Friday, November 14, 2025

‘মানিক জ্বলে’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

” পালঙ্ক শুদ্ধু ধরাধরি করে যখন ট্রাকে তোলা হয় তখন একটা চোখ খোলা , একটা বন্ধ ‌। শরীরের ওপর রক্তপতাকা বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে । তার ওপরে ফুল । মুখটুকু বাদে সমস্ত শরীরটা ফুলে আর ফুলে ছেয়ে গেছে ।
উপচে পড়ছে দুপাশে …
মাথা এবং পায়ের কাছে দেশনেতা এবং সাহিত্যিক । সামনে পিছনে , দুইপাশে বহু মানুষ । সর্বস্তরের মানুষ । মোড়ে মোড়ে ভিড় । সিটি কলেজের সামনে মাথার অরণ্য । কিন্তু কাল কেউ ছিল না , কিছু ছিল না … জীবনে এত ফুলও তিনি পান নি । ” ( দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা )

” ফুলগুলো সরিয়ে নাও , আমার লাগছে । মালা জমে জমে পাহাড় হয় , ফুল জমতে জমতে পাথর । পাথরটা সরিয়ে নাও , আমার লাগছে।” ( পাথরের ফুল , সুভাষ মুখোপাধ্যায় )

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিন্নহৃদয় বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন ,” সেই ফুলের ভারে সেদিন সত্যিই দামি পালঙ্কের একটি পায়ায় চিড় ধরে গিয়েছিল । ” জীবনে যারে তুমি দাও নি মালা , মরণে কেন তারে দিতে এলে ফুল … গানটি যেন মানিকের জন্যই লেখা হয়েছিলো ।

বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথা সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় । মাত্র ৪৮ বছরের জীবনে তিনি ৪০ টি উপন্যাস ও ৩০০ টি ছোটগল্প লিখে গেছেন । এছাড়াও রয়েছে বহু অপ্রকাশিত রচনা। মানুষের মনের অতল অন্ধকার দিকটি বারবার উঠে এসেছে তাঁর কলমে । মধ্যবিত্ত জীবনের ভণ্ডামি , কৃত্রিমতা ও দ্বিচারিতা , শ্রমজীবী মানুষের নিত্য সংগ্রাম , মার্কসীয় শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্ব এবং ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ তাঁর রচনার বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে এসেছে ।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যখন মৃত্যুশয্যায় শায়িত , হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় নি , অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে । হয়তো দিনকয়েক আগে নীলরতন সরকারের কাছে নিয়ে গেলে বাঁচানো যেতো । এই অবস্থায় বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায় গভীর বেদনায় মানিকের স্ত্রীকে বলেন , ‘ এমন অবস্থা , আগে টেলিফোন করেন নি কেন ? ‘

অত আশঙ্কা ও দুঃখের ভিতরেও মলিন হেসে ভদ্রমহিলা অস্ফুট উত্তর দিয়েছিলেন , ‘ তাতে যে পাঁচ আনা পয়সা লাগে ভাই । ‘ দুঃসহ এই পরিস্থিতি রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়ার মতো ।

লেখককে শেষ জীবনে ঠাঁই নিতে হয় বস্তিতে । জীবনযুদ্ধে বিপন্ন , পর্যুদস্ত , অসহায় মানুষটি নিজেকে নিংড়ে দিয়েছিলেন সাহিত্য সাধনায়। নিকেলের চশমা , মলিন পোশাক , দীর্ঘকায়-শ্যামবর্ণ- ঋজু- আত্মদর্পী মানুষটি শেষকালে বলতে বাধ্য হয়েছিলেন , — ” দুটি ডাল-ভাতের সংস্থান না রেখে বাংলাদেশে কেউ যেন সাহিত্য করতে না যায় … ” ।

সাহিত্যে সর্বোচ্চ পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বেঁচে থাকতে কোনো পুরস্কার পান নি ।‌ এমনকি মরণোত্তর পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় আজও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম নেই । এটা ভাবলে অবাক তো হতেই হয়, লজ্জায় মুখ লুকোনোর জায়গা পাওয়া যায় না । ধিক্কার জাগে অন্তরে। কমিউনিস্ট তো অনেক বড়ো কথা , বাংলায় দীর্ঘ ৩৪ বছরের রাজত্বকালে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা একবারও মনে পড়লো না কেন বামফ্রন্টের ? তাঁরা তো অনেককেই পুরস্কৃত করেছেন।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কি বুর্জোয়া ? প্রতিক্রিয়াশীল ? তিনি কি তাঁর লেখায় ধনতন্ত্রের জয়গান গেয়ে গেছেন ? পুঁজির দাসত্ব থেকে মানুষের সার্বিক মুক্তির বিরোধী ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ? যদিও এই পুরস্কার পাওয়া না পাওয়ায় সম্ভবত কিছুই যেতো আসতো না নির্লোভ মানিকের। কিই বা হবে এখন ওই পুরস্কারে ! তবু মরণোত্তর পুরস্কার জগতের নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত জনগণের হয়ে কলম ধরার একটা স্বীকৃতি তো বটে।
সেটাও দেওয়া গেল না ৩৪ বছরে ? মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অপরাধটা কোথায় ?

বেদনাহত মানিক অনুরাগীরা এই না পাওয়ার একটা ব্যাখ্যা অবশ্য দিয়েছেন । তা হলো এই লেখকের একটি বিখ্যাত ছোটগল্প , ‘ কে বাঁচায় , কে বাঁচে ‘ । এমন গল্প তিনি না লিখলেই বোধহয় ভালো করতেন । গল্পটা খুব সরল সোজা । মনে আছে নিশ্চয় । সেই মৃত্যুঞ্জয় , সেই নিখিল । দুজনে একই অফিসে চাকরি করে । দুজনের বন্ধুত্বও খুব । একদিন অফিস যাওয়ার পথে ফুটপাতে মরে পড়ে থাকা একজন মানুষ দেখে ভীষণ বিমর্ষ হয়ে পড়লো মৃত্যুঞ্জয় ।

লোকটি নাকি না খেতে পেয়ে মারা গেছে । না খেতে পেয়ে ? স্রেফ না খেতে পেয়ে মৃত্যু ? না খেতে পেয়ে মরতে একটা মানুষের ঠিক কতটা কষ্ট হয় ? মৃত্যুঞ্জয় এইসব ভাবতে থাকে। ভাবে , সে নিজে বেঁচে থাকতে একটা লোক না খেয়ে মারা গেলো ? সে নিজে এত এত খায় , আর একটা লোক না খেতে পেয়ে মারা যায় ? এইসব ভাবতে ভাবতে মৃত্যুঞ্জয় একসময় খাওয়া বন্ধ করে দেয় । তার নিজের বেতন রিলিফ ফাণ্ডে দান করতে থাকে । প্রথমে একবেলা , তারপর দুবেলাই না খেয়ে থাকতে শুরু করে , সঙ্গে তার স্ত্রীও । বন্ধু নিখিল বিস্তর বোঝায় তাকে । এমন তো কতই ঘটে , না খেতে পেয়ে কতজনাই তো মারা যায় । তাবলে নিজেদের নাওয়া-খাওয়া ভুলে যাওয়া কি যুক্তিসঙ্গত ? কিন্তু মৃত্যুঞ্জয় এসব কথা কিছুই বুঝতে চায় না । না খেতে পেয়ে মারা যাওয়া মানুষটির কষ্ট ও তার মৃত্যুর অভিঘাত পাগল করে দেয় মৃত্যুঞ্জয়কে । বন্ধু নিখিলের যুক্তিতর্কের কথাগুলো তার মাথায় ঢোকে না আর , কারণ তার মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কাছে তখন কথার মারপ্যাঁচ অর্থহীন হয়ে গেছে ।

তারপর একদিন সবার পিছে সবার নীচে সবহারাদের দলে মিশে যায় মৃত্যুঞ্জয় ।‌ অভুক্ত , চিরদুর্গত মানুষদের অংশ হয়ে পড়ে সে । স্বপ্নে নয় , কল্পনায় নয় , স্লোগানে কিংবা বিপ্লববিলাসে নয় , মধ্যবিত্তের নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রব জীবন ছেড়ে সে সর্বহারাদের মাঝে নিজের জীবনের সার্থকতা খুঁজতে থাকে । তথাকথিত বামপন্থাকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়া এমন গল্পকারকে মরণোত্তর পুরস্কারই বা কেন দেবেন বামপন্থীরা ?

আরও পড়ুন- লক্ষ্য দুর্নীতি মুক্ত পঞ্চায়েত! এবার বদলি নীতি কঠোরভাবে চালু রাজ্যের

 

spot_img

Related articles

পাশে প্রথম স্ত্রী! সোশ্যাল মিডিয়ায় ধর্মেন্দ্রর ভিডিয়ো প্রকাশ্যে, গ্রেফতার হাসপাতাল কর্মী

গত এক সপ্তাহ অভিনেতা ধর্মেন্দ্র-র জন্য উদ্বেগে গোটা দেশ। সোমবার ১১ নভেম্বর হঠাৎ তাঁর অসুস্থ হওয়ার খবরে তোলপাড়...

ওটা বিহারের সমীকরণ, বাংলায় জিতবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়ন: বিজেপিকে উড়িয়ে জবাব তৃণমূলের

বিহার বিধানসভা নির্বাচনের (Bihar Assembly Election) এখনও পর্যন্ত ফলে ম্যাজিক ফিগার ছাড়িয়ে এগিয়ে গিয়েছে NDA। আর এই ফল...

দক্ষিণবঙ্গে শীতের আমেজ চলবে, উষ্ণতা বাড়তে পারে উত্তরে!

পারদ পতনের ট্রেন্ড বজায় রেখে দক্ষিণবঙ্গে (Winter in South Bengal)শীতের আমেজ। শুক্রবার সকালে হিমেল ছোঁয়ায় টুপি সোয়েটার সঙ্গী...

ইডেনে খেলতে এসে ছুটির আবদার! গম্ভীরকে আবেদন কুলদীপের

অবসান ঘটিয়ে ইডেনে প্রথম একাদশে জায়গা করে নিয়েছেন কুলদীপ যাদব , প্রথম সেশনে একটি উইকেটও তুলে নিয়েছেন। কিন্তু...