সি পি রাধাকৃষ্ণণ, ভারতের উপ-রাষ্ট্রপতি
আজ আদিবাসী আন্দোলনের অন্যতম নেতা বীরসা মুন্ডার (Birsa Munda) জন্মদিবস। এই দিনটিকে জনজাতীয় গৌরব দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ভারতের সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকাতে দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, আদিবাসী নেতারা ঔপনিবেশিক শোষণ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সংগ্রাম করেছেন। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল জমি, সংস্কৃতি এবং মর্যাদা রক্ষা করা। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিক পর্যন্ত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক, স্থানীয় জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে আদিবাসী সম্প্রদায় আন্দোলন করেছেন। তাঁদের চিরায়ত জীবনযাত্রায় যখনই কোনও আঘাত এসেছে তখনই তাঁরা সরব হয়েছেন। তেমনই একজন আদিবাসী আন্দোলনের নেতা বীরসা মুন্ডা। ১৫ নভেম্বর তাঁর জন্মদিবস শ্রদ্ধার সঙ্গে পালিত হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) এই দিনটিকে জনজাতীয় গৌরব দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

বীরসা মুন্ডার (Bisra Munda) নেতৃত্বে উত্তাল উলগুলান আন্দোলন কিংবা আল্লুরি সীতারামা রাজু, তাঁতিয়া ভিল, বীর গুন্ডাধুর, রানি গাইদিনলিউ, রামজি গোন্ড, শহিদ বীর নারায়ণ সিং, সিধু-কানহু-সহ অন্যান্যদের আন্দোলনের মাধ্যমে এটি প্রমাণিত হয় ভারতের আদিবাসী সমাজের এই বিদ্রোহ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত জায়গায় সংগঠিত হয়নি; ঔপনিবেশিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে তাঁরা দেশ জুড়ে একটি শক্তিশালী গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। তাঁদের সেই আন্দোলন শুধুমাত্র আধিবাসীদের রক্ষা করেনি, বরং বলা ভালো দেশের স্বাধীনতা ও সাম্য নিশ্চিত করতে বৃহত্তর আন্দোলনকে শক্তিশালী করে তুলেছিল।

২০২১ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদি বীরসা মুন্ডার জন্মদিন জনজাতীয় গৌরব দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যাতে এই আদিবাসী নেতা এবং তাঁর সংগ্রামকে স্বীকৃতি দেওয়া যায়। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, কারণ এটি পরবর্তী প্রজন্মকে আদিবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য এবং সংগ্রাম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে তোলে।

এবছর বীরসা মুন্ডার জন্মের সার্ধশতবার্ষিকী উদযাপন। জনজাতীয় গৌরব বর্ষের সমাপ্তি হতে চলেছে, যা শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালে। সেই দিক থেকে এই বছরের উদযাপন একটু আলাদা।

দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ লোকসভায় অটল বিহারী বাজপেয়ী (Atal Bihari Bajpayee) যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময়ে আমার সাংসদ হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। অটলজির সময়কালে পৃথক আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রক গঠিত হয়। লোকসভার সাংসদ হিসবে আমি ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় ও উত্তরাখণ্ড রাজ্য গঠনের পক্ষে ভোট দিয়েছিলাম। আমার সৌভাগ্য যে পরবর্তীকালে আমি ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্বপালন করেছি।

ঝাড়খণ্ডের (Jharkhand) রাজ্যপাল হিসেবে শপথ গ্রহণের ঠিক পরেই আমি মহান স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরসা মুন্ডাকে শ্রদ্ধা জানাতে তাঁর জন্মস্থান উলিহাতুতে যাই। আমার এখনও মনে আছে উলিহাতুতে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি সফর করেছেন। এই সফর শুধু শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্যই নয়, এটি ছিল এক রাষ্ট্রীয় তীর্থযাত্রা। এর মধ্য দিয়ে সারা দেশ জনজাতিদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছে। প্রধানমন্ত্রী যখন ঝাড়খণ্ডের খুঁটি-তে পিএম-জনজাতি আদিবাসী ন্যায় মহা অভিযান (পিএম-জনমান) প্রকল্পের ঘোষণা করেন, সেই সময়ে আমি তাঁর পাশে উপস্থিত ছিলাম। এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হল প্রান্তিক আদিবাসী সম্প্রদায়কে রক্ষা করা এবং তাঁদের ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করা।

প্রধানমন্ত্রী এই প্রকল্পের পরিকল্পনা সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে কৃতিত্ব দিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি মুর্মু তাঁর জীবন আদিবাসী সমাজের মানোন্নয়নে উৎসর্গ করেন।

আমি লক্ষ্য করেছি গত দশকে, আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এক পরিবর্তন এসেছে। আগে কল্যাণমুখী বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হতো। বর্তমানে তাঁদের ক্ষমতায়নের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ২০২৩ সালে পিএম-জনমান প্রকল্পের সূচনার পর থেকে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত রয়েছে। ৯টি মন্ত্রক ৭৫টি পিছিয়ে পড়া আদিবাসী গোষ্ঠীর জন্য কাজ করছে। তাদের দারিদ্রের নাগপাশ থেকে মুক্ত করতে পরিকাঠামো ক্ষেত্রে ১১ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে পাকা বাড়ি নির্মাণ ও সড়ক যোগাযোগ, পানীয় জল ও বিদ্যুতের সংযোগ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ ইত্যাদি । এ ছাড়াও , বন ধন বিকাশ কেন্দ্রের মাধ্যমে তাঁদের জীবিকার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবর্ষ থেকে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। এর জন্য ২৪,১০৪ কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে। ১৮টি রাজ্য ও ১টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের ২০৭টি জেলায় প্রায় ৪৮ লক্ষ ১৮ হাজার আদিবাসীর কাছে এই প্রকল্পগুলির সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে।

সরকার আদিবাসীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়িত করছে। বীরসা মুন্ডার নামাঙ্কিত এই প্রকল্পটি হল ধরতি আবা জনজাতীয় গ্রাম উৎকর্ষ অভিযান। কেন্দ্রীয় সরকারের ১৭টি মন্ত্রক ৬৩ হাজারের বেশি আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামের সার্বিক আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এই প্রকল্পটি সহায়ক রয়েছে। আদিবাসীদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর জিওট্যাগিং করা, আদিবাসীদের বাণিজ্য সম্মেলন-সহ বিভিন্ন ইতিবাচক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে দেশের মূল স্রোতে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা বিভিন্ন আদিবাসী সমাজকে নিয়ে আসা সম্ভব হচ্ছে।

আদিবাসী সমাজের ক্ষমতায়নের জন্য এই নীতিগুলি যাতে বাস্তবায়িত হয়, তার জন্য ঝাড়খণ্ড, তেলেঙ্গনা এবং পরবর্তীতে মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়ে আমি ব্যক্তিগতস্তরে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। কেন্দ্রীয় আদিবাসী বিষয়ক মন্ত্রীর সঙ্গে একলব্য আদর্শ আবাসিক বিদ্যালয়ের সম্প্রসারণ সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি। সরকারের লক্ষ্য ৩ লক্ষ ৫০ হাজার আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীদের সুবিধার্থে ৭২৮টি এধরনের বিদ্যালয় স্থাপন করা। ইতোমধ্যেই ৪৭৯টি বিদ্যালয়ে পঠন-পাঠন শুরু হয়েছে।
১০টি রাজ্যে আদিবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিয়ে ১১টি অত্যাধুনিক সংগ্রহশালা তৈরি করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ৪টি সংগ্রহশালা উদ্বোধন করা হয়েছে। রাঁচিতে বীরসা মুন্ডা স্মারক উদ্যান ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সংগ্রহশালায় প্রধানমন্ত্রী যখন গিয়েছিলেন, তখন আমি তাঁর সফরসঙ্গী হয়েছিলাম। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই সংগ্রহশালাগুলি স্বাধীনতা সংগ্রামে আদিবাসীদের অংশগ্রহণ এবং আত্মবলিদানের তথ্য তুলে ধরেছে। এগুলি এখন শিক্ষা কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে।
ভারতের আদিবাসী অধ্যুষিত বনাঞ্চল ও পার্বত্য এলাকায় নিজেদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় আদিবাসী নেতারা যে আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন, তার মাধ্যমে তাঁদের সাহস, আত্মত্যাগ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। এই আন্দোলন সামাজিক ন্যায়, সুষমভাবে বাস্তুতন্ত্রের ব্যবহার ও মানবাধিকার রক্ষায় আমাদের অনুপ্রাণিত করে।
বীরসা মুন্ডা মাত্র ২৫ বছর জীবিত ছিলেন, কিন্তু এই সময়কালে তিনি দেশপ্রেমের যে চেতনাকে জাগ্রত করেছিলেন, তা আরও ২,৫০০ বছর সবাইকে অনুপ্রাণিত করবে। মানুষ জন্মাবে, মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবে কিন্তু বীরসা মুন্ডা-সহ অন্যান্য আদিবাসী স্বাধীনতা সংগ্রামীরা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।


