এ যেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। যে তথ্য প্রযুক্তি একসময় গ্রামের যুবকদের গ্রাম ছাড়া করেছিল, ভুলিয়ে দিয়েছিল পূর্বপুরুষের কুমোরের পেশা, সেই প্রযুক্তিই আজ সেই কুমোর পরিবারগুলির রোজগার দ্বিগুণ থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দিচ্ছে। একেই বলে হয়তো, যথার্থ বিজ্ঞানের সুফল।

অন্ধ্রপ্রদেশে (Andhra Pradesh) দেশের প্রথম আইটিতে খ্যাতি পাওয়া শহর বেঙ্গালুরু যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে অতি প্রাচীন মৃৎ শিল্পীদের (potters) গ্রামও। মাটির প্রদীপ থেকে শুরু করে বড় কুঁজো বা হাল আমলের মাটির প্লেট – সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন এলেও বহু এলাকার গ্রাম আজও মৃৎ শিল্পের উপরই জীবন যাপন করে। রাজ্যের বেঙ্গালুরু, বিজয়ওয়াড়ার মতো বড় শহরের অদূরে এইসব মৃৎশিল্পীদের ছোট ছোট গ্রাম রয়েছে।

তবে অন্ধপ্রদেশ যখন প্রথম তথ্যপ্রযুক্তি (IT) ঘিরে দেশে শোরগোল ফেলে দিয়েছিল তার ছাপ পড়েছিল রাজ্যের যুবকদের উপরও। গ্রামের ছেলেরা পারিবারিক পেশা ফেলে তথ্যপ্রযুক্তির নেশায় গ্রাম ছেড়েছিল। কুমোর হয়ে গিয়েছিলেন ‘আই টি প্রফেশনাল’।
দেরিতে হলেও সেইসব যুবকদের আজ মোহভঙ্গ হয়েছে। আইটির পেশায় শারীরিক এবং মানসিক যে চাপ তাঁদের সহ্য করতে হয়েছে তার থেকে ঘরে ফিরে আসাই অনেকে উচিত বলে মনে করেছেন। এখন পারিবারিক মাটির তৈরি জিনিসের উপর জীবিকা নির্বাহ করলে হয়তো ঝাঁ চকচকে জীবন হাতছাড়া হবে, তবে তাতে বিদেশি বা স্বদেশী আইটি সংস্থার চোখ রাঙানি আর বিব্রত করতে পারবে না তাঁদের। প্রতিদিন টার্গেট পূরণ আর চাকরি হারানোর ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এমনটা ভেবে বহু যুবক ফিরে এসেছেন নিজেদের গ্রামে।

তবে আইটির পেশায় যে রোজগার তাঁরা করতে পারতেন তার ধারে কাছে কি পৌঁছাতে পারবেন মাটির জিনিস তৈরি করে? উত্তরটা দিচ্ছে এই কুম্ভকারদের রোজগার। অন্ধ্রপ্রদেশের এইসব গ্রাম একসময় গোটা রাজ্যে তো বটেই, আশেপাশের রাজ্যগুলিকেও মাটির জিনিস পৌঁছে দিত। এখনও যে এসব জিনিসের চাহিদা এবং বাজার রয়েছে তার জন্য হয়তো দক্ষিণ ভারতের কৃষ্ণ মৃত্তিকা অঞ্চলে তপ্ত-শুষ্ক আবহাওয়া দায়ী। যেখানে মাটির কুঁজোয় জল রেখে খেলে মেলে শান্তি। সেই সঙ্গে সময়ের তাগিদে এসেছে নতুন ধরনের মাটির জিনিস তৈরীর প্রথা, যা আধুনিক হাল আমলের ফ্ল্যাট বাড়িতেও শোভা পায়।

এক সময় আইটি পেশায় যুক্ত ছিলেন বিজয়বাড়ার সাই গোপি। মাসে প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা রোজগার হত সেখানে। বেতনটা তাঁর আরও বাড়তে পারতো। কিন্তু তার জন্য অনেক বেশি শারীরিক ও মানসিক চাপ সহ্য করতে হত তাঁকে। কিন্তু নিজের জীবনের সঙ্গে সেই সমঝোতায় যাননি গোপি। ফিরে এসেছেন নিজের গ্রামে। গোপির দাবি, এই কাজে একদিকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে সে অনেক সুস্থ থাকছে। অন্যদিকে নিজের পরিবারের কাছাকাছি থাকতে পারছে। আর এতে বছরের ভালো সময়টাতে মাসে প্রায় দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত সে রোজগারও করতে পারছে। তবে অবশ্যই দীর্ঘদিন শহরে থেকে শহরের মানুষের চাহিদা অনুযায়ী নিত্যনতুন ধরনের মাটির জিনিস তৈরির বুদ্ধিও কাজে লাগাতে হচ্ছে গোপির মতো কুমোর পরিবারের যুব সম্প্রদায়কে।

মাটির জিনিস তৈরীর প্রথাগত উপায় তো অন্ধ্রপ্রদেশের মানুষ মেনেই চলেছেন। তবে তার সঙ্গে মিলেছে আধুনিকতা। আর আধুনিক প্রচার অন্ধপ্রদেশের রকমারি মাটির জিনিস তৈরিকে আকর্ষণীয় করেছে। রাজ্যের ভ্লগাররা (vlogger) প্রায়ই এইসব গ্রামে এসে ভিডিও বানান। নিজের হাতে মাটির জিনিস তৈরির চেষ্টা করেন। সেইসব ভিডিও দেখে রাজ্য তো বটেই, দেশ এমনকি বিদেশের মানুষও মাটির জিনিস তৈরি নেশায় পড়েছেন। ফলে এখন কুমোরদের নিতে হচ্ছে অনলাইন ক্লাস (online class)।

ছোট্ট মাটির কাপ থেকে বিরিয়ানির পাত্র – অন্ধ্রপ্রদেশের গ্রামগুলির মাটির তৈরি জিনিস দেখতে এক সময় বিদেশিদের ভিড় লেগে থাকত। আগেও এইসব গ্রামের শিল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে অনেক ডকুমেন্টারি। তবে করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে পর্যটক আসা কমে গিয়েছে। মাটির জিনিস বিক্রি করে উপরি রোজগার কিছুটা কমেছে গ্রামবাসীদের। তবে সেই চাহিদা এখন পূরণ করে দিচ্ছে অনলাইন ক্লাস। উইক এন্ডে যুবক-যুবতীদের মাটির জিনিস তৈরীর প্রশিক্ষণ দিয়ে মাসে প্রায় ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত রোজগার করছেন তাঁরা, জানাচ্ছেন বেঙ্গালুরু লাগোয়া কুমোর পরিবার গুলি।

আরও পড়ুন : ডবল ইঞ্জিন সরকারকে পিছনে ফেলে গড় মাসিক বেতনে এগিয়ে বাংলা

যে তথ্য প্রযুক্তি এক সময় ঘর ভেঙেছিল কুমোর পরিবারগুলির, সেই তথ্য প্রযুক্তিকেই আজ আশীর্বাদ মনে করছেন অন্ধ্রের গ্রামের মানুষ। বাস্তবে, বিজ্ঞানকে উন্নতি সাধনে প্রয়োগ করলে যে কর্পোরেট অফিসে শরীর-মন হারিয়ে ফেলার লড়াই থেকেও মুক্তি মেলে, তার প্রমাণ পেয়েছেন সাই গোপির মতো যুবকরাও। তাই বিজ্ঞানকে অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ হিসাবেই কাজে লাগিয়েছেন অন্ধ্রপ্রদেশের গ্রামের মানুষ।


