Monday, November 10, 2025

‘বিস্মৃত গতিদানব’, উৎপল সিনহার কলম

Date:

Share post:

উৎপল সিনহা

কে সবচেয়ে জোরে বল করতেন ? ম্যালকম মার্শাল ? অ্যান্ডি রবার্টস ? জেফ টমসন ? শোয়েব আখতার ? ব্রেট লি ? এই প্রশ্নের উত্তরে শচীন তেন্ডুলকার কিন্তু এঁদের কারো নাম করবেন না । বলবেন অন্য আরেকজনের কথা, যাঁর নাম ক্রিকেটবিশ্ব প্রায় ভুলেই গেছে । জেফ ডুজন যাঁকে বলতেন , ‘ quickest of the lot ‘ ।

কে সেই দ্রুততম বোলার ? ১৯৮৭ সালের গ্রীষ্মে যখন মাইকেল হোল্ডিং অবসরে যাওয়ার কথা ভাবছেন , তখন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে তাঁর বিকল্প খুঁজে পেতে হয়রান হতে হয় নি । সেই সন্ধিক্ষণে ম্যালকম মার্শাল তাঁর সেরা সময় পার করে ফেলেছেন , যাঁকে বলা হতো ‘ whispering death ‘ ।

সেই দুরন্ত গতি , যা দেখে ব্যাটসম্যানদের বুক কাঁপতো। হোল্ডিংয়ের ক্যারিয়ারের সায়াহ্নে লম্বামতো সুঠামদেহী এক তরুণ জ্যামাইকানের অভিষেক হয় ফাস্ট বোলার হিসেবে । জাতীয় দলে অভিষেক হওয়ার আগেই কাউন্টি ক্রিকেটে ল্যাঙ্কাশায়ার আর শেফিল্ড শিল্ডে তাসমানিয়ার হয়ে খেলার ডাক পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর বলে ছিল ভয়ঙ্কর গতি । এই বোলারের নাম প্যাট্রিক প্যাটারসন ।

১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে উইজডেন ট্রফি খেলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে আসে ইংল্যান্ড । জ্যামাইকার সাবাইনা পার্কে প্রথম টেস্টে দুই উদ্বোধনী বোলার মার্শাল আর গার্নারকে বেশ ভালোই মোকাবিলা করলেন ইংরেজ ওপেনাররা । প্রথম পরিবর্তনে এসে হোল্ডিং দেখাতে লাগলেন তাঁর ক্যারিয়ার সমাপ্তির দিকে এগোলেও বিষাক্ত সুইংয়ে একটুও ভাঁটা পড়ে নি । এরপর বল করতে আসেন প্যাটারসন । এর আগে কেউই খেলেন নি তাঁর বল । কানাঘুষা শুনেছেন ইনি নাকি প্রচণ্ড জোরে বল করেন। এবার তাঁর বল খেলতে গিয়ে গ্রাহাম গুচের মতো ঝানু ব্যাটসম্যানও বুঝলেন যে , প্যাটারসন মার্শালের চেয়েও জোরে বল করেন ।
জর্জ হ্যাডলি স্ট্যান্ডের সামনে সাইটস্ক্রিনটা ছিল ছোট । ঠিকভাবে দেখতে অসুবিধা হতো ব্যাটারদের । তার ওপর ছিল ক্যারিবিয়ান বোলারদের উচ্চতা ।

নিজের আত্মজীবনী ‘ হেড অন ‘ – এ স্যার ইয়ান বোথাম লিখেছেন , ‘সাইটস্ক্রিনটা সেদিন লম্বা করে দিলেও প্যাটারসনের বল তেমন আত্মবিশ্বাস নিয়ে খেলতে পারতো না ইংরেজ ব্যাটাররা ‘ । প্রথম ইনিংসে ১১ ওভারে মাত্র ৩০ রান খরচ করে ৪ উইকেট পান প্যাট্রিক । দ্বিতীয় ইনিংসে উইকেট পান ৩ টি । ১০ উইকেটে ম্যাচ জিতে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ । পরের বছর ভারত সফরে এসে ব্যাটসম্যানদের ত্রাস হয়ে ওঠেন প্যাটারসন ।

১৯৮৮ সালে মেলবোর্ন টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেল এন্ডাররা দারুণ লড়াই করছিলেন । স্টিভ ওয়া অনবরত বাউন্সার দিচ্ছিলেন। প্যাট্রিকের ঘাড় লক্ষ্য করে বেশ কয়েকটা বাউন্সার দেন স্টিভ । অল আউট হওয়ার পর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে অস্ট্রেলিয়ার ড্রেসিংরুমে ঢুকে পড়েন প্যাটারসন এবং হুমকি দিয়ে আসেন , ‘ you guys are going to pay for that tomorrow . I will kill you ‘ ।

পরদিন কথা রাখেন দুরন্ত গতিদানব । একাই গুঁড়িয়ে দেন অজিদের । ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে মাত্র
২৮ টি টেস্ট খেলে ৯৩ টি উইকেট দখল করেন প্যাট্রিক প্যাটারসন । খেলেছেন ৫৯ টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এরপর হঠাৎই উধাও হয়ে যান তিনি । ক্রিকেট থেকে , এমনকি নিজের পরিবার থেকেও। কেউ তাঁর খোঁজ পায় না দীর্ঘদিন ।

নব্বইয়ের দশকে স্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে প্যাটারসনকে তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকেন দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক ভারত সুন্দরেসান । তাঁর নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বিস্তর বিতর্ক ছিল । তাঁর পরিবারের লোকেরাও জানতেন না তিনি ঠিক কোথায় এবং কিভাবে আছেন । কেউ বলতো জঙ্গলে চলে গেছেন তিনি । কেউ বলতো মানসিক রোগীদের আশ্রমে আছেন তিনি । আবার কেউ কেউ নাকি রাস্তায় ভবঘুরে উদ্বাস্তুদের মতো ঘুরতে দেখেছেন তাঁকে । শেষে ২০১৭ সালে একজন আমেরিকান নাবিকের সাহায্যে অবিশ্বাস্যভাবে প্যাটারসনের ফোন নম্বর ও ঠিকানার সন্ধান পেয়ে যান সুন্দরেসান ।

সাংবাদিকের ফোন পেয়েও প্যাটারসন কথা বলতে চাইছিলেন না । শেষে তাঁর বাড়িতে পৌঁছে যান সুন্দরেসান। দেখতে পান ঢোলা জামা ও খাকি শর্টস পরা ৫৫ বছর বয়সী বিস্মৃত গতিদানবকে , যিনি ২০ বছর ধরে মানসিকভাবে অসুস্থ । তাঁর ফোকলা দাঁতে অসংলগ্ন হাসি । কথাবার্তাও যথেষ্ট অসংলগ্ন । ক্রিকেট কেন , দুনিয়ার কোনো খবরই রাখেন না তিনি । তাঁর নিজের অতীত জীবনের প্রায় কিছুই মনে নেই তাঁর । নিজের কীর্তির কথা শুনে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকেন । কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্তের কথা আবছা মনে পড়ে তাঁর । তাঁর বন্ধু মহম্মদ আজহারউদ্দিনের খবর জানতে চান তিনি । ঈশ্বরকে দোষারোপ করেন প্যাট্রিক প্যাটারসন । বারবার বলেন তিনি অবিচারের শিকার । বিড়বিড় করতে থাকেন ‘ injustice , injustice …
হায় গতিদানব , হায় প্যাট্রিক প্যাটারসন ।

আরও পড়ুন- বাড়িতে বাবার মৃতদেহ! পিতৃশোকের মধ্যেই চোখের জল আটকে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল মুসকান

_

spot_img

Related articles

রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা মুখ্যমন্ত্রীর

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে যাঁদের নাম আছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়( Surendranath Banarjee)। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ...

খাবারে বিষ প্রয়োগে গণহত্যা, বিজেপি রাজ্যে বসে ষড়যন্ত্র! দুই রাজ্যে গ্রেফতার ৫ ‘জঙ্গি’

গুজরাট। হরিয়ানা। দেশের মানুষের নিরাপত্তার পরিস্থিতি ঠিক কেমন, তা ফের প্রমাণিত হল। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বসেই নিরাপদে ভারতে...

নন্দীগ্রাম দিবসে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন: শহিদ স্মরণ মুখ্যমন্ত্রী, অভিষেকের

আজ নন্দীগ্রাম দিবসে। এদিন নন্দীগ্রাম-সহ পৃথিবীর সকল শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata...

এবার নদিয়া, এসআইআর আতঙ্কে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু বৃদ্ধের

তালিকায় নাম আছে, না নেই। গত ৪ নভেম্বর থেকে গোটা বাংলার মানুষ সেই আতঙ্কেই ভুগছেন। কী হবে ভবিষ্যৎ?...