ছাত্রযুব মিছিলে পুলিশের লাঠির গল্প নতুন নাকি? কুণাল ঘোষের কলম

কুণাল ঘোষ

শুক্রবার বাম ছাত্রযুবদের সিঙ্গুর থেকে নবান্ন চলো অভিযানে পুলিশের সঙ্গে কিছু সঙ্ঘাত হয়েছে। তারপর বামেদের বহু প্রতিবাদী মন্তব্য দেখছি।

ছাত্রযুব মিছিলে অহেতুক পুলিশি হাঙ্গামার আমি বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রশ্ন হল:
এই প্রথম এসব শুনছি নাকি? 34 বছরে হয় নি? পুলিশ হিংস্রভাবে মারে নি? 1990 এর 16 অগাস্ট যুব সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মাথায় লাঠি পড়ে নি? 21 জুলাই 1993 যুব কংগ্রেসের মিছিল অকারণে ভাঙতে পুলিশের গুলিতে 12 জন মারা যায় নি? সোমেন মিত্র থেকে মানস ভুঁইঞা, কে মার খান নি? সাধারণ ছাত্র যুব মিছিলে আক্রমণ হয় নি? রাজনৈতিক সন্ত্রাস, গণহত্যা, কোনটা বাদ ছিল? বিজন সেতু থেকে নেতাই, কী দেখিনি আমরা? সাঁইবাড়ি, মরিচঝাঁপি তো আছেই। অসংখ্য উদাহরণ। পুলিশ দাঁড়িয়ে দেখেছে, সিপিএম মেরেছে। একবার বিধানসভায় সজল ঘোষদের বিক্ষোভের পর স্পিকার হালিমসাহেব সভাতেই বিচার করে তাদের তিন দিনের জন্য প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠিয়েছিলেন। কত বলব! এখন ফুলের ঘায়ে মূর্ছা গিয়ে বিপ্লবী সংলাপ দিলে চলবে?

বাস্তব হল, সিপিএম বা বামফ্রন্টের ছাত্রযুবরা 34 বছর পেছনে লোকাল কমিটি আর থানার মদত নিয়ে চলেছে। লড়াই কাকে বলে, শেখেনি। যেটা কংগ্রেস বা তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীরা চিরকাল করে এসেছে। ক্ষমতায় থাকতে বামেদের একটা প্রজন্ম নতুনদের উঠতে না দিয়ে চিরকাল নিজেরাই পদে। 2011র পর থেকে হঠাৎ সিনিয়ররা নানা কারণে সরে যেতে বা নিষ্ক্রিয় হতে এখন নেতৃত্বসঙ্কট। এখন দরকার নতুন নেতা। কিন্তু তারা তো একদিন পুলিশের লাঠির সামনে পড়লেই বিরাট বিপ্লব ভেবে ফেলছে ! এদের পোস্টের মন্তব্য দেখলে তাদের হাসি পাবেই যারা দীর্ঘকাল পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ে এসেছে।

তবে ব্যক্তিগতভাবে আমি এই আন্দোলনে ধৃত বাম তরুণ তরুণীদেরদের জামিনের পক্ষে। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে কেন আটকে থাকবে? পুলিশ এই জামিনের বিরোধিতা করে ঠিক করে নি বলে আমি মনে করি।

আসলে পুলিশ পুলিশই থাকে। যখন যার, তখন তার। ব্যতিক্রম কম। আর ব্যতিক্রম নিয়মকেই প্রমাণ করে। রাষ্ট্রশক্তির চালচিত্রের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে কয়েকদশক সংগঠন চালানোর পর এখন দুএকটি উত্তেজনাময় কর্মসূচিকেই স্বাধীনতা সংগ্রাম বা নভেম্বর বিপ্লব বলে ভাবার ভুলটি করবেন না।

বাম ছাত্রযুবরা আরও ভাবুক, সিঙ্গুর ইস্যু করছেন ভালো। কিন্তু বুঝতে হবে টাটাদের কারখানায় কারুর আপত্তি ছিল না। ছিল কৃষিজমি বাছাই ও জমি দখলের পদ্ধতিতে। সে তর্ক থাক। সিঙ্গুর হয় নি। বাস্তব। কিন্তু গুজরাটে ন্যানো সফল তো? আচ্ছা, সেটাও থাক। আমাদের ঐতিহ্য হিন্দমোটর থেকে চাঁদমণি চা বাগান, 34 বছরে সব শুকিয়ে গেল কেন? শিলিগুড়ির চাঁদমণি চা বাগান আজ নেওটিয়াদের সিটি সেন্টার ! অসংখ্য শিল্পের বন্ধ ও রুগ্ন হওয়ার দায় বামেদের নয়?

বাম ছাত্রযুবরা জানেন তো, প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার জনক কারা? জানেন তো, কম্পিউটার ঢুকতে না দেওয়ার আন্দোলনে পতাকার রং কী ছিল?

বাম ছাত্রযুবরা ভাবুন, এই 2006তেও বামভাসি বাংলা। প্রায় সব কলেজে এস এফ আই। পাড়ায় পাড়ায় ডি ওয়াই এফ। ভাবুন, এই লোকগুলো বয়স বাড়তে আজ কোন্ দিকে? এরাই তো মিছিল সমাবেশ লালে লাল রাখতেন। আপনাদের প্রাক্তনীদের ঠিকানা আজ বদল হল কেন? যে লোকগুলো ছাত্র যৌবন থেকে লালঝান্ডার মিছিলে, তারা দলের সঙ্কটে কোথায়, সেই অঙ্কটা আগে মেলান।

অবশ্যই আন্দোলন হবে। বাম ছাত্রযুবরাও রাস্তায় নামবেন। কিন্তু দীর্ঘ অনভ্যাসে আজ একটি মিছিলে পুলিশের লাঠি দেখেই যে হইচই বাধাচ্ছেন, তাতে মনে হচ্ছে বিরোধী সংগঠনের ভূমিকার প্রশিক্ষণটাও আপনাদের এখনও বাকি আছে।

আর একটা কথা, শুক্রবার সন্ধে থেকে ফেস বুকে দেখলাম: সিপিএমের সভা হলেই নাকি তা ঢেকে দিতে সিবিআই রাজীবকুমারের বাড়ি যায় !!
এই করেই আপনারা গেলেন। এত কিছু ভাবার মত জায়গায় বামেরা এখনও নেই। শুক্রবার হাইকোর্ট রাজীবের রক্ষাকবচ তুলে নিয়েছিল। তাই বিকেলে সিবিআই গেছে। এই অবান্তর ফেস বুক বিপ্লব যতদিন বন্ধ না করবেন, ততদিন দেখবেন মিছিল মিটিং যা খুশি করুন, ভোটে ভরাডুবি হবে আপনাদের। অথবা কংগ্রেসের হাত ধরে টিকতে হবে।

মনে রাখবেন, এবার ব্রিগেডেও দারুণ ভিড় ছিল বামেদের। ভোট কই। মনে রাখবেন দীর্ঘকাল জনসমুদ্র দেখিয়েও খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে শুনতে হত, ভিড় আছে, ভোট নেই। ফলে দুএকটি মিছিল নিয়ে গণশক্তির আট কলম হেডিং হতে পারে, দশমিক আট শতাংশ ভোটও বাড়া কঠিন। হ্যাঁ, নতুন কমরেডদের চাঙ্গা করার চেষ্টা করা যায়।

শেষে বলি, যেটুকু খবর রাখি, বাম শিবিরের নতুন কয়েকটি ছেলেমেয়ে ভালো কাজ করছে। সংগঠনে উঠে আসার ক্ষমতা রাখে। তার রাজনৈতিক স্পেসও বাড়বে। আপনাদের বস্তাপচা ধরণধারণ থেকে মুক্ত রেখে এদের কাজ করতে দিলে লালঝান্ডা আবার খানিকটা প্রাসঙ্গিকতায় ফিরতে পারে। অন্যথায় টিভির সান্ধ্য টক শো আর ফেস বুকেই লক্ষ্মণের গন্ডি।
এবং, অবশ্যই সেদিনের কর্মসূচিতে জখম কমরেডদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করি।

এমন দিন আসুক, যারাই শাসক হোক বা যারা বিরোধী, ছাত্রযুবদের মিছিলে যেন পুলিশ বা অন্য রাজনৈতিক বাধা না আসে। প্রিজন ভ্যান থেকে দুই ছাত্রীর হাতমুঠো দৃপ্ত ছবিটি ভালো; সামগ্রিক ছাত্রযুব আন্দোলনের প্রতীক হওয়ার উপযুক্ত।

পুনশ্চ: আমার লেখাটি যাদের পছন্দ হবে না, তারা কী লিখবেন, জবাবসহ সেটাও লিখে দিলাম।
1) সারদায় কী হয়েছিল? (জবাব: এটা আলোচ্য হলে গণশক্তির ডায়াল দিয়ে শুরু করব।)
2) আপনার মুখে বামেদের বিচার শুনব না।( জবাব: জনগণের বার্তা 2008 থেকেই আপনারা উড়িয়ে দিয়েছেন বলে এই হাল। এখনও একই মনোভাব থাকলে ভুল হবে।)

Previous articleবিজেপিতে ব্রাত্য প্রাক্তন পুলিশকর্তারা, ক্ষোভ জানালেন কৈলাসকে
Next articleরেনবোর বিরুদ্ধে জয়ে ফিরতে মরিয়া ভিকুনার ছেলেরা