অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ থাকেনা, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

বঙ্গ-বিজেপি নেতা-কর্মীরা চাইলে অস্বীকার করতেই পারেন। কিন্তু অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ থাকেনা।

বিরোধীদের প্রচারেই হোক বা নিজেদের কথাবার্তা- কাজকর্মেই হোক, পদ্ম শিবিরের গায়ে একটা স্টিকার সেঁটেই গিয়েছে, “বিজেপি বাঙালি-বিরোধী দল”। অভিযোগ, বিজেপিতে নাকি গুটখা-ধোকলা’র মাতব্বরিতে বাঙালি একঘরে। NRC-ইস্যুর পর বিরোধীদের সেই প্রচার আরও জোরালো হয়েছে। এ জন্য অবশ্য পুরোটাই বিরোধীদের দায়ি করা যায়না। বঙ্গ-বিজেপি নেতারা অকারনে NRC নিয়ে প্রথম থেকেই এমন হুঙ্কার দিয়ে চলেছেন, যাতে ওই স্টিকারটা প্রাকৃতিক নিয়মেই আরও গভীরে ঢুকেছে। এ ধরনের হুঙ্কারের আদৌ প্রয়োজনই ছিলোনা। বঙ্গে বিরোধী প্রচারের শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, এই “বিজেপি বাঙালি-বিরোধী দল” লাইনটি।
বিজেপি নেতারা বিষয়টি সম্ভবত ক্যাজুয়ালি নিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে একদল অর্ধশিক্ষিত বা অশিক্ষিত, বিজেপি’র পক্ষে বলতে গিয়ে এমন সব কথা বলছেন, যা বিজেপিকে আরও একঘরে করে দিচ্ছে। লোকসভা ভোট ছিলো 42 আসনের এবং ওই ভোটে বিজেপিকে সেভাবে ফেস করতে হয়নি “বিজেপি বাঙালি-বিরোধী দল”, প্রচারটি। গত 23 মে লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পরপরই বিজেপি যতটা লাফিয়ে তৃণমূল ভাঙ্গাতে ঝাঁপিয়েছিলো, পরে দেখা গেল, সবটাই বৃথা গিয়েছে। সুদ-সমেত তৃণমূল ফেরত নিয়েছে হাতছাড়া হওয়া সবক’টি পুরসভা। দলত্যাগ করা নেতারা হয় দলে ফিরছেন, অথবা শূন্যে ভাসমান। ভাটপাড়ার পরিস্থিতিও যে ‘আশঙ্কাজনক’, সে কথা গেরুয়া শিবিরও জানে। বিপ্লব মিত্রকে সামনে রেখে উত্তরবঙ্গে বিপ্লব করার পরিকল্পনা ছিলো বিজেপির, তা এখন কোন অবস্থায় সবাই দেখছেন।
ফলে, বিজেপি মসৃনগতিতে নবান্নে ঢুকে পড়বে বলে যারা এখনও ভেবে চলেছেন, তাঁদের বাস্তববোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। এদের ধারনাই নেই রাজ্য বিধানসভায় ভোট হয় 294 আসনের। এবং ম্যাজিক-ফিগার 148, এই সংখ্যাটি 18-র থেকে বড়। 18 লোকসভা কেন্দ্রের সবক’টি বিধানসভা আসন জিতলেও এই ম্যাজিক-ফিগার ছোঁয়া যাচ্ছে না। অথচ বছর দেড়েকের মধ্যেই বিধানসভার ভোট।

সেই পরিস্থিতি দেখার পরেও বঙ্গ-বিজেপি এখন নেমেছে নোবেলজয়ী অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়কে পিষতে। তাঁর গায়ে অন্যরকম লেবেল সাঁটতে। অর্থনীতি বিষয়টি খায় না মাথায় দেয়, সেই জ্ঞানটুকুও যাদের নেই, তাঁরাও
সোশ্যাল মিডিয়ায় বোঝাচ্ছেন নোবেল পেয়েছেন তো কী হয়েছে, আসলে অভিজিতবাবু ভয়ঙ্কর খারাপ লোক। বোঝাচ্ছেন, নোবেল কমিটি অপাত্রে দান করেছে এ বছরের অর্থনীতির নোবেল।
সন্দেহ নেই, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিজেপি নতুন করে অস্বস্তিতে পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপি সমর্থকদের অনেকেই নোবেল-জয়ের জন্য তাঁকে অভিনন্দন জানানোর বদলে আদৌ অভিজিৎকে বাঙালি বলা যায় কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। পঞ্চায়েত থেকে লোকসভা প্রায় সব ধরনের ভোটে দাঁড়িয়ে পর পর হেরেও যিনি নিজের ওজন এবং গ্রহণযোগ্যতা বোঝেননি, তেমন এক নেতাও প্রচারের আলোয় থাকতে অভিজিত-ইস্যুতে উন্মাদের মতো বিবৃতি দিয়েছেন। এসব বলে জনগনের কাছেই শুধু নয়, নিজের দলের ধিক্কারও তিনি শুনছেন। তবুও চৈতন্য হচ্ছেনা। বঙ্গ-বিজেপিকে বাংলার মানুষের কাছে ‘অচ্ছুত’ বানিয়ে তবে হয়তো থামবেন।

বিজেপির কিছু অপরিনত নেতা কেন এমন আত্মঘাতী খেলায় মেতেছেন? এর কারনও আছে। নোটবন্দির কড়া সমালোচক অভিজিতবাবুকে আন্তরিক অভিনন্দন জানানো হয়তো দলবিরোধী বা ‘মোদিবিরোধী’ কাজ হিসেবে দেখা হবে। এদের ধারনা অভিজিত-বিরোধিতা করলে মোদি-শাহ খুশি হবেন। নিজেদের নম্বর বাড়বে। ছোটবেলায় একটা গল্প পড়েছিলাম, ক্লাশ এইটে সংস্কৃতে পাশ-নম্বর পেতে পণ্ডিতমশাইয়ের পোষা নেড়ি কুকুরকে জিলিপি খাইয়েও নম্বর জুটেছিলো পাঁচ। গভীরে ভাবার সময় বা যোগ্যতা এদের নেই। ফলে অভিজিত-বিরোধিতাই পরোক্ষে বিজেপির দলীয় লাইন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গ-বিজেপির আর এক শীর্ষনেতা অভিজিৎবাবুকে অর্ধেক বাঙালি বলেছেন। বাঙালি বা গুজরাতি বলে কাউকে নোবেল দেওয়ার সিস্টেম এখনও যখন চালু হয়নি, তখন তো মানতেই হবে এই নোবেলপ্রাপ্তিকে। অভিজিতবাবু যে কাজের জন্য নোবেল পেলেন, সেই কাজ, সেই ভাবনা-চিন্তা, সেই গবেষণার ভুল ধরা যেতেই পারে। সেসব এদেশে রূপায়ন সম্ভব কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। যুক্তি দিয়ে কাউন্টারও করা যায়। বিদেশে তেমনই হয়। কিন্তু এদেশে হয়না। না হওয়ার কারন, মেধার অভাব। সস্তা, চটুল, রকের ভাষায় সমালোচনা কোন ক্ষেত্রে করা যায়, কোন ক্ষেত্রে করা যায়না, তা বোঝার ন্যূনতম যোগ্যতাও এদের নেই। অভিজিতবাবু যেহেতু বাঙালি, অভিজিতবাবু যেহেতু মোদি-অর্থনীতির সমালোচক, অভিজিতবাবু যেহেতু কংগ্রেসের ‘ন্যায়’ প্রকল্পের রূপকার, সেহেতু অভিজিতবাবু দেশের শাসকদের বিরোধী। তাই যে কায়দায় অনুব্রত মণ্ডল বা আরাবুল ইসলামের বিরোধিতা বিজেপি করে, সেই একই কায়দায় অভিজিতবাবুও বিজেপির কিছু অর্ধমেধার লোকজনের তোপের নিশানা হচ্ছেন। নিতান্তই হাস্যকর এবং করুনাযোগ্য। অভিজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের গবেষণার ঠিক-ভুল নয়, আলোচ্য বিষয়, তিনি কটা বিয়ে করেছেন, তিনি কোথায় জন্মেছেন, কেন ওনার নামের মাঝে ‘বিনায়ক’ আছে, কেন তিনি বিদেশিনিকে বিয়ে করেছেন,কেন বিচ্ছেদ হয়েছে, ছেলে কেন মারা গেল-ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সব প্রশ্ন, বিজেপি নেতাদের মুখ থেকে বেরিয়েই চলেছে।
দেশের দুর্ভাগ্য, এই ‘সমালোচক’-দের মধ্যে সাংবিধানিক পদে থাকা প্রচারলোভী লোকজনও আছেন। ভাবমূর্তি তলানিতে ঠেকে যাওয়া এ গোত্রের লোকরা প্রচারে থাকার জন্য দরকার হলে উলঙ্গ হয়ে মনুমেন্টের তলায় নাচতেও পারেন। এই ‘সুবক্তা’-দের কাছে অনুরোধ, একটু নজর রাখুন, অভিজিত বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে
সাক্ষাতকারে প্রধানমন্ত্রী কি কি বলেন, সেইদিকে। তাতে যদি চেতনা হয়।

এর মাঝে অবশ্য রূপোলি একটা রেখা দেখা গিয়েছে। রাজ্য-বিজেপির নেতা তথা লোকসভা নির্বাচনে দলের প্রার্থী হওয়া রন্তিদেব সেনগুপ্ত নিজের দলের নেতাদের অভিজিত-বিরোধিতার নামে নিম্নরুচির মন্তব্যের নিন্দা করেছেন। এ ধরনের মন্তব্য না করার অনুরোধ জানিয়েছেন। জানিনা, রন্তিদেববাবু কতখানি কনফিডেন্ট যে তাঁর কথা দলীয় নেতারা শুনবেন। উল্টে আশঙ্কা থাকছে, রন্তিদেববাবুই না অর্ধমেধা বা মেধাহীন নেতৃত্বের চক্ষুশূল না হয়ে পড়েন।

1913 সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ভাবতে আশঙ্কিত হতে হয়, 1913 সালে এভাবে সোশ্যাল মিডিয়া সক্রিয় থাকলে এবং এমন গোত্রভুক্ত কিছু ‘কাব্যপ্রেমী’ থাকলে গীতাঞ্জলি বা Song Offerings নয়, ঝড় উঠতো কেন রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম পিরালী ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে বড় ভাইয়ের স্ত্রী কাদম্বরী দেবীর কিসের সম্পর্ক ছিলো? কেন কাদম্বরী আফিম খেয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন ইত্যাদি ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বিষয় নিয়ে। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বকবি হওয়ার সাধ ঘুচিয়ে দেওয়া হতো। অভিজিতের ক্ষেত্রে তো তেমনই চেষ্টা হচ্ছে।

এসব কারনেই আরও একবার স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, বিজেপি বাঙালি বিরোধী দল।
সূত্রের খবর, দিল্লি বিজেপির শীর্ষ নেতারাও চাইছেন না, অভিজিৎকে নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে রাজ্য বিজেপি নতুন করে বাঙালি বিরোধী তকমা গায়ে জড়াক। দিল্লি থেকে বার্তা পাঠানো হয়েছে, রাজ্য বিজেপি যেন এই বিষয় সতর্ক থাকে। কারণ, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল পাওয়ার সঙ্গে বাঙালির আবেগ জড়িয়ে আছে। বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ বলেছেন, “রাজ্য বিজেপির তরফে আমরা নোবেলজয়ীকে অভিনন্দন জানিয়েছি। তবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সবার থাকা উচিত।”
এ কথা ঠিক তৃণমূল আগাগোড়াই প্রচার করে আসছে, বিজেপি বাঙালি-বিরোধী দল। NRC-হুঙ্কারের পর রাজ্যের শাসক দলের সেই প্রচার আরও জোরদার হয়েছে। আর বোঝাই যাচ্ছে তার ফাঁকে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিজেপি নতুন অস্বস্তিতে পড়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপি সমর্থকদের অনেকেই অভিজিৎকে আদৌ বাঙালি বলা যায় কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। অভিজিৎবাবুকে অর্ধেক বাঙালি বলা হচ্ছে। পুরো গুজরাতি না হয়ে যাদের কাছে ‘অর্ধেক বাঙালি’ হওয়া ভয়ঙ্কর অপরাধের, তাদের গায়ে বাঙালি-বিরোধী তকমা তো লাগতেই পারে। কিন্তু এর পরিনাম কী ?

অন্ধ হলে তো প্রলয় বন্ধ থাকেনা।

Previous articleদিল্লিতে বসে পীযূষ গোয়েলকে কার্যত ধুইয়ে দিলেন নোবেলজয়ী অভিজিৎ
Next articleব্রেকফাস্ট নিউজ