‘মানব থেকে যায়’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

মানুষের মৃত্যু হয় । সে তো ব্যক্তির মৃত্যু । কিন্তু মানব থেকে যায় । সময় তো এক পরম্পরা । এক সময়ের হাত থেকে ব্যাটন চলে যায় অন্য সময়ের হাতে । এভাবেই ব্যাটন হস্তান্তরিত হতে থাকে সময়ের হাত ধরে । এ এক অন্তহীন প্রক্রিয়া । তাই কবি জীবনানন্দ লেখেন, ‘ মানুষের মৃত্যু হলে তবুও মানব থেকে যায় ‘ ।
আমাদের প্রত্যেকের জীবন একটা সীমিত কালে । সেটা ব্যক্তিকাল । কিন্তু আমরা সকলেই তো মানবজাতির অংশ । তাই ব্যক্তিমানুষের মৃত্যু হলেও মানবপ্রজাতির মৃত্যু হয় না । সঙ্গে এও উল্লেখ্য যে , প্রত্যেক মানুষ একটা মানবকালেরও অংশ ।

আবার মানবপ্রজাতিও অনন্তকাল এই পৃথিবীতে নেই। মানবের জন্মের আগেও ছিল এই মহাবিশ্ব , ফলে মানুষমাত্রেই সেই মহাকালেরও অংশ । তাই ব্যক্তিমানুষের বিচরণ তার ব্যক্তিকাল , মানবকাল আর মহাকালের বিপুল সীমানার ভেতর । এখানে কোথায় যেন গুটিগুটি পায়ে চুপিচুপি এসে দাঁড়ায় আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব । জীবনানন্দ খুব সচেতনভাবেই ‘ সময়গ্রন্থি ‘ শব্দটি ব্যবহার করেছেন । মনে পড়ে কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের একটি অসামান্য লাইন , ‘ সুতোয় সুতোয় গাঁথা সবার জন্মের নাড়ি ‘ । এটা যারা জানে না তারা রাত জেগে এপাশ ওপাশ করে ।

এ প্রসঙ্গে অবধারিতভাবে এসে এসে যায় জীবনানন্দের ‘ ঘোড়া ‘ কবিতাটি । যেখানে রয়েছে ‘ নিওলিথ স্তব্ধতা ‘ , ‘ প্যারাফিন লণ্ঠন ‘ প্রভৃতি শব্দবন্ধ । সেই নিওলিথিক যুগ , যার পত্তন সম্ভবত দশ হাজার খ্রীষ্টপূর্বাব্দে এবং সমাপ্তি ২২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে । নতুন প্রস্তর যুগ এরই অন্য নাম । প্রত্নতাত্বিক একটি সময়কালের সঙ্গে নিজের সমকালকে জুড়ে দিয়েছেন কবি । আসলে সময় তো অন্তহীন । একটি সময়কাল আরেকটি সময়কালের অংশ , তার মানেই অখণ্ড সময়কালের অংশ , ঠিক ব্যক্তিমানুষের জীবনের মতোই।

মানবসভ্যতার ক্রমবিকাশের এক উল্লেখযোগ্য সময়কাল নিওলিথিক যুগ । আর প্যারাফিন ? জৈব রসায়নে প্যারাফিন হলো সম্পৃক্ত হাইড্রোকার্বন । এরা সাধারণ বিক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে না। আবার হ্যাজাক , যাকে বলা হয় পেট্রোম্যাক্স , কেউ কেউ এটাকে প্যারাফিন প্রেসার লণ্ঠন বলেন । এ বাতিটি ইদানিং লুপ্তপ্রায় । মনে রাখতে হবে এক অর্থে প্যারাফিন কিন্তু ‘ আসক্তিহীন’ ! কবি কি এড়িয়ে যেতে পারেন আসক্তিহীনতা ?

আমরা যাইনি ম’রে আজো —
তবু কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয় ;
মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায়
কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে ,
প্রস্তরযুগের সব ঘোড়া যেন —
এখনো ঘাসের লোভে চরে
পৃথিবীর কিমাকার ডাইনামোর ‘ পরে ।
আস্তাবলের ঘ্রাণ ভেসে আসে
এক ভিড় রাত্রির হাওয়ায় ; …

কবি এসব দৃশ্য দেখছেন একটি পাইস রেস্তোরাঁয় বসে। কার্তিকের জ্যোৎস্নাপ্লাবিত প্রান্তরে ঘাস খাচ্ছে কতগুলো ঘোড়া , ভেসে আসছে আস্তাবলের গন্ধ , যেখানে কলে ঘোড়াদের জন্য খড় কাটা হচ্ছে । রেস্তোরাঁর টেবিলে কতকগুলো কাপ ( চিনামাটির সাদা কাপ ? ) সম্ভবত উল্টোনো । দেখে মনে হয় যেন কয়েকটি বেড়ালছানা গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে । বাইরে যেন এক ভিড় রাত্রির হাওয়া । সেই হাওয়া সব ঘোড়াগুলোকে ছুঁয়ে একসময় নিভিয়ে দেয় আস্তাবলের প্যারাফিন লণ্ঠন।

কী এক অপার রহস্যে যেন আচ্ছাদিত এ কবিতা । এই ঘোড়াগুলো কবেকার ? এরা কি কোনো এক মহীনের? নাকি প্রস্তরযুগের ? আবার সেই একই প্রসঙ্গ । প্রস্তর যুগের সব ঘোড়াগুলো তো মারা গেছে সেই কবে ! কিন্তু তাদের ‘ ঘোড়াত্ব ‘ ? তাদের স্বভাব , তাদের চরিত্র , তাদের বৈশিষ্ট্য ? সে সবের তো মরণ হয় না কালের পর কাল ।

এখানে মনে পড়ে অরুণ মিত্রের কবিতা ‘ রিক্সাওয়ালা’। রিক্সাওয়ালার মৃত্যু হয় , কিন্তু রিক্সা চলতেই থাকে বিরামহীন । একজন মারা গেলে অন্যজন চালায় সেই রিক্সা । দেশে দেশে , কালে কালে , গ্রামেগঞ্জে , নগরে ও প্রান্তরে রিক্সার চাকাগুলো কখনও থামে না । চাকাগুলোয় যেন অমরত্ব লেগে আছে ।

তাই কবির সমকালের হাতে কখন যেন চুপিচুপি এসে হাত রাখে নিওলিথ স্তব্ধতা । এ যেন বর্তমানের আয়নায় অতীতকে দেখা । এখন-তখন- যখন- কখন সব একাকার । কনসাসনেস অফ টাইম এজ অ্যা ইউনিভার্সাল । মহাবিশ্বের ইশারা থেকে উৎসারিত সময়-চেতনা কবির কাছে ছিল একটি সঙ্গতিসাধক অপরিহার্য সত্যের মতো । জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কবি তাঁর অনুভবে ও উপলব্ধিতে বয়ে বেড়িয়েছেন এই অবিনশ্বর সত্য ।

ইউরোপের সুররিয়ালিস্ট আন্দোলন গভীর নাড়া দেয় জীবনানন্দকে । জীবনে বাস্তব যেমন সত্য , ঠিক ততটাই সত্য স্বপ্ন । স্বপ্নহীন জীবন অসম্ভব। কঠোর বাস্তবতাকে যেমন আঁকতে হবে , তার পাশাপাশি অবশ্যই থাকবে অযৌক্তিক উপমা , অদ্ভুত ইমেজ । অতিমাত্রায় বাস্তববাদিতা ও যুক্তিবাদের বিরোধিতা চলছে তখন ইউরোপের শিল্প-সাহিত্যে । যদিও কবি জীবনানন্দ সরাসরি কোনো নির্দিষ্ট ধারার শরিক হন নি কখনও । তবে বিশ্বসাহিত্যের নানা ধারা তাঁকে প্রভাবিত করেছে বরাবরই । তাই তাঁর লেখায় রয়েছে বাস্তব আর স্বপ্নের সার্থক মেলবন্ধনের প্রয়াস , আর সময়কে এক মহাকালের ব্যাপ্তিতে স্থাপন করার আয়োজন ।

আরও পড়ুন- কর্মিসভা থেকে বাড়ি ফেরার পথে দুর্ঘটনায় মৃত্যু বিজেপি কর্মীর! শোক প্রকাশ তৃণমূলের

Previous articleঅভিনব অ্যাপ এর নয়া প্রয়াস ” টার্নিং পয়েন্ট”
Next article২৬ হাজার চাকরি বাতিল! SSC মামলার শুনানির দিনক্ষণ জানাল সর্বোচ্চ আদালত