Monday, August 25, 2025

‘হাইপেশিয়া’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

হাইপেশিয়া খুন হয়েছিলেন । ভয়ঙ্করভাবে হত্যা করা হয় তাঁকে।

তাঁর অপরাধ ?

তিনি নারী , তিনি বিদুষী , তিনি গণিতবিদ । খুব সম্ভবত বিশ্বের প্রথম নারী গণিতবিদ । তার ওপর তিনি জ্যোতির্বিদ্যা ও দর্শন নিয়ে গবেষণা করেন। সমাজ ও পরিপার্শ্বকে নতুন করে গড়তে চান । প্রচলিত ব্যবস্থায় আস্থা নেই তাঁর ।

এগুলো অপরাধ নয় ? তিনি প্রশ্ন করেন পুরুষতন্ত্রকে। তিনি প্রশ্ন তোলেন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে । অপরাধের আর কিছু বাকি রইল ? এমন আলোকিত নারীকে কি বাঁচিয়ে রাখা যায় ? ধর্ম , সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে এমন বিপজ্জনক নারীকে কি বাঁচিয়ে রাখা যায় ?

ডাইনি অপবাদ দিয়ে দাউদাউ আগুনে পৈশাচিক উল্লাসে বিভৎসভাবে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল জোন অফ আর্ক-কে। হাইপেশিয়াকেও মেরে ফেলা হয় প্রায় একইভাবে ৪১৫ খ্রীষ্টাব্দে । অশিক্ষা ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন একদল ধর্মীয় সন্ত্রাসী তাঁকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে খুন করে ।

হাইপেশিয়া সেদিন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে একাই বেরিয়েছিলেন আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় । কিছুক্ষণের মধ্যেই একদল উগ্র মৌলবাদী তাঁকে ঘিরে ধরে টেনে হিঁচড়ে গাড়ির বাইরে বের করে আনে । তারপর ঝিনুকের ধারালো খোলস দিয়ে হাইপেশিয়ার শরীরের চামড়া ও মাংস ছিঁড়ে ফেলতে থাকে তারা । রক্তে ভেসে যায় আলেকজান্দ্রিয়ার মাটি । এরপর তাঁর দেহটি খণ্ড-বিখণ্ড করে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় । এভাবেই শেষ হয়ে যায় এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের জীবন । বিজ্ঞান শিক্ষার জগতে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার , যে অন্ধকার কাটতে সময় লেগেছিল আরও বহুযুগ ।

বিদুষী বিজ্ঞানী , গণিতজ্ঞ ও নারী স্বাধীনতার অন্যতম দিশারী হাইপেশিয়া জন্মেছিলেন ৩৭০ খ্রীষ্টাব্দে , আলেকজান্দ্রিয়ায় । মাদাম কুরীর পূর্ববর্তী সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নারী বিজ্ঞানী হিসেবে হাইপেশিয়ার নাম আলোচিত হয় । তবে কেবল নারী বিজ্ঞানী বা নারী গণিতবিদ হিসেবে তাঁর মূল্যায়ণ করা হলে সেই মূল্যায়ণে ঘাটতি থেকে যায় ।

সত্যি কথা বলতে , ইউক্লিডের পর আলেকজান্দ্রিয়াতে নারী পুরুষ নির্বিশেষে এত বড় গণিতজ্ঞের জন্ম হয় নি । ঐতিহাসিকদের মতে , হাইপেশিয়া ছিলেন মুক্তবুদ্ধি চর্চাকারী ইতিহাসের শেষ ‘ প্যাগান সায়েন্টিস্ট ‘ । অথচ খ্রীষ্টধর্মোন্মাদীদের রোষানলে পুড়ে এই রূপসী বিদুষীকে পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিতে হয় মাত্র ৪৫ বছর বয়সে ।

এই মহিয়সীর অকাল মৃত্যুর পর পশ্চিম বিশ্বে গণিত , পদার্থবিজ্ঞান , জ্যোতির্বিদ্যা ও বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় আর কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায় নি দীর্ঘকাল , সেটাও কম করে হলেও প্রায় হাজার বছর । তাঁর মৃত্যুতে মানবসভ্যতার অগ্রগতি বহুকালের জন্য থমকে যায় । জ্ঞানচর্চায় নেমে আসে অন্ধকার । মুক্তবুদ্ধি তথা বিজ্ঞান ও শিল্প সাধনা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।‌বাড়তে থাকে ধর্মীয় আস্ফালন ও কূপমণ্ডুকতা , বর্বরতা ও অরাজকতা । প্রগতির চাকা ঘুরতে থাকে উল্টোদিকে ।‌ পিছোতে থাকে সভ্যতা । ঐতিহাসিকগণ এই কলঙ্কিত সময়টিকে আখ্যায়িত করেন ‘ ডার্ক এজ’ বা অন্ধকার যুগ নামে ।

হাইপেশিয়ার বাবা থিওন , যিনি নিজেও ছিলেন একজন বড়ো মাপের গণিতজ্ঞ এবং আলোকপ্রাপ্ত মানুষ । ছিলেন জ্যোতির্বিদ । একইসঙ্গে তিনি ছিলেন আলেকজান্দ্রিয়া মিউজিয়ামের পরিচালক । সেই সময় মেয়েদের আক্ষরিক অর্থেই দেখা হতো পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে । অথচ সেই পিছিয়ে পড়া সময়েই থিওন তাঁর মেয়েকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে। অনিন্দ্যসুন্দরী হাইপেশিয়া ছোট থেকেই ছিলেন তুখোড় মেধাবী । তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল ঈর্ষণীয় । এমন মণিকাঞ্চন যোগ প্রায় বিরল । তাঁর রূপ ও গুণমুগ্ধ পাণিপ্রার্থীদের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে নিজেকে নিবিড় বিজ্ঞানসাধনায় নিয়োজিত করেন তিনি । কিছুদিন দেশের বাইরে কাটিয়ে দেশে ফিরে তিনি আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতজ্ঞ তথা শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন এবং অচিরেই ভীষণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন । বিভিন্ন বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞান ও প্রগাঢ় পাণ্ডিত্যের কথা দূর দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ছাত্র-ছাত্রীদের এবং জ্ঞানপিপাসুদের দাবিতে আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের একটি বিশাল কক্ষে প্রতি সন্ধ্যায় সর্বসাধারণের জন্য বক্তৃতা দিতেন হাইপেশিয়া ।

পয়সা খরচ করে সেকালে এই নারীর বকLসাধারণের জন্য দর্শনী ছিল একটি মোহর । স্থায়ী ও স্বচ্ছল সদস্যেরা মাসিক ও ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে সম্মানী প্রদান করতেন । মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাঁর কথা শুনতেন গুণগ্রাহীরা।

হাইপেশিয়ার মৌলিক কাজের মধ্যে রয়েছে দায়োফ্যান্তাস রচিত অ্যারিথমেটিকা পুস্তকের উপর ১৩ অধ্যায়ের একটি মূল্যবান আলোচনা । এছাড়া অ্যাপোলোনিয়াসের কৌণিক ছেদ পুস্তিকার ওপর একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা লেখেন তিনি । ‘ Astronomical Canon ‘ শিরোনামে টলেমির কাজের ওপর আলোকপাত করেন হাইপেশিয়া । তিনি তাঁর বাবাকে জ্যামিতির কালজয়ী গ্রন্থ ‘ Euclid’s Element ‘-এর নতুন সংস্করণ লেখায় সাহায্য করেন।

তবে , যে দুটি যন্ত্রের আবিষ্কার তাঁকে ‘ উদ্ভাবক ‘ হিসেবে মহিমান্বিত করেছে তার একটি হলো ‘ অ্যাস্ট্রোলেব ‘ , আর অন্যটি হলো ‘ হাইড্রোস্কোপ ‘ । বিচক্ষণতা ও বিচারবুদ্ধির জোরে তৎকালীন শাসকদের ত্রাস হয়ে ওঠেন অপরূপা হাইপেশিয়া । তাই তাঁকে হত্যা করতে দেরি করে নি তারা ।

 

spot_img

Related articles

কালা কানুনের বিরাট সওয়াল শাহর, জীবনে কার্যকর হবে না, কটাক্ষ কুণালের

দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় না কি বিরাট পরিবর্তন আনছেন মোদি। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীও জেলে গেলে পদ খোয়াবেন। আবার...

1+1=3: সুখবর শোনালেন পরিণীতি-রাঘব

বিয়ের পর থেকেই পরিণীতির (Pariniti Chopra) প্রেগনেন্সি নিয়ে নানা গুজব ছড়ায়। কখনও নায়িকার পোশাক বা কখনও স্বামী রাজনীতিবিদ...

কৃষ্ণনগরে বাড়ির দোতলায় উঠে প্রথমবর্ষের কলেজ ছাত্রীকে গুলি করে খুন!

বাড়ির দোতলায় উঠে প্রথমবর্ষের কলেজ ছাত্রীকে (College Student) গুলি (Fire) করে খুন। ঘটনায় তীব্র চাঞ্চল্য কৃষ্ণনগরে। সোমবার, দুপুর...

Petrol Diesel price: গোটা দেশে অপরিবর্তিত আজকের পেট্রোল-ডিজেলের দাম

২৫ অগাস্ট (সোমবার), ২০২৫ কলকাতায় লিটার প্রতি পেট্রোলের দাম ১০৫.৪১ টাকা, ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ৯২.০২ টাকা দিল্লিতে লিটার প্রতি...