল করেছেন । খেলেছেন দেশের হয়ে ফিফা বিশ্বকাপ ।সাফল্যের সঙ্গে খেলেছেন ৩ টি আফ্রিকা ক্লাব অফ নেশন্স । পেয়েছেন ২০১৮-১৯ প্রিমিয়ার লিগের গোল্ডেন বুট । পেয়েছেন ২০১৯ সালে বর্ষসেরা আফ্রিকান ফুটবলারের শিরোপা ।
মানের বাবা তাঁকে তাঁর ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে নিষেধ করা সত্ত্বেও তিনি শেষ পর্যন্ত ফুটবলকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন । ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি উচ্চতার এই অসামান্য খেলোয়াড়টির হৃদয় আকাশের মতো প্রশস্ত ।সাদিও মানের জীবনী এখন মানবতার মূর্ত দৃষ্টান্ত । বছরে তাঁর রোজগার ১৭৬ কোটি টাকা । তাঁর সারা বছরের উপার্জন এবং সঞ্চিত অর্থের একটা বিরাট অংশ তিনি তাঁর দেশের দরিদ্র মানুষজনের কল্যাণে ব্যয় করেন । স্কুল , হাসপাতাল , পেট্রোল পাম্প , স্টেডিয়াম , এমনকি পোস্ট অফিস পর্যন্ত তিনি স্থাপন করেছেন তিনি তাঁর নিজের উপার্জিত অর্থে । কোভিডের সেই দুঃসময়ে অসুস্থ , দুর্গত ও চরম বিপদাপন্ন দেশবাসীর কল্যাণে দেশের জাতীয় কমিটিকে অকাতরে দান করেছেন অর্থ । তাঁর নিজের গ্রামের ২০০০ পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি । দুর্বল শিশুদের কল্যাণে তিনি নিয়মিত ব্যয় করেন প্রচুর অর্থ । অল্পবয়সী মেয়েদের তথা মহিলাদের শিক্ষা , চিকিৎসার খাতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য । মহিলাদের সমতা ও ক্ষমতায়নে তাঁর নিরলস প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে । সাদিওর নিজের গ্রাম পিছিয়ে পড়া । সেই গ্রামটিকে শহরের রূপ দেওয়া তাঁর স্বপ্ন । একগুচ্ছ পরিকল্পনার সঙ্গে সেখানে শুরু হয়েছে উন্নয়নের কাজ ।

শুধু নিজের জন্মভূমি গ্রামটিই নয় , আশেপাশের আরও ৩০ টি গ্রাম ইতিমধ্যেই সাদিওর করা উন্নয়নের সুবিধা পাচ্ছে । সাদিওর গ্রাম বাম্বালি । যে সমস্ত শিশু দু’বেলা খাবার পায় না , তাদের জন্য তিনি করেছেন অন্নের ব্যবস্থা । ব্যক্তিগত বিলাসবহুল জীবনযাপন নয় , অনেক মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নই সাদিও মানের জীবনের মূলমন্ত্র । নিজের দেশ সেনেগালকে আফ্রিকান নেশনস কাপ জিতিয়ে দেশের মহানায়কে পরিণত হয়েছেন সাদিও মানে । এখন তাঁর নামে দেশের একটি স্টেডিয়ামের নামকরণ করতে চলেছে সেনেগাল সরকার । সকলেই মানছেন এই বিরল সম্মান তাঁর প্রাপ্য । চ্যাম্পিয়ন লিগ ছাড়াও আরও অনেক ট্রফি জিতেছেন সাদিও । জীবনে অজস্র পুরস্কার পেয়েছেন । অর্থ ও খ্যাতির চূড়ায় তাঁর অবস্থান । তবুও তাঁর পা মাটিতেই । এই মহৎপ্রাণ মাটির মানুষটি শুধু ফুটবলার হিসেবেই নয় , সারা বিশ্বের ক্রীড়াজগতের কাছে মহৎপ্রাণ মানুষ হিসেবে এক বিশেষ আসন লাভ করেছেন । বিপুল সম্পদের মালিক হয়েও মানবতার এমন জয়গান গাইতে পারেন ক’জন ?

আরও পড়ুন- অক্ষমের অ.স্ত্র ‘লাথি’! নির্বাচনে ভরাডুবির বুঝে কমিশনের গেটে তালা শুভেন্দুর
