কোন বিজয়কে চিহ্নিত করে “বিজয়া দশমী”? জেনে নিন পৌরাণিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য

দুর্গা পূজার সমাপ্তি বা অন্ত চিহ্নিত হয় বিজয়া দশমীর মাধ্যমে। পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, এই দিনেই পিতৃ গৃহ ছেড়ে দেবী পাড়ি দেন স্বামীগৃহ কৈলাসের পথে। এই দিনেই তাই দেবীর প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয়। ভারত ও নেপালের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দিনটি নানাভাবে পালিত হয়ে থাকে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই দিনটিকে ‘বিজয়া দশমী’ বলা হয় কেন? কোন ‘বিজয়’-কেই বা চিহ্নিত করে দিনটি?

‘দশমী’ কথাটির প্রাসঙ্গিক তাৎপর্য সহজবোধ্য। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে দেবী কৈলাস পাড়ি দেন। সেই কারণেই ‘বিজয়া দশমী’ নাম। কিন্তু এই দশমীকে ‘বিজয়া’ বলা হয় কেন, তার পৌরাণিক ব্যাখ্যা খুঁজতে গেলে একাধিক কাহিনি সামনে আসে। পুরাণে মহিষাসুর-বধ সংক্রান্ত কাহিনিতে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯ দিন ৯ রাত্রি যুদ্ধ করার পরে দশম দিনে তার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন দেবী। শ্রীশ্রীচণ্ডীর কাহিনি অনুসারে, আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে দেবী আবির্ভূতা হন, এবং শুক্লা দশমীতে মহিষাসুর-বধ করেন। বিজয়া দশমী সেই বিজয়কেই চিহ্নিত করে।

তবে উত্তর ও মধ্য ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই দিনে যে দশেরা উদযাপিত হয়, তার তাৎপর্য অন্য। ‘দশেরা’ শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত ‘দশহর’ থেকে, যা দশানন রাবণের মৃত্যুকে সূচিত করে। বাল্মীকি রামায়ণে কথিত আছে যে, আশ্বিন মাসের শুক্লা দশমী তিথিতেই রাবণ-বধ করেছিলেন রাম। কালিদাসের রঘুবংশ, তুলসীদাসের রামচরিতমানস, কিংবা কেশবদাসের রামচন্দ্রিকায় এই সূত্রের সঙ্গে সংযোগ রেখেই বলা হয়েছে, রাবণ-বধের পরে আশ্বিন মাসের ৩০তম দিনে অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন করেন রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ। রাবণ-বধ ও রামচন্দ্রের এই প্রত্যাবর্তন উপলক্ষেই যথাক্রমে দশেরা ও দীপাবলি পালন করা হয়ে থাকে। আবার মহাভারতে কথিত হয়েছে, দ্বাদশ বৎসর অজ্ঞাতবাসের শেষে আশ্বিন মাসের শু‌ক্লা দশমীতেই পাণ্ডবরা শমীবৃক্ষে লুক্কায়িত তাঁদের অস্ত্র পুনরুদ্ধার করেন এবং ছদ্মবেশ-মুক্ত হয়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় ঘোষণা করেন। এই উল্লেখও বিজয়া দশমীর তাৎপর্য বৃদ্ধি করে।

দুর্গা পূজার শেষ দিন হিসেবে বিজয়া দশমী পূর্বভারতে শোকাবহ হলেও শাস্ত্রে বিষয়টিকে সেইভাবে দেখা হচ্ছে না। প্রসঙ্গত রামকৃষ্ণদেবের একটি কাহিনি স্মরণীয়। রানি রাসমণীর জামাতা মথুরবাবু একবার আবেগবশীভূত হয়ে বিজয়ার দিনেও দেবীকে বিসর্জন দেবেন না বলে জেদ ধরে বসেন। তখন ঠাকুর রামকৃষ্ণ তাঁকে বোঝান যে, বিজয়ার অর্থ দেবী-মা এবং সন্তানের বিচ্ছেদ নয়। মা কখনওই সন্তানকে ছেড়ে থাকতে পারেন না। ঠাকুর বলেন, ‘একদিন বাইরের দালানে বসে মা পূজা নিয়েছেন, আজ থেকে মা হৃদয়মন্দিরে বসে পূজা নেবেন।’ এই ব্যাখ্যায় মথুরবাবুর মনের আঁধার দূরীভূত হয়। ‘প্রাধানিক রহস্য’ গ্রন্থে স্পষ্টই বলা হয়েছে ‘নিরাকারা চ সাকারা সৈব…।’ অর্থাৎ যিনি নিরাকার, তিনিই সাকার। দেবী সাকার রূপে মর্ত্যে পূজা গ্রহণ করেছেন, তারপর নিরাকার রূপে ফিরে গিয়েছেন কৈলাসে। তার অর্থ সন্তানের সঙ্গে তাঁর বিচ্ছেদ নয়। মা-সন্তানের চিরমিলনের এই শাস্ত্রীয় তত্ত্বই প্রাঞ্জলভাবে মথুরবাবুকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ।

(সংগৃহীত)

Previous articleচিকিৎসাবিজ্ঞানে তিন নোবেল, দেহকোষে অক্সিজেনের মাত্রা নিয়ে যুগান্তকারী গবেষণা
Next articleযে কারণে দশমীতে সিঁদুর খেলা হয়